পহেলা বৈশাখ: হালখাতা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা
2024-04-13 23:46:25
মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর ছিল। তৎকালীন বাংলায় কর আদায় সহজ করার জন্য সম্রাট আকবরের নির্দেশে জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ সিরাজী চন্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তর করেন। এর ভিত্তিতে সম্রাট আকবর ৯৯২ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। কিন্তু সম্রাট আকবর তার সিংহাসনে আরোহণের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এ জন্য ৯৬৩ হিজরি সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরি সালের মহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস। এ জন্য বৈশাখ মাস বঙ্গাব্দ বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১ বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। সুতরাং বলাই বাহুল্য যে বাংলা সন তথা নববর্ষের মূল লক্ষ্য ছিল কর বা ফসলের খাজনা আদায় সহজসাধ্য করা।
পহেলা বৈশাখকে উপলক্ষ করে সুদীর্ঘকাল আমাদের বাংলা অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পুরনো পাওনার হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে নতুন হিসাব খোলার জন্য যে খাতার প্রচলন করেন সেটি হালখাতা নামে অভিহিত হয়। হালখাতা উৎসবে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনাদারদের মিষ্টিমুখ করার ব্যবস্থা রাখেন। ব্যবসায়ীরা সম্পূর্ণ বকেয়া পাওনা আদায়ের উদ্দেশ্যে এ উৎসবের আয়োজন করলেও দেনাদাররা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী দেনা পরিশোধ করে থাকেন।
এরপরে বঙ্গাব্দ প্রচলন পরবর্তী সুদীর্ঘকাল থেকে গ্রামবাংলায় ঐতিহ্যগতভাবে পহেলা বৈশাখ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এসব মেলায় আসবাবপত্রসহ গৃহস্থালি ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত পণ্যের বিপুল সমারোহ দেখা যায়। এর বাইরে মেলায় মাটি, বাঁশ ও কাঠের তৈরি বিভিন্ন ধরনের খেলনা এবং বিভিন্ন ধরনের মিষ্টিজাতীয় খাবার যেমন জিলাপি, বাতাসা, কদমা, মুড়ি ও চিঁড়ার মোয়া, গুড় মিশ্রিত খই, খাজা, গজা এবং দেশীয় ফলফলাদি প্রভৃতির পসরা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
এছাড়াও মেলায় থাকতো কাঁচের চুড়ি, রঙ-বেরঙের ফিতা, তাঁতের শাড়ি, নকশা করা হাতপাখা, কামার ও কুমারের দোকান, মুড়ি-মুড়কি-খই, সন্দেশ, বাতাসা, মিষ্টি, মাটির তৈরি খেলনা, পুতুল, ঘুড়ি, নাটাই, গুলতি, অলংকার, তৈজসপত্র, বেলুন, বাঁশি, ফলমূল ইত্যাদি। আর বিনোদনের জন্য থাকতো নাগরদোলা, বায়োস্কোপ, জারি-সারি-ভাটিয়ালি গানের আসর, কবিগান, ষাড়ের লড়াই, লাঠিখেলা, পুতুল নাচ, নৌকা বাইচ, কুস্তি খেলা ইত্যাদি। কিন্তু কালের বিবর্তনে এসব জিনিস হারিয়ে গেছে। এবং পরিকল্পিতবাবে পুঁজিবাদী কোম্পানিগুলোর তথাকথিত আধুনিক পণ্য ও জুয়া স্থান করে নিয়েছে। এছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতি ক্রমে শহরমুখী হয়ে উঠলে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ করে শহরের বিভিন্ন স্থানে এরূপ মেলার আয়োজন প্রত্যক্ষ করা যায়। এরূপ মেলায় উল্লিখিত খাবার ছাড়াও চটপটি, ফুসকা, বিভিন্ন ধরনের পিঠা, খিচুড়ি, বিরিয়ানি, বিভিন্ন ভর্তাসমেত পান্তা-ইলিশ প্রভৃতির সমারোহ পরিলক্ষিত হয়।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম আনন্দ শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। পূর্বে এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। সেই সময়ের সংবাদপত্রের খবর থেকেও এমনটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে। পরবর্তীতে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
শোভাযাত্রাটিতে প্রথম হতেই যেসব প্রতীক ব্যবহৃত হয়ে আসছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্যাঁচা, বাঘ, সিংহ, ময়ূর, ইঁদুর, হাতি, হাঁস, ষাঁড়, প্রজাপতি, সূর্য, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ ও মঙ্গলপ্রদীপ। এসব প্রতীকের প্রতিটি হিন্দুধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী প্যাঁচা হলো ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর বাহন, দেবী দুর্গার বাহন হচ্ছে বাঘ ও সিংহ। এই ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দেব সেনাপতি কার্তিকের বাহন হচ্ছে ময়ূর। হিন্দুধর্মীয় দেবতা দুর্গার ছেলে গণেশের বাহন হচ্ছে ইঁদুর। ধর্মীয় শাস্ত্র মতে, গণেশের মুখায়ব হাতির সদৃশ, হাঁস হচ্ছে বিদ্যাদেবী সরস্বতীর বাহন। হিন্দুধর্মীয় দেবতা শিবের বাহন হলো ষাঁড়। হিন্দুধর্মীয় রীতি ও সংস্কৃতি অনুযায়ী প্রজাপতি হলো বিয়ের দেবতা। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে সূর্যকে বলা হয় সৌর দেবতা। শোভাযাত্রায় যেসব মুখোশ ব্যবহার হয় সেগুলো মানুষসহ দৈত্যদানব ও বিভিন্ন জীবজন্তুর প্রতিচ্ছবি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মঙ্গল ও শুভকামনায় প্রদীপ জ্বালিয়ে যে বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয় সেটিকে বলা হয় মঙ্গলপ্রদীপ।
অপর দিকে এইগুলো মুসলিমধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কহীন। অথচ বাঙালি সংস্কৃতিতে এক সময় ধর্মীয় প্রতীকসমূহ ব্যবহার হতো না। কেবলমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় ও বাড়ির প্রয়োজনীয় মাটির তৈজসপত্র প্রধান আকর্ষণ ছিল। হালখাতার মাধ্যমে পুরোনো হিসাব-নিকাশ নিস্পত্তি, মিঠাই-মণ্ডা ও পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ ছিল এ উৎসবে প্রধান লক্ষ্য। হালখাতার মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক আরো গাঢ় হতো। কিন্তু সে হালখাতা এখন রীতিমত জাদুঘরে চলে গেছে ।
মঙ্গল শোভাযাত্রার যারা আয়োজক এবং এই শোভাযাত্রায় যারা অংশ নেন তারা সব সময় নিজেদের অসাম্প্রদায়িক এবং উৎসবটিকে সর্বজনীন দাবি করেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় দেশের বৃহত্তর ধর্মগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনুপস্থিতিতে মঙ্গল শোভাযাত্রাই কেন একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় সংস্কৃতির দেবদেবীর বাহন হিসেবে ব্যবহৃত প্রাণীগুলোর প্রতীকের উপস্থিতিই কেন লক্ষ্য করা যায়।
লেখক
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ময়মনসিংহ।