জীবনের অকপট ও অন্তরঙ্গ বয়ানে বারট্রান্ড রাসেল
2021-03-12 10:20:22
লীনা দিলরুবা
রাসেল-এর আত্মজীবনী-‘দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব বার্ট্রান্ড রাসেল’কে পৃথিবীর ইতিহাসে এ-পর্যন্ত লিখিত আত্মজীবনীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনী বলা হয়ে থাকে। ১৯৫০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
তাকে বিশ্লেষণী দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়। জীবনের আলোকিত দিকের গুণকীর্তন কেবল নয়, নিজের জীবনের অন্ধকার দিকের কথা রাসেল তাঁর আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। বয়ঃসন্ধিতে শারীরিক পরিবর্তনের যে অভিজ্ঞতা সেটি তাঁর মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। স্ব-মেহনের অভ্যেস বিশ বছর পর্যন্ত বজায় রেখে তিনি মনে মনে পুড়তেন। এটি বন্ধ করার অভিপ্রায়ের কথাও বলেন। যখন প্রেমে পড়েন তখন অভ্যেসটি বন্ধ হয়ে যায়। নারী শরীরের প্রতি অতি আগ্রহ কমিয়ে আনতে নানা কায়দা-কানুনের আশ্রয় নিতেন। কিন্তু এক সময় এসব নিয়ে মনোযাতনায় ভুগলেও বিষয়গুলিকে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান অর্জন ধারণা করে মানসিক ব্যাধিগ্রস্ততা বলে মনে করতেন না।
নারী শরীরের প্রতি মোহমুগ্ধতার কারণেই কবিতার প্রেমে পড়ে যান। ষোল-সতের বছর বয়সেই মিলটন, বায়রন, শেলীর কবিতা পড়ে শেষ করেছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করা এই মহান দার্শনিক ৯৭ বছর আয়ু পেয়েছিলেন।
পিতামহ লর্ড জন রাসেল দু’বার ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন। বয়স পাঁচ না গড়াতেই রাসেল তাঁর মা-বাবা দু’জনকেই হারান। তাঁর নিজের বিবাহিত জীবন ছিল ঘটনাবহুল। ১৮৯৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে বিয়ে করেন এ্যালিস পিয়ারসলকে। ১৭ বছর পর বিচ্ছেদ ঘটে সেই বিয়ের। দ্বিতীয় স্ত্রী ডোরা উইনফ্রেড ব্ল্যাক। এটিও টেকেনি। বিয়ের ১৪ বছর পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দু’জনার। ১৯৩৫ সালে বিয়ে করেন প্যাট্রিসিয়া স্পেন্সকে। এটিই শেষ নয়। চতুর্থ বারের মত বিয়ের টোপর পরেন ৮০ বছর বয়সে। বিয়ে করেন এডিথ ফিন্সকে। এ-বিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত, মানে ৯৭ বছর বয়স পর্যন্ত টেকে। ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি আগ্রহ ছিল অনেক। প্রচণ্ড ভাবুক ছিলেন। ষোল বছর বয়সের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, একাকী ঘুরে বেড়ানোর প্রতি আকর্ষণ ছিল তাঁর। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে তাঁর যখন-তখন আত্মহত্যা করার ইচ্ছে জাগতো।
তিনি আত্মহত্যা করেন নি, কারণ, গণিত সম্পর্কে তাঁর জানার আকাঙ্ক্ষা অটুট ছিল। জীবনীগ্রন্থের শেষ প্যারায় নিজের জীবনের ব্যর্থতাগুলোকেও নিজের অর্জন বলেই স্বীকার করেছেন। তাত্ত্বিক সত্যকে কখনো কখনো অস্বীকার করলেও অন্য এক ধরনের সত্যকে তিনি নিজের জীবনের পাথেয় করে নিয়েছিলেন। জীবন যাপনে ব্যক্তিগত লক্ষ্য এবং সামাজিক লক্ষ্য দুই-এর মাঝে আনুপাতিক সমঝোতা স্থাপনের মাধ্যমে একটি সফল জীবন কাটানোর জন্য তাঁর তৃপ্তিবোধের কথা তিনি উল্লেখ করেন। ১৯৬৯ সালে লেখা তাঁর আত্মজীবনীর শেষপ্রান্তে তিনি সেই সময়ের সমাজকে বিপজ্জনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন- নতুন নতুন চিন্তা, আশা, নতুন ধরনের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা থাকলেও তার ওপর নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা খুবই প্রয়োজন। পুরো আত্মজীবনীতে অসংখ্য পত্রাবলী জুড়ে দেয়া হয়েছে। এসব চিঠি পড়ে রাসেলকে গভীরভাবে জানার সুযোগ ঘটে। ছিলেন একজন নীতিনিষ্ঠ মানুষ।
আজকের পৃথিবীতে স্বল্প জ্ঞানকে পুঁজি করে বিখ্যাত হবার যে প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়, সেদিক বিবেচনায় নিলে রাসেল ছিলেন একজন আশ্চর্য ব্যতিক্রম। তিনি বিখ্যাত সব গ্রন্থেরও রচয়িতা। ‘দ্য প্রিন্সিপালস অব ম্যাথম্যাটিকস’, ‘হিস্ট্রি অব ওয়েস্ট্রার্ন ফিলোসফি’, ‘দ্য কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’, ‘ম্যারিজ এন্ড মরালস’, ‘হোয়াই আই এ্যাম নট এ খ্রিশ্চিয়ান’ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘ম্যারিজ এন্ড মরালস’ বইটি পাঠের সুযোগ আমার হয়েছে। এত আধুনিক চিন্তাধারা ছিল তাঁর, বইটি পড়তে গিয়ে প্রথাগত জীবনের নানা আচারের অর্থহীনতায় মানুষ ভাবতে বসবে, কী করছি? বইটি সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়া যাক।
রাসেল বলেছেন, একালের নৈতিকতার উৎস দুটি; পিতৃত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হবার আকাঙ্ক্ষা এবং যৌনতা সম্পর্কে খারাপ ধারণা। রাসেল অবাধ যৌনতাকে খারাপ বলে চিহ্নিত করেন নি। কিন্তু একইসাথে তিনি আত্মসংযমের কথাও বলেছেন। এক্ষেত্রে আবার সংযমের সঙ্গে যেন ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধ না ঘটে সেটাও তিনি নিশ্চিত হতে বলেছেন। বিবাহের মূল লক্ষ্য সন্তান পালন- এটা রাসেলের মতামত। সন্তান পালনের ব্যাপারটা না থাকলে তিনি বিবাহের পুরোই বিরোধী হতেন বলে জানিয়েছেন। পৃথিবীজুড়ে আদি থেকে গঠিত বৈবাহিক সম্পর্ক, পারিবারিক সম্পর্ক, ক্ষমতা, প্রেম, নৈতিকতা নিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন রাসেল।
যিনি একাধারে দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিজ্ঞ, নীতিবিশারদ এবং ইংরেজি সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক ছিলেন। তাঁর মতে: ১. মাতৃতান্ত্রিক সমাজ আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চিত্র দেখাতে গিয়ে তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে সব সমস্যার মূল রূপে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, ঈর্ষা ব্যাপারটা যে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে অত্যন্ত প্রবল তার কারণ এই ভীতি যে, উত্তরপুরুষ যদি তার ঔরসজাত না হয়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার সূচিত হবার পর থেকে পুরুষরা নারীর কৌমার্য অটুট রাখা নিয়ে মনোযোগী হন। বিবাহের বাইরে যৌনসঙ্গম অন্যায় বলে পরিগণিত হবার পর পরপুরুষের সঙ্গে সহবাসকে সহজভাবে দেখানোর অবসান হয় বলে তিনি জানান।
আজকের দিনেও চীনে পুত্রবধুরা শাশুড়ির অত্যাচারে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথার কারণেই। ফ্রান্সে পাত্র ক্রয় করার নিয়ম ছিল। রোমান ক্যাথলিকরা বিবাহ বিচ্ছেদ একেবারে অনুমোদন করে না। প্রাচীন চীনে আইন ছিল স্ত্রী বাচাল প্রকৃতির হলে স্বামী তাকে তালাক দেবার অধিকার পাবে। ২. মাতৃতান্ত্রিক সমাজ তাঁর পছন্দের। রাসেল বলেছেন, ট্রবিয়ান্ড দ্বীপের লোকেরা পিতা নামক কোনো বস্তুর অস্তিত্ব জানতো না। এক্ষেত্রে তিনি চমৎকার একটি তথ্য দিয়েছেন। সে দ্বীপের কোনো লোকের স্ত্রী যদি অন্য কারো সন্তান গর্ভে নেন তবে সে লোক তাতে কিছুই মনে করে না, বরং খুশী হত। সতীত্ব শব্দটার অর্থই তাদের জানা নেই। ৩. সংসারে সন্তান আসার পর স্বামী-স্ত্রীর সুসম্পর্ক রাখা জরুরী বলে তিনি মনে করেন। এজন্য আত্মসংযম দরকার হলে সেটা মেনে নিতে তিনি পরামর্শ দেন।
শুধু অবিশ্বস্ততা নয় হিংসা, ক্রোধ, বদমেজাজকে সন্তানের জন্য বিসর্জন দিতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। পিতা-মাতার মধ্যে কলহ হলে সন্তানের স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ে। পিতা-মাতার ঝগড়ার ঘটনা সন্তানদের কাছে গোপন রাখতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। এ-জন্য বিবাহ টেনে না নিয়ে বিচ্ছেদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একটি নিছক ব্যক্তিগত জীবন কাটানোর জন্যই মানবজীবন নয়। বৃহত্তর কল্যানের সঙ্গে নিজের জীবনের মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, যা কিছু চিন্তায়, কর্মে এবং বইতে লিপিবদ্ধ করে যাওয়া প্রয়োজন, রাসেল তার কোনোটিরই কমতি করেন নি।
আত্মজীবনীর শেষে তিনি লিখেছেন, “আমার সামাজিক লক্ষ্য ছিল- যা কিছু মহৎ, যা সুন্দর, যা প্রশান্তিময় সেটার জন্যই তৎপর হওয়া; অন্তর্দৃষ্টির মুহূর্তগুলোকে পার্থিব জগতের মুহূর্তেও জ্ঞানসঞ্চার করতে দেওয়া। আমার সামাজিক লক্ষ্য ছিল- কল্পনায় এমন একটা সমাজকে দেখা যা আমাদের গঠন করতে হবে, যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে গড়ে উঠতে পারবে এবং যেখানে ঘৃণা, লোভ আর ঈর্ষা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে, কারণ এগুলো পরিপুষ্ট করার মত কিছুই সেখানে থাকবে না। এসবেই আমার বিশ্বাস এবং জগতের এতসব বীভৎসতা সত্ত্বেও আমার এই বিশ্বাসে আমি এখনও অটল।” ইংরেজি থেকে তিনখণ্ডের জীবনী গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিল ‘জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ।’ অনুবাদকদ্বয়- পান্নালাল চৌধুরী ও সম্পদ বড়ুয়া বাংলা অনুবাদে কিছু ক্ষেত্রে আড়ষ্ট হলেও অনেকটাই উত্তীর্ণ।