21037

আজ জনকের ফেরার দিন, বাঙালির পূর্ণতার দিন

আজ জনকের ফেরার দিন, বাঙালির পূর্ণতার দিন

2021-01-10 06:35:34

সৈয়দ আরিফ হোসেন

আজ ১০ই জানুয়ারি। বাঙালির আনন্দের দিন,প্রাপ্তির দিন,পূর্ণতার দিন। ১৯৭২ সালের আজকের দিনে বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক, বাংলার হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ, বাঙালির নিরন্তর প্রেরণার উৎস, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অন্তরের অন্তহীন আস্থা ও ভালোবাসা, ত্যাগ-তিতিক্ষার স্বর্ণসিঁড়ি পাড় হয়ে সুদীর্ঘ ৯ মাস পরে জননী বাংলার কোলে ফিরে এসেছিলেন জননীর শ্রেষ্ঠ সন্তান।

স্বাধীনতা আমাদের পরম আরাধ্য ধন, আর এই স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছিল স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। পরাধীনতার দুয়ার ভেঙে মুক্তির আলোকবর্তিকা হয়ে তিনি এসেছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাস যুদ্ধের পর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও ৭২এর ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতি বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু নিজেই তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন- ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’ হিসেবে।

যুগ যুগ ধরে সারাবিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সংগ্রাম এবং অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বঙ্গবন্ধু চিরঅম্লান। পাকিস্তানি স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির সকল আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা।

আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেন। কিন্তু ২৫ মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনী যখন বাঙালি জাতির উপর গণহত্যা চালাতে শুরু করে, তখন সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর পর পরই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।

একদিকে শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, অন্যদিকে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকেন। পরিকল্পনা হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির মঞ্চেও নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারের পাশেই বঙ্গবন্ধুর জন্য কবর খোঁড়া হয়। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অদম্য সাহসিকতা এবং বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী।

৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান। এদিন বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে বিমানে তুলে দেয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তাঁরা লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান। বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ বঙ্গবন্ধুকে নজীরবিহীন সম্মান দেখান। ইতিহাস সাক্ষী, সেদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ নিজে তাঁর কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলেন।

সকাল ৮টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা (পরে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে বলেন ‘গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট।’
বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা জেনে হাজার হাজার বাঙালি হোটেল ঘিরে ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন "এক মুহূর্তের জন্য আামি বাংলাদেশের কথা ভুলিনি, আমি জানতাম ওরা আমাকে হত্যা করবে আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাব না, কিন্তু আমার জনগণ মুক্তি অর্জন করবে।"

বেলা ১০টার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। পরে ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিমানে করে পরের দিন ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন। দশ তারিখ সকালে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে নামেন। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, প্রধান নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান।

বঙ্গবন্ধু ঢাকা এসে পৌঁছেন ১০ জানুয়ারি। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য প্রাণবন্ত অপেক্ষায় ছিল। বিমানবন্দর ও রাস্তার দু’পাশে অপেক্ষমাণ জনতা। অন্যরকম উত্তেজনা সবার চোখেমুখে। বাঙালির মহান নেতা আসছেন। লাখো মানুষের ভিড় রাজপথজুড়ে। কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ। বঙ্গবন্ধু এলেন।

আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। বিকাল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। বিশাল জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শিশুর মতো আবেগে আকুল হলেন। আনন্দ-বেদনার অশ্রুধারা নামলো তার দু’চোখ বেয়ে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবি, হিন্দু-মুসলমানসহ সকলের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে বললেন, "আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারবো না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবি যে ভাবে সংগ্রাম করেছে আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, ফাঁসি কাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবে না। আমি আমার সেই যেই ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।"

প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলে বাংলার আকাশ বাতাস। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কান্না জর্জরিত কন্ঠে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বলেন, "আজ আমি যখন এখানে নামছি আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।"

বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা, যিনি সারাজীবন অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের পাশে থেকে তাদের দু:খ দুর্দশা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এই উপলব্ধিবোধ থেকেই তিনি বাংলার মানুষের জন্য নিজের জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েছেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সংগ্রাম করে গেছেন।

বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের অবিসংবাদিত নেতা। নেতৃত্বের দক্ষতা এবং মানুষকে ভালোবাসার এক মহান গুনের কারনে তিনি শুধু নিজ দেশই নয়, দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমানভাবে সমাদৃত আছেন। আজ তিনি বিশ্ববন্ধু। যুগের পর যুগ বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবন এবং কর্মের জন্য সারাবিশ্বের অবহেলিত এবং নিপীড়িত মানুষের কাছে প্রেরণা হয়ে থাকবেন।
বঙ্গবন্ধু চির অমর, চির অম্লান তাঁর কর্ম।

লেখক-
সৈয়দ আরিফ হোসেন
সহ-সভাপতি
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

সম্পাদক: ইসমাঈল হোসাইন রাসেল
যোগাযোগ: ক্যাম্পাস টাইমস
৪৩ শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক, হাটখোলা রোড, চৌধুরী মল, টিকাটুলি, ঢাকা-১২০৩
মোবাইল: ০১৬২৫ ১৫৬৪৫৫
ইমেইল:[email protected]