বুক রিভিউ: নূরলদীনের সারাজীবন


Dhaka | Published: 2019-12-07 15:21:26 BdST | Updated: 2024-04-19 19:53:55 BdST

সৈয়দ শামসুল হকের দ্বিতীয় কাব্যনাট্য 'নূরলদীনের সারাজীবন'_ যে কোনো বিবেচনায় এটি বাংলা কাব্যনাট্য ধারায় একটি অনন্য সংযোজন। এই রচনায় লেখকের পরিশ্রম ও মেধা সন্দেহাতীতভাবে লক্ষ্য করা যায়। একটি জনপদের সাবঅলর্টান ইতিহাস সংগঠিত করবার এই শিল্পসম্মত প্রয়াসকে কেবল উত্তর-ঔপনিবেশিক চেতনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

ব্রিটিশের বিরুদ্ধে এদেশে কতরকম আন্দোলন যে সংগঠিত হয়েছিল তার সবটা এখনো আমাদের জানা নেই। কিন্তু এই সব আন্দোলনও বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল না মসনদ। 'মুই নবাব না হবার চাঁও। মুই সিংহাসন না চাঁও।' রাজা যায রাজা আসে_ তাতে শ্রমজীবী মানুষের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। কিন্তু বেঁচে থাকার সর্বশেষ গ্রাসটুকু যখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে; সভ্যের বর্বর লোভ যখন দুর্দমনীয় হয়ে পড়ে তখন রুখে না দাঁড়ানোর কোনো উপায় থাকে না। আর এই প্রতিবাদকে ক্ষমতাসীন বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসকরা দস্যুগিরি, বদমায়েশী উল্লেখ করে থাকে।

ব্রিটিশের খাতায় লিপিবদ্ধ এমন একজন দস্যু নূরলদীনকে নিয়ে এই কাব্যনাট্যটি রচনা করেছেন সৈয়দ হক। নিম্নবর্গের ইতিহাস রচয়িতা রণজিৎ গুহ যেমন বলেন, ঔপনিবেশিক আমলের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চেনার অন্যতম উপায় হলো সরকারি খাতায় তাদের বদমায়েশ, দস্যু ও বম্বাটে হিসেবে উল্লেখ করা।

নূরলদীনও ছিলেন তেমন একজন সায়ত্ত্ব স্বাধীনতা সংগ্রামী। লেখকের নিজের জবানিতে শোনা যাক_ 'নিজেকে দেয়া অনেকগুলো কাজের একটি যে, আমাদের মাটির নায়কদের নিয়ে নাটকের মাধ্যমে কিছু করা, নূরুলদীনের সারাজীবন লিখে তার সূত্রপাত করা গেল। যে জাতি অতীত স্মরণ করে না, সে জাতি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে না।

এই নাটকটি লিখে ফেলার পর আমার আশা এই যে, এই মাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন এমন যে সব গণনায়কদের আমরা ভুলে গিয়েছি তাদের আবার আমরা সম্মুখে দেখব এবং জানব যে আমাদের গণ-আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের ও অনেক বড় মহিমার_ সবার উপরে, উনিশশ একাত্তরের সংগ্রাম কোনো বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম নয়।'

এই নাটকটি রচনার ক্ষেত্রে সৈয়দ হক ইতিহাসের এমন এক জায়গায় কাজ করেছেন_ যাকে রীতিমতো রিভাইভালিজম বলা যায়। ব্রিটিশবিরোধী এক গণনায়ককে তিনি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। নূরলদীনের সংগ্রাম বিস্তার লাভ করে একাত্তরের মহাসংগ্রাম হয়ে আজকের ও ভবিষ্যতের দিন পর্যন্ত।

নূরলদীন এমন একজন ভূমিপুত্র_ যার বাবা মহাজনের খাজনা পরিশোধ করতে হালের বলদ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় এবং নিজের ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে জমি চাষ করতে যেয়ে মারা যায়। মরণকালে তার কণ্ঠেও মানুষের বদলে গরুর হাম্বা ডাক শোনা যায়। ঔপনিবেশিক আমলে ভূমিপুত্রদের মর্যাদা যে পশুস্তরে নামিয়ে আনা হয়; তাদের দায়িত্ব যে কেবল ঔপনিবেশিক প্রভুদের অর্থ জোগান দেয়া লেখক এ নাটকে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই নাটকটি রচনার ক্ষেত্রেও সৈয়দ হক আধুনিক ধারার মঞ্চ নাটকের ধারণার মধ্য থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছেন।

প্রাচীন নাট্যাভিনয়ের উন্মুক্ত মঞ্চকে তিনি নির্বাচন করেন। বাংলাদেশে দেবপূজা ও লৌকিক উৎসব উপলক্ষে যে ধরনের সঙ্গীত ও গীতি নাট্যের আয়োজন করা হতো। এ নাটকেও সে ধরনের চেতনা কিংবা ইতিহাসের বিস্তৃত পটভূমিকার স্বার্থে খোলা আকাশের নিচে মঞ্চায়নের কথা লেখক ভেবেছেন। এই নাটকের ক্ষেত্রেও লেখকের স্থায়িভাব সংগ্রাম ও স্বাধীনতা এবং পরিণামে অর্থনৈতিক মুক্তি। নূরলদীন এ নাটকের মূল চরিত্র হলেও তার জীবন বর্ণনা এ নাটকের লক্ষ্য নয়। বরং সময়ের প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিভাবে একজন নূরলদীন সংগঠিত হয়, আত্মপ্রকাশ করে_ লেখক তা-ই দেখাতে চেয়েছেন। এবং এই নাটকের পরিসমাপ্তি করেছেন, বাঙালির চিরন্তন মানবিক আবেদনের ভেতর।

ঈশ্বর পাটনি যেমন অন্নদার কাছে বর চান_ তার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। তেমনি নূরলদীন নবাব হতে চান না; সোনাদানার আকাঙ্ক্ষা নেই; তার আকাঙ্ক্ষা_ 'হামার গাভীন গাই অবিরাম দুধ ঢালিতেছেৃ. হামার পুত্রের হাতে ভবিষ্যৎ আছে।' এবং বাঙালির সব ঘরের মধ্যেই নূরলদীন তার স্বপ্ন বিস্তার করে চলেন। এই নাটকটি অনায়াসেই লেখক প্রমিত বাংলাভাষায় রচনা করতে পারতেন; কিন্তু কাহিনীর গুরুত্ব তাতে শাহরিক রঙ্গমঞ্চের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো।

আমার মনে হয়, ভাষা, বিষয় এবং কাহিনীর বিস্তার বিবেচনা করলে সৈয়দ হকের অন্য কোনো রচনা নয়, না কবিতা না তার কথা সাহিত্য_ কেবল তার কাব্যনাট্যের অবস্থান হবে সামপ্রতিক সময়ে সর্বাধিক আলোড়িত সাহিত্যিক তত্ত্ব উত্তর-ঔপনিবেশিক তথা প্রকৃত নিম্নবর্গের সাহিত্য-চেতনার ভেতর।

এই নাটকে ইতিহাসের সঙ্গে লেখক তার অপরিসীম কল্পনাশক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাঙালি জীবনে শোষক ও শোষিতের ইতিহাস রচনা করেছেন। এই নাটকের সন্ধি বিভাগ, ঘটনা নির্বাচন, প্রারম্ভ, অনুক্রম ও চূড়ান্ত পরিণতি পরম দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। এই নাটকের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে লেখক কৃষিভিত্তিক সমাজের মূল আত্মাকে সংগঠিত করেছেন।