মাধ্যমিক স্তরের পড়ালেখায় আর বিভাগ থাকছে না। নতুন শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা হবে। ফলে এখন থেকে আর নবম শ্রেণিতে থাকবে না বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শাখার আলাদা বিভাগ।
ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিষয় নির্বাচন করতে পারবে শিক্ষার্থীরা। ইচ্ছামতো বিষয় নির্বাচনের মাধ্যমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করবে। এইচএসসি স্তরে গিয়ে বিষয় নির্বাচন করে পড়তে হবে।
এই প্রস্তাব মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের। তারা জেএসসি ও এসএসসিতে পরীক্ষার বিষয় কমানোরও প্রস্তাব দিয়েছেন। তাদের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিষয়টি স্বীকার করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-১) চৌধুরী মুফাত আহমেদ বলেন, শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। শিক্ষাবিদরা ইতিবাচক মত দিয়েছেন। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। শিক্ষাবিদদের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে অনেকগুলো বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা কমবে। শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রসঙ্গত, মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিতে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয় গত বছর। কমিটির সদস্যদের নিয়ে গত বছর ২৫ ও ২৬ নভেম্বর কক্সবাজারে দুই দিনের আবাসিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শিক্ষাবিদরা বেশ কিছু সুপারিশ করেন। সুপারিশ বাস্তবায়নে কয়েকটি সাব-কমিটিও গঠন করা হয়। সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে গত ৩০ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ে একটি বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভায় শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা সাব-কমিটি আট দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেছেন। তাতে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষাক্রমের বিষয়বস্তু গুরুত্ব অনুসারে তিন গুচ্ছে ভাগ করার কথা বলা হয়েছে। ‘ক’গুচ্ছে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত। ‘খ’ গুচ্ছে বিজ্ঞান, সমাজ পাঠ (ইতিহাস, পৌরনীতি ও ভূগোল)। ‘ক’ ও ‘খ’ গুচ্ছ বাধ্যতামূলক। আর ‘গ’গুচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি, চারু-কারু কলা, শরীরচর্চা ও খেলা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, কৃষি ও গার্হস্থ্য, নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি।
এ গুচ্ছে প্রকৌশল প্রযুক্তি (বিদ্যুৎ, যন্ত্র, কাঠ, ধাতু ইত্যাদির ব্যবহারিক জ্ঞান ও প্রয়োগ) যুক্ত করার মত দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় চারু ও কারুকলা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, কৃষি, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, শরীরচর্চা ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়গুলো বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে বর্তমানে অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় ১০টি বিষয় থেকে তিনটি কমবে। সাতটি বিষয়ে পরীক্ষা হবে।
শিক্ষাবিদদের মতে, ‘গ’গুচ্ছের বিষয়ে জ্ঞান ও তত্ত্বের চেয়ে চর্চা, আগ্রহ বৃদ্ধি, মনোভাবের পরিবর্তন ও সৃজনশীলতার প্রকাশ এবং প্রায়োগিক দক্ষতা বেশি প্রয়োজন। এসব বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা না নিয়ে বিদ্যালয়ভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও এর সঙ্গে যুক্ত সুচিন্তিত সহশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলির নিবিড় যোগ স্থাপন করতে হবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ধারণা দিতে নির্দেশিকা তৈরি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ভবিষ্যতের কর্ম ও পেশা নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে নবম ও দশম শ্রেণিতে আগের শ্রেণির গুচ্ছের সঙ্গে ‘ঘ’গুচ্ছ প্রস্তাব করা হয়েছে। এ গুচ্ছে পদার্থ, রসায়ন, জৈব বিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত, হিসাব, বিপণন, ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতি। ‘ঘ’গুচ্ছ থেকে যেকোনো দুটি বিষয় শিক্ষার্থীরা নিতে পারবেন। শিক্ষার্থীরা ইচ্ছে করলে ‘ঘ’ গুচ্ছ থেকে ঐচ্ছিকভাবে আরও একটি বিষয় নিতে পারবে। তবে বাধ্যবাধকতা নেই।
কমিটির সদস্যরা জানান, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পাঁচটি বিষয় বাধ্যতামূলক ও দুটি ঐচ্ছিক বিষয় প্রস্তাব করা হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষায় ধর্ম বিষয়ে পরীক্ষা না নিলে একটি বিশেষ শ্রেণি ক্ষুব্ধ হতে পারে। সে বিবেচনায় ধর্ম ও তথ্যপ্রযুক্তি বাধ্যতামূলক বিষয় করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ঐচ্ছিক বিষয় একটি কমানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। নবম-দশম শ্রেণিতে পাঁচটি বাধ্যতামূলক বিষয় ছাড়া ‘গ’গুচ্ছ থেকে দুটি ও ‘ঘ’গুচ্ছ থেকে দুটি বা তিনটি বিষয় নিতে হবে। এর ফলে এসএসসিতে ১৪টি বিষয় থেকে চারটি বিষয়ে পরীক্ষা কমবে। অর্থাৎ ঐচ্ছিক বিষয়সহ মোট ১০টি বিষয়ে পরীক্ষা হবে।
প্রসঙ্গত, কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় ১৩টি বিষয় থেকে তিনটি বিষয়ের পরীক্ষা কমিয়ে ফেলেছে। সদ্য সমাপ্ত অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা এবং চারু ও কারুকলা বিষয়ে পরীক্ষা হয়নি। এসব বিষয়ে বিদ্যালয়ে ধারবাহিক মূল্যায়ন করা হয়েছে। আর এসএসসিতে শারীরিক শিক্ষা ও ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয়ের পরীক্ষা বাদ দেয়া হয়েছে।
আগামী বছর থেকে এই দুই বিষয়ে পরীক্ষা হবে না। তবে শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন করা হবে। মূল্যায়নের নম্বর সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ডে পাঠাতে হবে। মূল মার্কসিটে এসব বিষয়ের প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ থাকবে। তবে পরীক্ষার ফলাফলে কোনো প্রভাব পড়বে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা কমিটি ১৮ জেলার ৮৬ জন শিক্ষকের মতামত, ১১টি সভা, ছয়টি কনফারেন্স, দুটি স্কুলের ১০০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফডিজি), ২১ জন কারিকুলাম বিশেষজ্ঞের মতামতের আলোকে এসব প্রস্তাব দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।
সূত্র আরও জানায়, সভায় শিক্ষাক্রম পরিমার্জন কমিটির সুপারিশ উপস্থাপন করেন কমিটির সদস্য ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মঞ্জুর আহমেদ। সভায় সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সভায় উপস্থিত কমিটির প্রায় সকল সদস্য প্রস্তাবগুলোকে স্বাগত জানিয়েছেন। শুধু কিছুটা ভিন্নমত প্রকাশ করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল।
আইএইচ/ ০৬ ডিসেম্বর ২০১৭