সেন্টিনেল: একটি রহস্যময় নিষিদ্ধ দ্বীপ


Dhaka | Published: 2020-10-10 06:04:50 BdST | Updated: 2024-04-26 01:05:09 BdST

শেলী জামান খান

ভ্রমণপিপাসু ও থ্রিলার প্রিয় মানুষেরা সব সময় নতুন, অজানা, রহস্যময় বা নিষিদ্ধ কোনা কিছুর নাম শুনলেই নড়েচড়ে বসেন। কারণ রহস্য তাঁদের টানে, অজানা জিনিস তাঁদেরকে জানার হাতছানি দেয়। এমনি একটি জায়গা হলো সেন্টিনেল দ্বীপ। আমাদের বঙ্গোপসাগরে বুকেই লুকিয়ে আছে এমনি একটি দ্বীপ; যার সন্ধান আমরা অনেকেই জানি না। জানি না সেই দ্বীপের বাসিন্দাদের কথা। তারা দেখতে কেমন, কি ধরনের জীবন-যাপনে অভ্যস্ত, বহির্বিশ্ব সম্পর্কে তারা কী ভাবে সে সম্পর্কেও কিছুই জানার সুযোগ নেই। এই পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে তাদের আদৌ কোনা ধারণা আছে বলেও মনে হয় না। এই পৃথিবীর অধিবাসী হয়েও তারা এই দীর্ঘ সময় ধরে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের বুকের ছোট্ট এক নির্জন দ্বীপে। সত্যিই এটি একটি অপার রহস্য!

রহস্যময়ী এই দ্বীপের মানুষগুলোও খুব রহস্যময়। নিজেরাই চায় না বাইরের পৃথিবীর মানুষ তাদের রহস্য ভেদ করুক, তাদের জানুক, যোগাযোগ করুক তাদের সঙ্গে। তারা পৃথিবীর অন্য সব মানুষের চোখের আড়ালবর্তী হয়েই বাঁচতে চায়। হাজার হাজার বছর ধরে তারা বাইরের মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি ও জানার আগ্রহকে অত্যন্ত কঠোরভাবে উপেক্ষা করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলেছে। তাদের সীমানায়, তাদের জীবনে উঁকি দেওয়ার অধিকার আজও কোনা মানুষ, জাতি বা দেশ অর্জন করতে পারেনি। তাদেরও বিন্দুমাত্র কোনা আগ্রহ নেই অবশিষ্ট পৃথিবী বা পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে জানার।

রবিঠাকুরের সেই দারুচিনি দ্বীপের মতোই কৌতূহলী মানুষকে বারবার রহস্যের হাতছানি দিয়ে ডাকে এই দ্বীপ। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সেই দ্বীপের জমিতে পা রাখতে বা দারুচিনি কন্যাদের সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারেনি কোনা মানুষ। এটি একটি নিষিদ্ধ দ্বীপ। ভারতীয় জলসীমায় হওয়ায় এবং ভৌগোলিক সীমারেখার মানদণ্ডে এই দ্বীপটি ভারতের। কিন্তু ভারত সরকার শত চেষ্টা করেও দ্বীপে তাদের নাক গলানোর সুযোগ করতে পারেনি। শেষমেশ ভারত বাধ্য হয়েই আইন করে দিয়েছে, ‘লেট দেম লিভ অ্যালোন’। তাই কেউ এখন আর তাদের নির্জনতা, গোপনীয়তা, রহস্যময়তা, স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা ভঙ্গ করার কোনা অধিকার রাখে না। দ্বীপের বাসিন্দারাও সেই অধিকার কাউকেই দিতে চায় না। তারা নিজেই রাজা তাদের সেই নিজের রাজত্বে।

আলোচিত এই দ্বীপটির নাম, সেন্টিনেল দ্বীপ। আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে যেখানে সাগরের তলদেশ থেকে মহাকাশ পর্যন্ত সবখানেই বিজ্ঞানের জয়জয়কার। সবকিছুই মানুষের নখদর্পণে। সেখানে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে থাকা এই দ্বীপটি এখনো বলতে গেলে অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। দ্বীপের সন্ধান পাওয়া গেলেও, দ্বীপটি সম্পর্কে জানা যায়নি তেমন কোনো তথ্য। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, দ্বীপটির বয়স প্রায় ৬০ হাজার বছর। আয়তন ৭২ বর্গকিলোমিটার। ভৌগোলিক অবস্থান হিসেবে এবং কাগজে কলমে দ্বীপটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু দ্বীপের ওপর ভারতের আদৌ কোনো কর্তৃত্ব নেই। অনেকবার চেষ্টা করেও দ্বীপটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারেনি ভারত সরকার নিজেও। এমনকি বহুবার চেষ্টা করেও তারা এ দ্বীপটিতে ঢুকতে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ ঢুকতে গেলেই তারা সেখানকার অধিবাসীদের হিংস্রতার শিকার হয়। ভুল করে, দুর্ঘটনার কারণে, বা পথ হারিয়ে কেউ সেখানে প্রবেশ করলে তাদেরকে হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে। এমনকি হেলিকপ্টারও সেখানে ল্যান্ড করতে সাহস পায় না।

জাতিতে এরা সেন্টিনেলি। সেন্টিনেলিরা বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত আদিবাসী আন্দামানি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। গ্রেট আন্দামানের উত্তর সেন্টিনেলি দ্বীপপুঞ্জে এই জনগোষ্ঠীর বাস; তাই তাদেরকে সেন্টিনেলি বলা হয়। ধারণা করা হয় প্রস্তর যুগ থেকে এই দ্বীপে তাদের বসবাস চলে আসছে। বহিরাগতদের ওপর আক্রমণাত্মক মনোভাবের জন্য তারা বিশেষভাবে পরিচিত। দ্বীপে হেলিকপ্টার নামলে, নৌকা, জাহাজ ভিড়লে তারা দৌড়ে গিয়ে তীর-ধনুক দিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করে। এ কারণে কেউ সফলভাবে এই দ্বীপে যেতে পারে না। বাইরের জগতের কারও নাক গলানো মোটেও সহ্য করে না এখানকার বাসিন্দারা।

এরা মূলত একটি শিকার-নির্ভর জাতি। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ শিকার, মাছ ধরা ও বন্য লতাপাতার মাধ্যমে সংগ্রহ করে। সামুদ্রিক মাছ, প্রাণী ও দ্বীপের উদ্ভিদই সম্ভবত তাদের খাদ্য। এখন পর্যন্ত তাদের মাঝে কৃষিকাজ করার কোনা প্রমাণ দেখা যায় না। এদের কুড়েঘরগুলোর কোনো দেয়াল নেই, শুধু মাথার ওপর ছাউনিটি মাটি পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়। আশপাশে কুড়িয়ে পাওয়া ধাতব সামগ্রী দিয়ে অল্প কিছু জিনিস বানাতে পারলেও ধাতু দিয়ে তেমন কিছু বানাতে পারে বলে মনে হয় না। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো আজও এরা হয়তো আগুন জ্বালাতে শেখেনি।

সেন্টিনেলদের বাসস্থল এই দ্বীপটি ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একটি অংশ। এটি স্মিথ দ্বীপের প্রায় ২০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দ্বীপে আজও পৌঁছাতে পারেনি রাজধানীর আধুনিকতার ছোঁয়া। সেন্টিনেলরা তাঁদের অঞ্চলে, তাঁদের সব বিষয়ে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে। ভারত সরকারের সম্পৃক্ততার মধ্যে রয়েছে অনিয়মিত পর্যবেক্ষণ, ব্যতিক্রম কিছু ক্ষেত্রে দ্বীপটিতে দূর থেকেই পরিদর্শন অভিযান পরিচালনা করা, এবং ভারতের জনগণকে দ্বীপটিতে যেতে নিরুৎসাহিত করা।

নৌকা বা হেলিকপ্টার থেকে বছরের পর বছর নজর রেখে তাদের সম্পর্কে একেবারেই অল্প ধারণা পেয়েছেন নৃতত্ত্ববিদেরা। এদের ভাষার নাম দেওয়া হয়েছে সেন্টিনেলি ভাষা। ধারণা করা হয়, এটি আন্দামানি ভাষাগুলোর একটি। সেন্টিনেলিদের ধর্ম সম্পর্কে স্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোনো ধারণাই পাওয়া যায় না। তাদের সংশ্লিষ্ট কোনো জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কেও তেমন জানা যায় না। তবে আন্দামানের আদিবাসী ‘ওঙ্গে’দের সঙ্গে এদের ভাষার কিছুটা মিল পাওয়া যায়। কিন্তু সেন্টিনেলি ভাষা তাদের সবচেয়ে কাছের উপজাতি ওঙ্গে’দের পক্ষেও বোঝা মুশকিল।

বিশ্বের অন্য যেসব উপজাতি আছে, তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই উপজাতি। মনে করা হয়, এদের আদিপুরুষরা আফ্রিকা থেকে এই দ্বীপে এসেছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটাই সম্ভবত বিশ্বের শেষ উপজাতির আবাসস্থল; যাদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি আধুনিক সভ্যতা। এখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ধরনও জানে না কেউ।

দ্বীপটি প্রবাল প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। দ্বীপে রয়েছে ঘন সবুজ বনভূমি, বাসিন্দাদের ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর। দ্বীপটি ঘিরে রয়েছে একটি সংকীর্ণ সমুদ্র সৈকত। যার মহীসোপান-মহীঢাল ২০ মিটার থেকে ১২২ মিটার। দ্বীপের চারপাশের প্রবাল প্রাচীরগুলো ৪০০ থেকে ১২৯০ মিটার পর্যন্ত প্রসারিত। প্রায় চতুর্ভুজ আকারের দ্বীপটির আয়তন ৫৯.৬৭ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ১২২ মিটার। দ্বীপটির লোকসংখ্যা ৫০ থেকে ৪০০ জনের মতো হতে পারে। ৬০ হাজার বছর ধরে দ্বীপটির বাসিন্দারা নিজেদের মতো করেই এখানে টিকে আছে।

আধুনিক সমাজের মানুষ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে চলেছে অনেক আগে থেকেই। তার আভাস পাওয়া যায়, মার্কো পোলোর একটি লেখা থেকে। আদিম এই উপজাতির সঙ্গে সভ্য মানুষের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৮৮০ সালে। ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ এম ভি পোর্টম্যানের নেতৃত্বে একটি দল ওই দ্বীপে গিয়ে উপজাতিদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। উপজাতিদের এক প্রৌঢ় দম্পতি এবং চার শিশুকে তুলে নিয়ে আসেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। তাদের নতুন পোশাক ও খাবার দেওয়া হয়। কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক দুজনকে দ্বীপ থেকে আনার পরপরই মারা যায়। বাকি বাসিন্দাদের কিছুদিন রাখার পর কোনা তথ্য না পেয়ে তাদেরকে আবার ওই দ্বীপে রেখে আসা হয়। এই ঘটনার পর আধুনিক সমাজের প্রতি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সেন্টিনেলরা। এরপর থেকে সভ্য মানুষদের প্রতি সেন্টিনেলিজদের আক্রোশ আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
১৯৭৫ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একজন চিত্রগ্রাহক তথ্যচিত্র বানানোর জন্য গিয়েছিলেন সেন্টিনেল দ্বীপে। উপজাতিদের বিষমাখানো তীরের আঘাতে তিনি মারাত্মক ভাবে জখম হন। ১৯৯০-এর দশকে বহিরাগতদের সঙ্গে দক্ষিণ ও মধ্য আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত জারাওয়া জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত একইরকম অভিযানে সৃষ্ট বেশ কিছু ধারাবাহিক আক্রমণে কিছু মানুষ প্রাণ হারায়। এ ছাড়া নানা নতুন রোগ বিস্তারের আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় অভিযানগুলো তখন বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৬৭ সালে থেকেই ভারত সরকার সেন্টিনেলিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ভারতীয় নৃতত্ত্ববিদ ত্রিলোক নাথ পণ্ডিতই প্রথমবারের মতো ১৯৯১ সালের ৪ জানুয়ারি দ্বীপটিতে নিজে গিয়ে সেন্টিনেলদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা হিসেবে দ্বীপটির তীরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপহার যেমন, খাবার, পোশাক ইত্যাদি রেখে আসা হতো। কিন্তু তাতে তাদের হিংস্র মানসিকতার কোনা পরিবর্তন হয়নি। দ্বীপের কাছে কোনা নৌকা বা উপরে কোনা হেলিকপ্টার দেখলেই তারা তীর, পাথর বা বর্শা জাতীয় অস্ত্র ছুড়ে মারত। বাইরের মানুষকে তারা তাদের রাজ্যে প্রবেশের আর কোনা অনুমতি দেয়নি। প্রতিবারই অনুপ্রবেশকারীরা তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। মৃত্যুও হয়েছে অনেকের।

সরকারিভাবে ২০০১ সালে দ্বীপটির ব্যাপারে আবারও তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদিও নিরাপত্তাজনিত কারণে এই জরিপটি প্রয়োজনের চেয়েও অনেকটা বেশি দূর থেকে পরিচালনা করা হয়। তাই অসম্পূর্ণ সেই পরিসংখ্যানে দ্বীপটিতে মাত্র ৩৯ জন বাসিন্দার উল্লেখ পাওয়া যায়।

২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে সংঘটিত ভূকম্পন ও সংশ্লিষ্ট সুনামির ফলে দ্বীপটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুনামির পর হেলিকপ্টারে নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ডে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিল ভারত সরকার। সে ত্রাণ গ্রহণ করার বদলে তারা উল্টে পাল্টা আক্রমণ চালায়। তবে অনুমান করা হয়, কিছুদিনের মধ্যেই দ্বীপের বাসিন্দারা সুনামির ধাক্কাটি কাটিয়ে উঠেছিল। কারণ সুনামির পরপরই হেলিকপ্টার থেকে দ্বীপের বাসিন্দাদের তাদের স্বাভাবিক কাজে ব্যস্ত দেখতে পাওয়া যায়। অবশেষে তাদের বিরক্ত না করারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

২০০৬ সালে সেন্টিনেল তিরন্দাজরা তাঁদের দ্বীপে অনুপ্রবেশকারী দুজন জেলেকে তীর মেরে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়। উদ্ধার অভিযানে আসা হেলিকপ্টার থেকে হেলিকপ্টারের পাখার ঘূর্ণনে সৃষ্ট প্রবল বাতাসের তোড়ে অগভীর কবরের মাটি সরে গিয়ে ওই দুজন জেলের মৃতদেহও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সেন্টিনেল তিরন্দাজরা মরদেহ উদ্ধারে আসা হেলিকপ্টারটিকেও তীর মেরে হটিয়ে দেয়। এই কারণে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই দ্বীপের আশপাশের তিন মাইল এলাকার মধ্যে বাইরের পৃথিবীর মানুষের প্রবেশের ব্যাপারেও কড়াকড়ি আরোপ করে দিয়েছে ভারতীয় সরকার।

এখন কেবল নৌকা বা হেলিকপ্টার থেকে দূর থেকে নজর রেখে চলেছে ভারত সরকার। নিজেদের ঘেরাটোপের বাইরের অজানা জগৎ সম্পর্কে নির্বিকার, উদাসীন এই মানুষগুলোকে তাদের মতো করেই থাকতে দিতে আইন করে দেওয়া হয়েছে। নিজেদের পরিসীমার বাইরে নাক না গলানোর নীতি নিয়েই টিকে আছে এই বিস্ময়কর মানুষগুলো। তারা কোনা আধুনিক সুযোগ-সুবিধার কাঙাল নয়; তারা শুধু তাদের মতো করেই বাঁচতে চায়। কিন্তু তাদের চৌহদ্দির ভেতরে কেউ নাক গলাতে এলে তার সমুচিত জবাব দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না তারা। তারই জের ধরে সম্প্রতি এক মার্কিন ধর্মযাজক ফের এই উপজাতিদের শিকারে পরিণত হন। খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের অভিলাষেই তিনি ওই নিষিদ্ধ দ্বীপে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। মার্কিন যাজকের খুব ইচ্ছে ছিল আদিম আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত করবেন। সাতাশ বছর বয়সের ওই পর্যটক জন অ্যালেন চাওকে তীর ছুড়ে হত্যা করেছিল সেন্টিনেলিজরা। আর এই আমেরিকান ধর্মযাজকের নিখোঁজ ও হত্যার খবর দিয়েই আবার নতুন করে আলোচনায় এল সেন্টিনেলিরা।

যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে মামলা করারও অধিকার রাখে না ভারত সরকার; তাই আমেরিকান ধর্মযাজকের মৃত্যুর ব্যাপারেও কোনা পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভবপর ছিল না। দ্বীপবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য তাদের এলাকায় প্রবেশ বেআইনি জেনেও এই ধর্মযাজক সেখানে অনুপ্রবেশ করেছিলেন। ২০১৭ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নিয়ে কোনোরকম ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আপলোড করাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৮ সালের ১৬ নভেম্বর। জনের লাশের খোঁজে হেলিকপ্টার দিয়ে অনুসন্ধান চালানো হলেও প্রশাসন সেখানে কপ্টার নামাতে ভয় পাচ্ছিল। তবে যে ছয়জন মৎস্যজীবীর সহায়তায় এই তরুণ মার্কিন যাজক সেখানে পৌঁছেছিলেন তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারা গেছে, সেই যাজক দ্বীপে নামার পরপরই জঙ্গল থেকে বিষাক্ত তীর ছুটে আসতে থাকে। এই অবস্থাতেও তিনি ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। এরপর সেন্টিনেলিজদের তাকে বেঁধে টেনে ভেতরের দিকে নিয়ে যেতে দেখেছেন মৎস্যজীবীরা। দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখেই তারা পালিয়ে এসেছে। এভাবেই আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে সেন্টিনেলিরা।

জানা গেছে, মৎস্যজীবীরা পোর্ট ব্লেয়ারে এসে ঘটনার কথা প্রথমে স্থানীয় গির্জার যাজক আলেক্সকে জানান। আলেক্স আমেরিকায় যাজকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করলে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভারত সরকারকে জানায়। আলেক্স জানিয়েছেন, চাও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে গত কয়েক বছরে আন্দামানে বেশ কয়েকবারই এসেছিল।

সেন্টিনেলিদের ওপর গবেষণা করছেন এমন নৃতত্ত্ববিদরা লক্ষ্য করেছেন যে, মৃতদেহ পুঁতে দেওয়ার কয়েক দিন পরে আদিবাসীরা সেই জায়গাতে ফিরে এসে কবর খুঁড়ে সেই দেহ বের করে। তারপর মৃতদেহকে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে সমুদ্রের ধারে দাঁড় করিয়ে রাখে। এ ভাবেই তারা বহিরাগতদের ইঙ্গিত দেয়; অনুপ্রবেশকারীরা সাবধান! আমাদের নির্জনতার প্রতি সম্মান না দেখিয়ে এখানে এলে তোমাদেরও এই হাল হবে।