11253

ক্যাম্পাস প্রেমের দুইটি মন মাতানো গল্প

ক্যাম্পাস প্রেমের দুইটি মন মাতানো গল্প

2018-10-16 07:35:44

সাফফাত মাহিমঃ ক্যাম্পাসের ফুটপাথ ধরে হাঁটছি। হাতের বাম দিকে ইউনিভার্সিটি মেডিকেল, মোতাহের হোসেন ভবন আর ডান দিকে রাস্তার অপর পাড়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। আমার লক্ষ্য কার্জন হল সংলগ্ন বাস স্টপেজে গিয়ে দুপুর ২.১০ এর মিরপুরগামী ভার্সিটি বাস চৈতালি ধরা।
আকাশে তখন কালিগোলা অন্ধকার। ঠাণ্ডা একটা বাতাস মাঝে মাঝে ভেতরটাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বাতাসের বেগ বাড়লো। শুরু হল ধূলি ঝড়। আমি এক দৌড়ে গণিত ভবনের নীচে চলে গেলাম। একটু পরই ঝুম বৃষ্টি নামলো।
আমি ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে খুলে মাথায় দিলাম, এরপর গণিত ভবনের বাইরে পা রাখবো এমন সময় পেছন থেকে সুরেলা একটা নারী কণ্ঠ শুনতে পেলাম - " সাফফাত মাহিম ! "

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। ফতুয়া - জিন্স পড়া, চুল ছোট করে ছাঁটা, মাঝারি উচ্চতার, ধব ধবে ফর্সা এক বিড়াল চোখী অচেনা তরুণী আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। আন্দাজ করলাম, কোনো ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড হতে পারে যার ব্যাপারে এই মুহূর্তে কোনো তথ্য মাথায় আসছে না।
যাই হোক, মেয়ে যেহেতু সুন্দরি তাই ভাবলাম, আমার পিকুলিয়ার পারসোনালিটি দেখিয়ে তাকে ইমপ্রেসড করার চেষ্টা করা যেতে পারে। কোমল গলায় বললাম, " আমাদের কি আগে দেখা হয়েছিল "
" বাস্তবে একবারো না। ক্যানভাসে আপনার লেখা মাঝে মাঝে পাই। সেই সূত্রে দু একবার আপনার প্রোফাইল ঘাঁটা হয়েছে। "
" যাক লেখালিখির সিদ্ধান্তটা মনে হয় ভুল ছিল না। " ( গদ গদ হয়ে বললাম )
" মে বি ! আচ্ছা একটা অনুরোধ। উম...( ইতস্তত ভঙ্গিতে ) তরঙ্গ বাস পর্যন্ত আপনার ছাতার নিচে যাওয়া যাবে ?"
" যদিও বাস ধরার প্ল্যান ছিল না, তবুও চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। হাজার হোক আপনি আমার লেখার একজন পাঠক। " ( ছোট খাটো মিথ্যেটা বলে দিলাম )

মেয়েটা এখন আমার ছাতার নীচে। মেয়েটার চুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগছে। ছাতার নিচে গুঁটি সুটি পায়ে আমরা কেন্দ্রিয় খেলার মাঠের পাশের ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলেছি। গায়ে গা যাতে না লাগে এজন্য নিজের শরীরের অর্ধেক ছাতার বাইরে বের করে রেখেছি। এখনো মেয়েটার পরিচয় জানতে চাই নি, জানতে ইচ্ছেও করছিল না। তবে মেয়েটাকে চমকে দিতে ইচ্ছে করছিল, কারন আমার পুরনো পাগলামির রোগটা ক্রমশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
হঠাৎ করে মেয়েটাকে বললাম, " আপনি ছাতাটা নিয়ে চলে যান। আমি আপাতত এই তুমুল বৃষ্টির আহবানকে উপেক্ষা করতে পারছি না। আমি এখন ভিজতে ভিজতে শহিদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে গিয়ে বসবো। তারপর এক দৃষ্টিতে বৃষ্টি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত জলের দিকে তাকিয়ে থাকবো।"
মেয়েটা মনে হয় কিঞ্চিত অবাক হল। চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
" আপনি আসলেই এখন ভিজতে ভিজতে চলে যাবেন ? "
" আমার মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে আমাকে যা করতে বলে আমি সেটাই করি। "
" কিন্তু আপনার ছাতা ! "
" ক্যাম্পাস বেশি বড় না। পরে খুঁজে বের করে দিয়ে দেবেন না হয়! "
এই বলে আমি গট গট করে হেঁটে কার্জন হলের দিকে ভিজতে ভিজতে চলে গেলাম। পেছনে তাকাই নি। যদিও তাকাতে ইচ্ছে করছিল !

শহিদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ে বসে ঠাণ্ডায় কাপছি। বৃষ্টির বেগ তখনো কমে নি। ভেবেছিলাম পুকুর পাড়ে বসে একটা গল্পের প্লট নিয়ে ভাববো। কিন্তু হাড় যেভাবে কাঁপছে, তাতে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ঠাণ্ডায় জ্বরে বেহুশ হয়ে যাবো। তবে আপাতত উঠে পড়ার চিন্তা করছি না। নিজেকে অদ্ভুত কিছু হিসেবে প্রদর্শনের ইচ্ছে আমার চিরকালই ছিল।আমি সব সময় চেয়েছি, সবার চোখে আলাদা ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে। আমার কথা বা প্রশ্ন করার ধরন, আচরন, হুট করে কোনো কাণ্ড করে ফেলা এসবের মূলে আমার ভাবনা একটাই ছিল, মানুষ আমাকে দেখে একবার হলেও অবাক হবে। আমি বহুবার এটেনশন সিকার হতে সক্ষমও হয়েছি পরিচিত বা অপরিচিত মহলেও। এই যেমন সেদিন হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে হিমু সেজে ভর দুপুরে উত্তপ্ত পিচ ঢালা পথে হেঁটে বেরিয়েছিলাম।
পায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল। তাতে কি ! অন্তত পঞ্চাশ জন মানুষ আমার ছবি তুলেছিল। আমি সেটাকেই আমার প্রাপ্তি মনে করি। আমার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেলো কানে নারী কণ্ঠের আওয়াজ শুনে।

" আপনি তাহলে সত্যি এখানে আছেন ! "
আমাকে অবাক করে মেয়েটা এখন পুকুর পাড়ের তৃতীয় সিঁড়িতে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাও কাক ভেজা হয়ে গেছে, হাতে আমার বন্ধ করা ছাতাটা।
" আ . আপনি যান নি ? "
" আপনি কি ভেবেছিলেন ক্যাম্পাসে আপনিই এক মাত্র প্রাণী যার পাগলামি করার রোগ আছে ? "
" প্রকৃতি তাহলে মাঝে মাঝে কল্পনার বিষয় বস্তু গুলোকে বাস্তবে এনে হাজির করে ! "
" স্বপ্নের মত কিছু বা সিনেমাটিক কিছু করার সাহস আসলে আমাদের সবার থাকে না। "
" মন্দ বলেন নি। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে সেই মাততে পারে যে তার খেয়াল খুশি মত চলতে পারে। "
" এজন্যই বুঝি থর থর করে কাঁপতে কাঁপতেও রোম্যান্টিক হওয়ার চেষ্টা করছেন ? "
" এই মুহূর্ত যদি শেষ না হয় তবে জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত রোম্যান্টিক হওয়ার চেষ্টা করবো।"

আচমকা মেয়েটা আমার কাঁধে মাথা রাখলো। আমি কিছুটা হক চকিয়ে গেলাম। এখনকার অনুভূতিটাকে রবিন্দ্রনাথের ভাষায় সুখের মত ব্যথা বলা যেতে পারে। আমার হার্ট বিট বাড়ছে। রক্ত চলাচলের গতিও দ্রুত হয়ে গেছে। কিছু বলার চেষ্টা করছি, তবে মুখ দিয়ে একটা রা ও ফুটছে না।
মেয়েটাই নীরবতা ভেঙ্গে দিল - " বেশি আনন্দে মারা যেতে ইচ্ছে করে কারো কারো। আমি হলাম সেই দলভুক্ত। "
" আমি যদি ঠাণ্ডায় মারা যাই, তবে আমার প্রাণহীন দেহটা মনে হয় আপনার কোলেই লুটিয়ে পড়বে, তাই না? "
" আমরা তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং ভাবে মরতে পারি। " ( মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গিটা এবার অন্য রকম লাগলো )

মেয়েটা আমার কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে আমার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে থাকলো। আমার কেমন যেন ঘোর লাগা অনুভুতি হতে থাকলো। মেয়েটার ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। মেয়েটা এখন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে। আমার চার পাশ ক্রমেই ঝাপসা হতে লাগলো। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে সেই হাসির আওয়াজ। মেয়েটার অস্পষ্ট কথা কানে বাজছে - " প্রতি বছর এ পুকুরটার একজন করে মানুষ দরকার হয় জানেন নিশ্চয়ই! ১৭ সালে পরিসংখ্যানের ছেলেটা, ১৬ সালে এপ্লাইড ক্যামেসট্রির ছেলেটা আর উম ১৮ সালে আপনি আর আমি ! চলুন ! উঠে দাঁড়ান ! আমরা এখন অবগাহন করবো ঐ পুকুরের জলে ! "

আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত উঠে দাঁড়ালাম তারপর মেয়েটার হাতে হাত রেখে ধীরে ধীরে পাড়ের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম। পায়ে জলের স্পর্শ পাচ্ছি। ঠাণ্ডা হিম জল ! এখন আর কাপুনি আসছে না অবশ্য। আমরা হেঁটেই চলেছি সামনের দিকে। আমাদের লক্ষ মনে হয় মাঝ পুকুর। আমি জানি না ! মেয়েটা জানে ! আমরা এখন হাঁটু পানিতে, মেয়েটা আমার হাত আলতো করে ধরে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
হুট করে পেছন থেকে আসা একটা চিৎকারে আমি ভীষণ চমকে গেলাম। মনে হল আমার ঘোরটা কেটে গেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি দুজন লুঙ্গি গেঞ্জি পড়া দুই তরুণ ছাতা মাথায় দিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
" ভাই ! কি করছেন আপনি ! গাজা বেশি খাইসেন না মরার শখ বেশি হইসে ! "
" ও .... ও ... ওই মেয়েটা ..... ( কাপুনির চোটে কথা বলতে পারছি না)
" কই মেয়ে ? কোন মেয়ে ? "
আমি পাশে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। আমি একাই হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে কাপছি।

আমার সহ্য শক্তি একটু বেশি বলেই হয়তো তখনো জ্ঞান হারাই নি। কাঁপতে কাঁপতে ঠিকি শহিদুল্লাহ হল ছেড়ে ডিন অফিস পেরিয়ে গেটের দিকে এলোমেলো পায়ে এগুচ্ছিলাম ৩.২০ এর বাস ধরার আশায়; ঠিক তখনি সেই পরিচিত নারী কণ্ঠ শুনে আরেক বার চমকে উঠলাম। " সব ঠিক আছে মি. লেখক ? "
" কে আপনি ! সত্যি করে বলুন । "
" সত্যি ! সেটা আবার কোথা থেকে আসবে। আমাকে স্রেফ আপনার গল্পের প্লটের একটা অংশ হিসেবে ধরে নিতে পারেন। হয়তো আমাদের আর দেখা হবে না। "
আমি জবাবে কিছু বলতে যাব এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাকলো, তাকিয়ে দেখি প্রথম বর্ষের এক ছোট ভাই।

" ভাই আপনের এই অবস্থা কেন? আপ্নে তো রীতি মত কাপছেন ! ব্যাগ থেকে তো দেখছি ছাতাটা বের হয়ে আছে, মাথায় দেন নাই কেন? "
" ছাতা ! আছে নাকি ! " ছাতাটা দেখে ভেতর থেকে আরেক বার ধাক্কা খেলাম।
" ভাই হলে চলেন। আপনাকে শুকনা কাপড় দিতাসি। এই অবস্থায় বাসের দিকে যাইয়েন না। "
" আচ্ছা চল। " পেছনে তাকিয়ে মেয়েটাকে দেখার চেষ্টা করলাম না কারন জানি মেয়েটা আরেকবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। (সমাপ্ত )

শাহ শুভ: যৌবনের গোড়ায় নারী প্রভাবের কারণে আবেগবশত ভার্সিটি লাইফের প্রথম মাসেই সম্পূর্ণ অপরিচিতা "শ্রাবণী"কে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসলাম।
ক্লাসের প্রথম দেখায় ভালো লেগে গিয়েছিল।
প্রথম দিনেই আমার সাথে পরিচয়।তারপর প্রতিদিন ওর সাথে কথা বলতাম।
শ্রাবণী দেখতে ঠিক ছবির মতোই সুন্দর।বিশেষ করে মায়া ভরা মুখটাতে সবসময় হাসি লেগেই থাকে।দেখলেই মনে হয় কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে পারেনা।
যখন ওর ক্লোজ বান্ধবীদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানলাম যে ও সিংগেল তখনই মনোহরের দরজায় প্রেম ঠকঠক করতে লাগলো।
একটা প্রবল আশা নিয়ে কয়েক সেকেন্ডেই এক সাথে টিএসসির কোনো কোণায় বসে বাদাম খাওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখে ফেললাম।
ভাবলাম আমার সাথে যে হিসেবে হাসিমুখে কথা বলে পজিটিভ কিছুর আশা করতেই পারি!!

কিন্তু সেই মেয়ে আগপাছ কিছু না ভেবে
মুখের উপর না করে দিল।
হিমালয় সমান রাগ নিয়ে বলল,"জীবনে যেন তার সাথে আর কথা না বলি"।
কড়া ভাষায় আরোও অনেক কিছু এক নিশ্বাসেই বলে ফেলল।
চোখে তার ছিল আগুনের ফুলকি।
ভাগ্যিস আমি আর ও ছাড়া ঘটনাস্থলে কেউ ছিল না।থাকলে কি কেলেঙ্কারিটায় না হত!!
এজন্য মাঝেমাঝে খোদার কাছে শুকরিয়া আদায় করি।

হাইস্কুল আর কলেজ লেভেলে অনেক কেই প্রস্তাব দেওয়ার জন্য মনস্থির করেছিলাম।কিন্তু সাহস পাইনি।
এবার যে কি কারণে সাহস করে বলতে গেলাম।
তাছাড়া এতো তাড়াতাড়ি বলাটাও সমীচীন হয়নি।আরোও সময় নেয়া উচিৎ ছিল।

ছোটবেলা থেকেই আমি একগুঁয়ে তার সাথে বদমেজাজি স্বভাবের।
ক্লাস 'থ্রী' তে থাকাকালীন হেড মিস্ট্রেস এর মেয়ের সাথে সিট দখল করা নিয়ে বিরাট দরবার হয়েছিল।তখন থেকে ওর সাথে কথা বলাবলি বন্ধ।যদিও ফেসবুকে লাইক দেয়াদেয়ি হয়।
তার ফলশ্রুতিতে শ্রাবণীর সাথেও আর কথা বলিনি।
কিন্তু শ্রাবণী কে পাওয়ার আশা কখনোই ছাড়িনি।
মাঝেমাঝে একই গ্রুপে কাজ করলেও কোনো কথা হয়নি।যা হয়েছে সাংকেতিক ভাষায়।তবে শ্রাবণীর সব খোঁজখবর রাখতাম।

ঘটনার মাস ছয়েক পেরিয়েছে।
প্রথম বর্ষ ভাইভার জন্য সবাই দাঁড়িয়ে আছি।শ্রাবণী আর আমার রোলের বেশী পার্থক্য নেই।আমার তিন ধাপ পেছনেই ওর রোল।
পেছন থেকে মনে হচ্ছে আমায় কেউ ডাকছে।
প্রথমবার হেলুসিনেশন মনে হলেও দ্বিতীয় বারের ডাকে পেছনে তাকালাম।
দেখি আমার পেছনে 'শ্রাবণী' শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে।শাড়িতে ওকে বিবাহিত মহিলার আবহ দিয়েছে।কিন্তু খারাপ লাগছেনা।
ইশারায় বললাম,"আপনি কি আমায় ডাকছেন???
শ্রাবণী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।ঠোঁটের কোণায় তার মৃদু হাসি।
আমি গুটি গুটি পায়ে শ্রাবণীর দিকে গেলাম।আর আনমনে অগোছালো কিছু ভাবছি।
এতগুলো পরিচিত লোকের সামনে আবার কিছু করে না বসে!!

কিন্তু মাস ছয়েক পর আজ হঠাৎ শ্রাবণীর মুখে নিজের নাম শুনে রীতিমত অবাকই হলাম।হৃদয়ে একপ্রকার আশার প্রদীপ নিভুনিভু করেও জ্বলতে লাগলো।
শ্রাবণীর সামনে এসে ইতস্তত বোধ করতে দাঁড়ালাম।কি বলে সম্ভোধন করবে বুঝতেছিনা।
আমি কিছু বলার আগেই শ্রাবণী বললো,"সিগারেট কি নিয়মিত খাও"??
আমি পুরায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম।ভাইভার দিনে এসব কি কথাবার্তা।
কাঁচুমাচু করে বললাম,"খাই মাঝেমাঝে।
আগ্রহ নিয়ে জিগ্যেস করলাম, তুমি কি করে জানলে"??
"নিজের চোখে দেখেছি মল চত্বরে খেতে।এসব খাওয়া ঠিক না"।
কিছুটা থতমত খেয়ে বললাম,"আর কিছু বলবে"?
"না।তবে ব্লেজারের পেছন আর টাই টা একটু ভালো করে নিও"।
বিড়বিড় করে বললাম,"এত যখন দরদ।নিজে তো ঠিক করে দিলেই হয়"।

দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম ক্লাসে অলৌকিক ভাবে শ্রাবণী আমার পাশে এসে বসলো।
এসেই বললো,"কেমন আছো"??
-জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তুমি??
-হুম ভালো।
এরপর আবার নিয়মিত কথাবার্তা হতে থাকলো।কিন্তু আগের মতো দুঃসাহস দেখায়নি।

একদিন ক্লাস শেষে টিএসসি যাব;দেখি শ্রাবণী বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
ওর সামনে গিয়ে জিগ্যেস করলাম,
-তুমি কোথায় থাকো??
-কল্যাণপুরে।
-আংকেল-আন্টিসহ??
শ্রাবণী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললো,"আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই।খালার বাসায় ছোটবেলা থেকেই বড় হয়েছি।সেখানেই থাকি"।
আমি খানিকটা বিব্রতবোধ করে মাথাটা নিঁচু করলাম।
যে মেয়ের সাথে দেড় বছর থেকে লেখাপড়া করি অথচ তার সম্পর্কে কিছুই জানিনা।না জেনেই প্রেমের প্রস্তাব!!
না ব্যাপারটা অন্যায় হয়েছে।
কিছুটা লজ্জিত হয়ে বললাম,"শ্রাবণী তাহলে আমি যাই।ভালোভাবে যেও"।
ও কিছু বললোনা।
আনমনে আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখটা নামালো।

১ ঘন্টা ২০ মিনিটের বোরিং লেকচার হজম করার পর মলচত্বরে সিগারেট কিনে দাঁড়িয়ে সুখের টান দিচ্ছি।
দেখলাম পশ্চিম দিক থেকে শ্রাবণী দ্রুত গতিতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
যে গতিতে আসছে এ মেয়ে এসে রাগারাগি করবে না তো আবার!!
এত দ্রুত আসছে ক্যান।
আধাপোড়া সিগারেট টা ফেলে দিলাম।
ও এসে স্টাচুর মতো দাঁড়ালো।
কিছুক্ষণ আমার দিকে রাগ নিয়ে চেয়ে থেকে বললো,
-গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল তোমার সাথে।একটু সময় দিতে পারবে।
-হুম।
-তো আমরা কোনোখানে বসে কথা বলি।
রাজি হলাম।

প্রথমে সিগারেট খাইতে নিষেধ করার কথা বলার জন্য দুঃখিত।
আর যে ছয়মাস কথা হয়নি তার জন্যেও।
আসলে এত অল্প সময়ে ক্লাসমেটের কাছ থেকে এরকম প্রস্তাব আশা করিনি।
আমি বললাম,"সরি।আসলে আবেগবশত ভুল করে বলে ফেলেছিলাম।আমি লজ্জিত"।
শ্রাবণী মুচকি হেসে বললো,"এখন কি আবেগ নেই"।
আমি কোনো হ্যাঁ/না কিছুই বলতে পারলাম না।

শ্রাবণী আমার সাথে এমন ভাবে কথা বলছে মনে হচ্ছিল ও আমার প্রস্তাবে এখন রাজি।আশার প্রদীপ আবার জ্বলতে থাকলো।তাহলে কি একসাথে বাদাম....
তবে এই মেয়েকে আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা।
আমি কথা ঘুরিয়ে প্রয়োজনীয় কথাটা বলতে বললাম।

ও বললো,
-"যে জন্য ডেকেছি আগামী রবিবার আমার বিবাহ।তুমি অবশ্যই আসবে।এই হলো তোমার ইনভাইটেশন কার্ড"।
আমার পাতলা-গড়ন দেহটা হালকা মোচড় দিয়ে উঠলো।কে যেন হৃদয়ের মাঝে কুঠারাঘাত করতে লাগলো।।আশার প্রদীপ অপ্রত্যাশিত দমকা হাওয়ায় ধরাস করে নিভে গেল।হঠাৎই আমার চোখের পাতা কাঁপা আরম্ভ করলো।
মনে হচ্ছে আমি সজোরে কেঁদে ফেলবো।আর আমার কাঁদার দৃশ্য দেখার জন্য শ্রাবণী অধীর আগ্রহে আমার দিকে চেয়ে আছে।

সব সামলে কার্ড টা ওর হাত থেকে নিলাম।আমি বললাম ঠিক আছে যাব।
অনেল কষ্টে কাঁপাকাঁপা গলায় উইশ করলাম যে,"তোমার জীবন সুখের হোক"।
আজ তাহলে উঠি। আমার একটা কাজ আছে।অন্যদিন গল্প করা যাবে।
শ্রাবণী উঠার কারণ টা জানে তবুও জিগ্যেস করল,"কি কাজ আমি কি জানতে পারি।বিশেষ কেউ অপেক্ষা করছে কি"???
আমি নিশ্চুপ।কিছু না বলে উঠে পড়লাম।

শ্রাবণী কিছু বলতে চাইলো।
কিন্তু আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে রিকশায় উঠে পড়লাম।
রিক্সাওয়ালা মামা বলছে যে,"মামা কই যাইবেন"??
তাও তো ঠিক কোথায় যাব।হুদায় রিক্সার চড়লাম।
চানখারপুল চলেন।

আমার অনেক খারাপ লাগছে।
শ্রাবণী ক্যামনে পারলো এরকমটা করতে।
একয়দিন যে হিসেবে মিশেছে তাতে আমি ভেবেই নিয়েছি যে আমাদেরটা হয়ে গেছে।
আর তাছাড়া ওকে দোষ দিয়েই বা কি লাভ!!
পিতা-মাতা হীন মেয়ে।
হয়তো ওর খালা-খালু ভালো পাত্র পেয়েছে।সাথে সাথেই বিয়ে ঠিক করেছে।
কিন্তু আমার এত খারাপ লাগছে ক্যান।
হঠাৎই দেখি আমার চোখের কোণায় পানি।
পছন্দ করি,ঠিক আছে।কিন্তু সে তো কখনো করেনি।তার মানে এই না যে চোখে পানি আসতে হবে??
পুরুষ হিসেবে অত্যন্ত লজ্জার কথা।ভাগ্যিস কেউ দেখে ফেলেনি।

পরেরদিন ক্লাসে দেখলাম শ্রাবণী ঢ্যাংঢ্যাং করে সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে।বিয়ের জন্য যেন তড় সইছেনা।মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার।
আমাকে দেখে ঈষৎ ভালো মেয়ে সেজে বসে পড়লো।
চুপিসারে আমাকে জিগ্যেস করলো,
-কার্ডটা কেমন হইছে??
মনে মনে বললাম,"আমি তো মেয়াদ উত্তীর্ণ গাঁজা খাই যে ঐ কার্ড পড়বো"।
আমি নিশ্চিত ঐ কার্ড পড়লে আরেক দফায় কেঁদে ফেলব।
-বললাম অনেক ভালো হইছে।
-গাধা।
-আমি গাধা!!
আর তুমি তো মানুষ।ঠিক আছে।
-জ্বি।আমি মানুষই।
বলেই শ্রাবণী উচ্চস্বরে হাসি আরম্ভ করলো।
বিদঘুটে হাসি দেখতে খারাপ লাগছে।

রাতে খেতে নামবো।
দেখি শ্রাবণী ফোন দিচ্ছে।
৩ বার না ধরে চতুর্থ বারের বেলায় ধরলাম।
-কার্ড টা কেমন হইছে??
-ক্লাসেই না বললাম অনেক ভালো হইছে।
-ভেতরটা দেখছো??
-জ্বি দেখেছি।
-গাধা।
আর কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিল।

রুমে গিয়ে লুঙ্গি পড়বো।
এক ছোট ভাই বলছে,"ভাই মিমি কে?আপনার ক্লাসমেট"?
-না তো মিমি নামের তো কেউ নেই ক্লাসে।
-তো ভাই কার্ডে দেখলাম যে মিমির বিয়ে।
আমি ওর হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে ভালো করে দেখলাম এটা তো শ্রাবণীর বিয়ের কার্ড না।হতেই পারেনা।
কোথাও ওর নাম নেই।
আমার মনে পড়লো যে,মিমি তো শ্রাবণীর খালাতো বোন।
এই জন্য কি শ্রাবণী আমায় কার্ডের ভেতর টা দেখেছি কি না জিগ্যেস করলো!!!

তবে কি শ্রাবণী আমাকে পরীক্ষা করার জন্যই এই বিয়ের নাটকটা সাজিয়েছে।
ও কি তাহলে আমাকে....

দ্রুত মেসেঞ্জারে কার্ডের পিক তুলে রাগের ইমোজি পাঠিয়ে বললাম,
-এটার মানে কি শ্রাবণী??
-গাধা।
রাগে-ক্ষোভে ফোন কেটে দিলাম।আবেগ নিয়ে খেলা।ফাজলামির সীমা থাকা দরকার।

ক্লাসে শ্রাবণী আমার দিকে ভয়ে ভয়ে আড়চোখে তাকাচ্ছে।আর মুচকি মুচকি হেসেই যাচ্ছে।ওর মুখ থেকে যেন নিঃসৃত হচ্ছে,"গাধা"।
আমি ওর কাছে গিয়ে সাহস করে শ্রাবণীর হাতের উপর আমার হাতটা রাখলাম।
ও নিরীহ ভাবে একবার আমার দিকে তাকিয়ে হাতটা আলতোভাবে ছাড়িয়ে নিল।ওর ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি।
এ হাসির মানে শুধু আমিই বুঝি।।।

 

লেখকদ্বয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী 


সম্পাদক: ইসমাঈল হোসাইন রাসেল
যোগাযোগ: ক্যাম্পাস টাইমস
৪৩ শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক, হাটখোলা রোড, চৌধুরী মল, টিকাটুলি, ঢাকা-১২০৩
মোবাইল: ০১৬২৫ ১৫৬৪৫৫
ইমেইল:[email protected]