18485

প্রথম প্রেম

প্রথম প্রেম

2020-08-13 23:24:08

স্টিমারের শেষ সিটি বেজে উঠল। আমি শেষযাত্রী। সরু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই পারছিলাম না। হঠাৎ নীল শার্ট পরা এক তরুণ হাত বাড়িয়ে দিল। আমিও বেশ আয়েশেই স্টিমারে উঠে পড়লাম। বরিশাল শহর কাঁপিয়ে দাপুটে স্টিমার ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করল। আমার পরনেও নীল শাড়ি। নীল টিপ পরতেও এতটুকু ভুল হয়নি।

সজলের সঙ্গে আমার এভাবেই পরিচয়। ভীষণ সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে। চেহারা সপ্রতিভ উজ্জ্বল। ভেতরটা কোথাও নাড়িয়ে যায়। আচ্ছা, আমি কি এমন ম্যানলি, স্মার্ট কারোর জন্য প্রতীক্ষা করছি?

সাদা মেঘগুলো উড়ছে শরতের আকাশে। ওই দিগন্তে ছোট ঘরগুলো মায়া বিলাচ্ছে। নীল শাড়ি পরা আমি প্রকৃতির ভীষণ আহ্লাদে একটু ভিন্নমাত্রায় প্রকৃতির কন্যা হয়ে উঠেছি। মন বেশ ফুরফুরে, তবু সজলের চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। তাকাতে গেলেই ভেতরটা মোচড় দেয়। হঠাৎ কেঁপে উঠি। কিছু কম্পন আনন্দের।

আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমি ইংরেজি আর ও কেমিস্ট্রি। আমাদের একটা জায়গায় ভীষণ মিল। দুজনেই কবিতা পছন্দ করি। একটু আধটু লেখালেখিও করি। আমাদের মধ্যে সাহিত্য আড্ডা হয়। আমরা রিকশায় ঘুরি। গল্প, আড্ডায়, হাসি, গানে নিবিড় বন্ধু হয়ে উঠি। একটু আলাদা হলেই বিষণ্ন হয়ে পড়ি। এক ভিন্ন রকম অ্যাটাচমেন্ট। কী যেন নেই। কিছু হারিয়ে ফেলেছি কি? রোমান্টিকতা ভর করে, ‘ইন দ্য সাইলেন্স অব দ্য নাইট, আই ক্যান হিয়ার ইউ’—অথবা আজ একা একাই ভেজা চুলের ঘ্রাণ নেব। একপলকে নিজেকে দেখে ফেলার আনন্দও কম নয়।

হঠাৎ সজল কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল। বেশ চিন্তিত মনে হলো ওকে। শরীরটা কি খারাপ? বলতেই উত্তর এল, ‘রোজ রাতেই জ্বর আসে, সামান্যতেই হাঁপিয়ে উঠি’ বলতে বলতে নিজেই চুপ হয়ে গেল। একটা গাঢ় বিষণ্নতা মিহি দাগ গেল পাঁজরজুড়ে।

বিন্দু বিন্দু জল জমেছে চোখের কোনায়। একটু আগে একপশলা বৃষ্টি ক্যাম্পাসের সবুজ লতাগুল্মকে ভিজিয়ে দিয়েছে। অমন বৃষ্টিমাখা স্নিগ্ধ পরিবেশে সজলের হাতটি খুব শক্ত করে ধরতে ইচ্ছে করছে, খুব। অচেনা মনে হচ্ছে সজলকে। সে কি লুকাতে চাইছে কিছু? কিছু সম্পর্কে আড়াল রাখতে নেই।

বাড়ি যেতে হবে। মা ডেকে পাঠিয়েছেন। মধ্যবিত্ত সংসারের বড় মেয়েকে কখনো একটু আগেভাগেই মা-বাবা পাত্রস্থ করার চেষ্টা করেন। আরও দুটি মেয়ে রয়েছে। তাঁদেরও বিয়ে দিতে হবে। সুতরাং একজন চিকিৎসক পাত্র মা-বাবা হাতছাড়া করতে চাইবেন না। এটাই স্বাভাবিক।

আমার স্বামী চিকিৎসক শরীফ আহমেদ ক্যানসার হাসপাতালে কাজ করেন। আমি হোসেন আলী কলেজে ইংরেজি পড়াই। দুই বছরের ফুটফুটে মেয়ে ঐশ্বর্য আমাদের অন্তরে আলো ছিটিয়ে দেয়। আমরা হেসে উঠি। নতুন করে বেঁচে উঠি। নানা গল্পকথায় সজলও ভূমিকা রাখে। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ শুনতে গিয়ে শরীফকে বলি, জানো, আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু সজল গানটি ভীষণ ভালো গাইত। তা তোমার বন্ধু সজল কেমন আছে, কোথায় আছে, খোঁজ কি জানো? পুরোনো বইগুলো গোছাতে গোছাতে শরীফ জিজ্ঞাসা করে।

কত দিন হয়ে গেল সজলের খোঁজ জানি না। ট্রেনে হঠাৎ বন্ধু রাহুলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল গেলবার কক্সবাজার যাওয়ার সময়। সজলের কথা জানতে চাইতেই বলল, ওর শরীর ভালো নেই। কিছুদিন আগে ভেলরে ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজে গিয়েছিল চেকআপ করাতে। এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলতে পারল না রাহুল। বুকের কোথায় যেন চিনচিনে ব্যথাটি আবার একটু খোঁচা দিয়ে গেল। কত গহিন কষ্ট নীরবে বয়ে বেড়াতে হয়। সজল শুধুই বুকের বাঁ পাশে এক চিনচিনে ব্যথা! ইট পিনস মি অলটাইমস বাট আনফরচুনেটলি আই অনলি ক্যারি ইট! কিছু কষ্টের শেয়ার নেই। হয়ও না কোনো দিন। ট্র্যাজেডি লাইজ দ্যায়ার।

বিকেলে বাগানে বসে চা খাচ্ছিলাম। মিথিলা, এক অবাক কাণ্ড! লাং ক্যানসার নিয়ে একজন রোগী হাসপাতালে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অথচ তাঁর পাশে কেউ নেই। চায়ে চুমুক দিতে দিতে শরীফ বলতে লাগল। তা তুমি এই রোগীর কোনো ইনফরমেশন নাওনি, জানতে চাইতেই শরীফ বলল, বাড়ি মোহনপুর, নাম সজল মাহমুদ। ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, সে ভেলর ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নিয়েছে। হি ইজ ইন লাস্ট স্টেজ!

আমি চুপ থেকেছি। কী বলব বুঝতে পারিনি। ছাদে গিয়ে একা একাই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছি। শরীফ আঁচ করতে পেরেছে। পরদিন হাসপাতালে সজলকে দেখতে গিয়ে স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ হয়েছি। আমাকে চিনতে পেরেছে। কথা আর বলেনি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে। আই হ্যাভ লস্ট মাই ওয়ার্ডস, ট্রাইড টু ক্লোজ টু হিম বাট কান্ট! জীবন আচমকা ভিন্ন মোড় নেয়। যে পথ ধরে হাঁটতে চাই, প্রকৃতি এমন দেয়াল এঁটে দেয়; এক পুঁটলি হাতে ওই নন্দ ঘাটে অনন্ত খেয়ার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ‘ম্যান প্রপোজেস বাট গড টু ডিসপোজেস!’

শহরজুড়ে মাতাল বৃষ্টি। খুব করে নিজেকে ভিজিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু বুকের কোনায় চিনচিন ব্যথাটুকু কিছুতেই কমছে না। কিছু ক্ষতের ব্যান্ডেজ নেই। হয়ও না কোনো দিন। একসঙ্গে থাকার জীবনেও কেউ কাউকে পুরোটা পায় না। সজলের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না। নিজেকে দেখতে গিয়ে হয়তো তাঁর সঙ্গে দেখা হবে একদিন, প্রতিদিন। প্রথম প্রেমের সঙ্গে বারবার দেখা হয়।

মুক্তা মাহমুদা, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র || প্রথম আলো

সম্পাদক: ইসমাঈল হোসাইন রাসেল
যোগাযোগ: ক্যাম্পাস টাইমস
৪৩ শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক, হাটখোলা রোড, চৌধুরী মল, টিকাটুলি, ঢাকা-১২০৩
মোবাইল: ০১৬২৫ ১৫৬৪৫৫
ইমেইল:[email protected]