22042

ছোটবেলার ঈদ স্মৃতি

ছোটবেলার ঈদ স্মৃতি

2021-05-14 16:58:21

ছোটবেলার ঈদ স্মৃতি
কে এম নেছার উদ্দিন
বিএএফ শাহিন কলেজ.তেজগাঁও, ঢাকা

ঈদ শব্দটা শুনলেই মনে আনন্দ লাগে। হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। এ শব্দটা আনন্দের আলাদা মাত্রা বহন করে। যে মাত্রা অন্য কোনো শব্দে রয়েছে বলে আমার মনে হয় না। মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ আনন্দ আয়োজন হলো ঈদ উৎসব। ঈদ মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব হলেও জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষ এ উৎসবে শামিল হয়। সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যে যার সাধ্যমতো খুশিতে মেতে ওঠে। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে মাত্র দুটি দিন মুসলিম ধর্মের এ উৎসবের নাম ঈদ। এর একটি ঈদুল ফিতর ও অপরটি ঈদুল আযহা। উৎসব দুটির পেছনে রয়েছে মুসলিম ধর্মের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণমুখী কাজ ও ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমা।

ঈদ ছোট-বড় সবার কাছে সমান গুরুত্ব বহন করে। শৈশব, কৈশোর, যুব, বৃদ্ধ কোনো বয়সেই ঈদের খুশির আলাদা পার্থক্য থাকে না। সবার মনে ঈদের আকর্ষণ কাজ করে। ঈদ মনকে দেয় আলাদা সতেজতা। ছোট-বড় সবাই যার যার অবস্থান থেকে ঈদকে হৃদয়ে গেঁথে নেয় এবং সকলের সাথে সমানতালে বিনোদনে শামিল হয়। তবে সবার জীবনই শৈশব দিয়ে শুরু। তাই শৈশবের ঈদ হৃদয়ে আলাদা জায়গা করে নেয়। শৈশব বলতে আমি সাধারণত বুঝি জন্মের পর থেকে বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে। অনেকে আবার শৈশবকে ১৫/১৮/২১ বছর বয়সে বিভাজনও করে থাকেন। অবশ্য দেহের গ্রোথ ও লিঙ্গবেধে বয়ঃসন্ধি শুরু হওয়ার তারতম্যও রয়েছে। কিন্তু আমার মতে বয়ঃসন্ধি শুরু হওয়া মানেই কৈশোরে পা রাখা। অর্থাৎ একজন মানুষ নিজের সম্পর্কে জ্ঞান অনুধাবন করাই মানে সে কৈশোর। আর তা বয়ঃসন্ধি শুরু হওয়া থেকেই সে তার শৈশব জীবন শেষ করলো।

প্রত্যেক মানুষের জীবনেই শৈশবের ঈদের স্মৃতি রয়েছে। পরিবেশ, অবস্থা ও পরিবারবেধে এই স্মৃতিতেও আছে তারতম্য। আমি গাঁয়ের ছেলে। শহরের ঈদের চেয়ে গ্রামের ঈদে শৈশব কাটানো আমার হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। গ্রাম্য পরিবেশে শৈশবের ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার যতটুকু বিনোদন ছিলো আর বর্তমানে যা যা মনে আছে, তার সবটুকুই এ লেখায়।


রোজা রাখা : শৈশবের রোজা রাখার বিষয়টি খুবই আনন্দের। ইসলামে যদিও বালেগ বা ১২ বছরের পর হতে রোজা ফরজ করা হয়েছে, তথাপি তার আগে থেকেই রোজা রাখতাম। ৫/৬ বছর বয়স হতে রোজা রাখতাম। রোজা নিয়ে অনেক মধুর স্মৃতি রয়েছে। বয়স কম বলে রাতে সাহরি সময় উঠাতো না। বাবা-মা যখন সাহরি খাওয়া শুরু করতেন তখন বিছানায় এদিক-ওদিক মোড়ামুড়ি করতাম, আমিও ভাত খাবো বলে কান্না করতাম, প্রস্রাবের ভান করে জেগে যেতাম। এভাবে সাহরি খেতে উঠতাম। বাবা-মায়ের শর্ত ছিলো খাও, তবে ভেঙ্গে-ভেঙ্গে রোজা রাখবা। আবার জ্ঞান দিতো ছোটরা দিনে ২/৩টা রোজা রাখতে হয়। সব শর্ত মেনেই খেতাম। তবে দিনে রোজা কিন্তু একটাই রাখতাম। এভাবেই ৬/৭ বছর বয়সে রোজা রাখার অভ্যাস করে ফেলি।

নতুন জামা কেনা : ছোট বয়সে ঈদ আসলেই নতুন জামা কেনার জন্যে পাগল হয়ে যেতাম। বাবাকে নতুন জামার অর্ডার দিতাম। নতুন জামা ছাড়া যেনো ঈদ হবেই না। বাবার সাথে মার্কেটে যেতাম। পছন্দ মতো জামা, জুতা কিনে নিয়ে আনতাম। বাড়ির সমবয়সীদের রাতেই ঈদের জামা দেখাতাম। এতে খুব আনন্দ লাগতো।

সেমাই বানানো : ঈদে গ্রামে সেমাই ছিলো প্রচলিত রেওয়াজ। ঈদের আগে প্রত্যেক ঘরে ঘরে সেমাই বানানোর হিড়িক লেগে যেতো। টিউবওয়েলের মতো দেখতে একধরনের সেমাই মেশিন ছিলো। দুই/তিন বাড়ি মিলে একটা মেশিন সেমাই বানানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। প্রায় সাত/আট দিন ঘুরে সিরিয়াল আসলে মেশিন পেতাম। বাড়ির উঠোনে বিছানা বিছিয়ে পাশে চেয়ারে মেশিন রেখে সেমাই বানাতাম। মেশিনের হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেমাই বানাতাম। বড়জন'রা হাতল ঘুরাতো, মা সেমাই মেশিন থেকে নিয়ে বিছানায় ছিটিয়ে দিতেন। বাড়ির এ ঘরের পর ও ঘর প্রতিযোগিতা দিয়ে সেমাই বানাতাম। ঈদের দিন বানানো সেমাইয়ের প্রতি ছিলো বেশি আকর্ষণ। অবশ্য বর্তমান সময়ের মত সে সময়ে বাজারে এতো সেমাই বিক্রি হতো না।

...

ঈদকার্ড বিনিময় : ঈদ আসলেই ঈদকার্ড ছিলো একটা বিশেষ অর্ডিনারী বিনোদন। ঈদকার্ড ছাড়া তখন ঈদ মাটি মাটি লাগতো। ঈদের ১০/১৫ দিন আগেই স্কুলের বন্ধুদেরকে ঈদকার্ড দিয়ে দিতাম। বন্ধুরাও আমাকে দিতো। বাজারে কেনা ঈদকার্ডের চেয়ে নিজে বানানো ঈদকার্ডটাতেই বেশি বিনোদন পেতাম। বিশেষ করে ক্যালেন্ডারের পাতা কিংবা ভারি কাগজে জরি ও রং করে ঈদকার্ড বানাতাম। তাতে ধান, পুঁতি, মেচের শলাকা দিয়ে ঈদ মোবারক লিখতাম।

ঈদের চাঁদ দেখা : ঈদের চাঁদ না দেখলে আনন্দে শতভাগ পূর্ণতা আসতো না। ২৯ রোজা শেষ হলেই ইফতার সেরে দৌড় দিতাম চাঁদ দেখতে। দেখা না ফেলে ৩০ রোজা রাখতাম। তারপর চাঁদ দেখতাম। এমনও হয়েছে চাঁদ দেখার জন্যে গাছে উঠে যেতাম। এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি দিয়ে পশ্চিমের আকাশে চাঁদ খুঁজতাম। আবার কখনো মসজিদের গম্বুজের ফিলারের উপরে উঠে চাঁদ খুঁজতাম। আর ঈদুল আযহার চাঁদ দেখার জন্যে আরবি জিলকদ মাসের শেষ তারিখে জিলহজ মাসের চাঁদ দেখতাম। তারপর জিলহজ মাসের ৯ তারিখ সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখতাম। চাঁদ দেখা নিশ্চিত হলে ছোট-বড় সবাই মিলে খুব আনন্দ করতাম। আবার ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক স্লোগানে মিছিলও বের করতাম।

মেহেদী লাগানো ও আতশবাজি খেলা : ঈদের চাঁদ দেখে ঈদ নিশ্চিত করার পর আতশবাজি খেলায় মেতে উঠতাম পাড়ার সবাই মিলে। আর রাত জেগে হাতে মেহেদি লাগাতাম। শৈশবের মেহেদি আর বর্তমানের মেহেদি এক মেহেদি নয়। তখন মেহেদি গাছের মেহেদি নারিকেল পাতার শলা দিয়ে হাতে লাগাতাম। আর এখন সবাই কেমিক্যালের তৈরি মেহেদি লাগায়। মেহেদি লাগানোর জন্যে বাড়ির আন্টি বা ভাবি কিংবা আপুদের বাসায় বাড়ির সব পোলাপান গিয়ে ভিড় জমাতাম। সিরিয়ালে একের পর এক লাগাতে লাগাতে ভোর রাত হয়ে যেতো। তারপর বাসায় ফিরলে মায়ের বকুনিও শুনতে হতো। আমি কয়েকবার মাইরও খেয়েছি।

দোকান দেওয়া : শৈশবে ঈদের দিন ব্যবসায়ী হতাম। আগের দিন বাঁশের শাখা ডাল, কদম গাছের ডাল ও পাতা, নারিকেল পাতা, সুপারি পাতা, কলা পাতা ইত্যাদি দিয়ে বাড়ির সামনে দোকান বানাতাম। ১০০-২০০ টাকার পুঁজি নিয়ে বাজারে যেতাম। চকলেট, চানাচুর, বাদাম, আচার, রাজা কনডম, বাঁশি ইত্যাদি কিনে আনতাম। ঈদের দিন দোকানে তা বিক্রি করতাম। আবার বাড়িতে মাকে দিয়ে চালতার আচার, আমড়ার আচার, আলুর দম বানায়ে তাও দোকানে বিক্রি করতাম। পুঁজির স্বল্পতা থাকলে ব্যবসায়ে আবার পার্টনারও নিতাম। ঈদের নামাজের আগে ও পরে সব বিক্রি হয়ে যেতো। ৫০-১০০ টাকা লাভও হতো। ব্যবসাটি খুব আনন্দে করতাম।

ঈদগাহে যাওয়া : ঈদের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতাম। গোসল করে নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদগাহে যেতাম। বাড়ির সব সমবয়সীরা মিলে ঈদগাহে খুব আনন্দ করতাম। ঈদের নামাজ আদায় করে কোলাকুলি করতাম।কোলাকুলিতে কি যে মজা হতো।

সালামি নেওয়া : ঈদে সালামি পাওয়ার জন্যে উদগ্রীব থাকতাম। তখন ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা সালামির প্রচলন ছিলো। ঈদের নামাজ শেষ করে ঈদগাহেই বাবার কাছে সালামি চাইতাম। বাড়ির চাচা, জেঠা, বড় ভাই, বড় বোন, এলাকার বড়দের কাছে সালামি চাইতাম। অনেক সময় পা ছুঁয়ে সামাল করেও সালামি আদায় করতাম। সালামির টাকা মায়ের কাছে জমা রাখতাম।

বিটিভির ঈদ আয়োজন: ঈদ আসলে বিটিভির ঈদ আয়োজন দেখার জন্য মনে আলাদা বিনোদন কাজ করতো। তখনকার সময়ে এখনকার মতো কোনো স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ও ডিস ছিলো না। শুধু বিটিভি ছিলো। তাও অ্যান্টেনা সিস্টেম। সবচেয়ে বড় কথা হলো দুই-চার বাড়ি খুঁজলে একটা টিভির দেখা মিলতো। ঈদে টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা ও সিনেমা দেখাতো। আশপাশের ঘরের ও বাড়ির বাচ্চা-কাচ্চারা ঈদের সিনেমা দেখতে টিভির ঘর খুঁজতো। আমিও এমনটা করতাম। অনেক টিভিওয়ালারা আবার বেশি মানুষ পছন্দ করতো না, তাই তারা ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতো। তখন ঘরের জানালা বা বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখতাম। কোনো রকমে ঘরের ভেতর ঢুকতে পারলে মাটিতে বিছানায় বসে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে টিভি দেখতাম। কাহিনি দেখার পর নেশা লেগে যেতো, তারপরেও সিনেমা বা অনুষ্ঠান শেষ না করে আসতাম না। মাঝে মাঝে টিভি ঝিরঝির করলে অ্যান্টেনার বাঁশ ধরে এদিক-ওদিক ঘুরাতাম। আর বলতাম, 'ঠিক আছে নি? হইছে নি? আসছে নি?' তারপরেও ঈদ বিনোদন মিস করতাম না।

নানুর বাড়ি যাওয়া : শৈশবের ঈদ মানেই নানুর বাড়ি বেড়াতে হবে। এটা শৈশবের ঈদ সংস্কৃতির অংশ। ঈদের পর দিনই চলে যেতাম নানুর বাড়ি। নানুর বাড়ী গিয়ে নানা,নানু,মামা,মামাতো ভাই-বোনদের সাথে অনেক মজা হতো। স্কুল ছুটি শেষ হওয়ার আগের দিন চলে আসতাম।

ঘুরে বেড়ানো : ঈদের পর বিনোদন হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো ছিলো শৈশবের ঈদ বিনোদনের অংশ। সহপাঠীদের সাথে নানান জায়গায় ঘুরতে যেতাম। ঈদের খুশিকে কেন্দ্র করে তখনকার সময়ে গ্রামে নাটক ও যাত্রাপালার আয়োজন হতো। সহপাঠীদের সাথে চলে যেতাম তা দেখতে। তখনকার যাত্রা বা নাটকের একটা অংশ এখনো স্মৃতিতে রয়েছে। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটা স্কুল মাঠে ছিলো সেই আয়োজন। যাত্রা বা নাটকের কথা মনে না থাকলেও ওই অংশটুকু খুব মনে পড়ে। নায়কের কণ্ঠের সেই অংশটুকু হলো_'ভানু, ও ভানু, ভানুরে... অ্যাই যাইয়ুম ঢাহার শহর তোরলেই কী অ্যাইনগুম ? এভাবে মজা হতো প্রতিটি ঈদে।

শৈশবের ঈদ-স্মৃতি লেখতে গেলে এর যেনো শেষ নেই। আমাদের জীবনে শৈশব আর কখনোই ফিরে আসবে না। এটা কালের বিবর্তনেরই অংশ। বর্তমানে যে যার অবস্থানে আছি সবার মাঝেই কমবেশি শৈশবের স্মৃতি রয়েছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে শৈশবের সেই স্মৃতিগুলো স্মৃতিচারণ করতে পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পুরোনো সংস্কৃতিকে হৃদয়ে লালন করে আগামীর অপসংস্কৃতি থেকে দূরে থাকতে পারবে। শৈশবের ঈদ-স্মৃতি খুব মনে পড়ে। এখন কেমন যেনো সব আনন্দেই ভাটার টান। আগের মতো করে আর আনন্দ হয় না ঈদে।

বাস্তবতার চাপে সবই যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় ভালো ছিলো আমাদের ছোটবেলা! এখন আর ছোটবেলার মতো আবেগ নেই। সবকিছুই মনে হয় যান্ত্রিক, আবেগহীন ও অনুভূতিশূন্য।তবুও জীবনের তাগিদে এভাবে শৈশব কৈশোর ঈদ হারিয়ে যায়। ঈদে বয়ে আনুক শান্তি সৌন্দর্য একত্রিত সমাজ।

সম্পাদক: ইসমাঈল হোসাইন রাসেল
যোগাযোগ: ক্যাম্পাস টাইমস
৪৩ শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক, হাটখোলা রোড, চৌধুরী মল, টিকাটুলি, ঢাকা-১২০৩
মোবাইল: ০১৬২৫ ১৫৬৪৫৫
ইমেইল:[email protected]