উড়ে যাক একাকিত্বের মেঘ!


ঢাকা | Published: 2021-07-25 06:43:01 BdST | Updated: 2024-03-29 14:38:58 BdST

 

হাজারো কোলাহল, চেনা অচেনা লোকের ভিড়ে, উৎসবে-আনন্দে অথবা কাজের ব্যস্ততার মাঝেও অনেক সময়ই আমরা মনের দিক থেকে কেমন যেন একটা একাকীত্ব অনুভব করি!এই একাকিত্বের অনুভূতিটা আমাদেরকে হতাশ করে দেয় ও জীবনের প্রতি একরকম অনাগ্রহের সৃষ্টি করে। সবকিছু তখন অর্থহীন-মূল্যহীন মনে হয়। তীব্র একাকীত্বের যন্ত্রণা মানুষকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে ছাড়ে।

ইদানিং ভয়ঙ্করভাবেই বাড়ছে এই একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতার হার! ভেঙ্গে পড়ছে পারস্পরিক, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের বুনিয়াদ। যদিও প্রত্যেকটি মানুষের একাকীত্বের কারণ আলাদা। কেউ হয়তো শারীরিকভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেন, আবার কেউ হয়তো শিকার হয়েছেন বৈষম্যের, কারও পক্ষে হয়তো অন্যকে বিশ্বাস করা কঠিন, আবার কেউ হয়তো খুঁজে পান না নিজের মন মানসিকতার সঙ্গে মিল আছে এমন মানুষ।

নিঃসঙ্গতা! শব্দটির মধ্যে রয়েছে সীমাহীন শূন্যতা। অভাবের চেয়ে নিঃসঙ্গতা মানুষকে অধিক ভোগায়। সেদিন একটা রিপোর্টে পড়লাম, জাপানে ২০২০ সালে করোনায় যে পরিমাণ মানুষ মারা গেছে, তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে আত্নহত্যা করে। আর এই আত্নহত্যাকারীদের বেশিরভাগই নিঃসঙ্গতা। যদিও জাপান খুবই আরামের একটা দেশ। তবুও তাদেরকে ঘিরে ধরেছে নিঃসঙ্গতা! শুধু জাপান কেন, এই নিঃসঙ্গতা থেকে কিন্তু বেঁচে নেই আমরাও। একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে দিন দিন নিঃসঙ্গতা আমাদের উপর কঠিনভাবে চেপে বসছে। একদিকে বেঁচে থাকার দৌড় আরেকদিকে নিজেকে সুখী রাখা -এ দুইয়ের তাল মেলানো যেন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।

এখন স্মার্ট ফোনে প্রত্যেকের আলাদা জগত। পরিবারের সবাই যার যার রুমে একা থাকতে পছন্দ করে। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদেরকে নিকটজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। খাওয়ার টেবিলে সবাই মিলে একসাথে মনোরম আলাপচারিতা বা চা স্টলের সেই মজাদার আড্ডাও আজ হারিয়ে গেছে। যে কোনো গেটটুগেদারে সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকা, একটু পরপর ফোনের নোটিফিকেশন দেখা- এগুলোতেই এখন ব্যস্ত থাকছি সবাই।

নিবিড় সামাজিক বন্ধনটা আর নেই।পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, ফ্রেন্ড সার্কেল সবার থেকে আমরা আস্তে আস্তে আলাদা হয়ে পড়ছি। এক পর্যায়ে এই নিঃসঙ্গতা স্হায়ী রূপ ধারণ করছে। নিঃসঙ্গতা ব্যক্তির জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি ক্ষতিকর পরিবার ও সমাজের জন্যও।

একাকীত্ব কাটাতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় রাখা ও প্রিয় সম্পর্কগুলোর যত্ন নেয়াটা খুব জরুরি। অন্তত একবেলা সবাই একসঙ্গে খাওয়া, সপ্তাহে নিয়ম করে একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, বেড়াতে যাওয়া পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করতে পারে। পারিবারিক আড্ডায় ইতিবাচক আলোচনা বাড়াতে হবে, অপরের সমালোচনা কখনোই নয়। একাকীত্বকে আমরা যত প্রশ্রয় দেবো, এটি আমাদেরকে তত বেশি গ্রাস করতে থাকবে। তাই একে এড়িয়ে চলতে জানতে হবে। একাকীত্ব থেকে বেরিয়ে আসার সমাধান বের করার সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হল, কেন একাকীত্ব অনুভব করছি সেটা আগে জানা।

বিভিন্ন সৃজনশীল কাজও একাকীত্বের কষ্ট থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করতে পারে। সেক্ষেত্রে এমন কোন কাজ করা যায়, যেটা করতে আপনার ভালো লাগবে। বিশেষ করে সেই কাজটি, যেটা আপনার মনোযোগ এতোটাই কেড়ে নেবে যে সময় কিভাবে কাটছে আপনি ভুলে যাবেন। সেটা হতে পারে বই পড়া, কোন শখের চর্চা বা যে কোনো পছন্দের কাজ। এই কাজগুলো আপনার শরীর ও মন দুই-ই ভাল রাখবে।

অনেক সময় অতিরিক্ত কম্পারিজন বা সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু ক্যারিয়ার বা নির্দিষ্ট কিছু অর্জন নিয়ে ব্যস্ত থাকা- এগুলোও আমাদেরকে একাকিত্বের দিকে নিয়ে যায়। এ অর্জন করতে গিয়ে জীবন চলার আনন্দটুকু কখন যে হেলায় পিছে পড়ে যায়, সে খেয়ালও আমাদের থাকে না। দিন যায়, রাত আসে কিন্তু বুঁদ হয়ে থাকি স্বপ্নকে কাছে পাওয়ার আশায়, ব্যস্ততায়।মনে হতে থাকে, আমি যদি সবকিছুতে জিতি, আমার স্ট্যাটাস যদি সবার উপরে থাকে তাহলেই আমি সুখী হবো। এক পর্যায়ে হয়তো সেই কাঙ্ক্ষিত সফলতাও পেয়ে যাই কিন্তু সুখী আর হওয়া হয় না।

তখন দেখতে পাই -সবই পাওয়া হয়ে গেছে। শুধু জীবন থেকে চলে গেছে সোনালী দিনগুলো…
আপন মানুষগুলোকেও আর কাছে পাওয়া যায় না।

‘সবসময়ের জিততেই হবে’ এ মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসাটা খুব জরুরি। দেখা গেল আমি কর্মক্ষেত্রে বা আমার জীবনে জয়ী হলাম কিন্তু আলটিমেটলি একা হয়ে গেলাম সম্পর্কের দিক থেকে।

আবার আরেকটা গ্রুপ আছে, যারা কোনো কম্পিটিশনেই যায় না। তাদের মনোভাব হচ্ছে, ‘আমার কিছুই লাগবে না’। জীবনে কোনো অর্জনের দিকেই তারা মনোযোগ দেয় না। এটাও তাদেরকে নিঃসঙ্গ করে ফেলে।

তাই যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে, পরিবার বা সমাজের যে কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই আমাদেরকে ‘সুখ এবং সফলতা’ এই দুই জায়গায় ব্যালেন্স করতে হবে। কম্পিটিশন অবশ্যই প্রয়োজন। তবে একে অবশ্যই কন্ট্রোলে রাখতে হবে।

নিঃসঙ্গতা সব সময়ই কষ্টের। তবে মানুষ চাইলেই তা কাটিয়ে উঠতে পারে। এটি জীবনের দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমস্যা নয়। সময়ের সাথে সাথে তা ফিকে হয়ে আসে। মন ভালো রাখার জন্য প্রয়োজন মনের কথা শেয়ার করা। প্রয়োজন, পাশে একজন আস্থা রাখার মতো মানুষের অস্তিত্ব থাকা। বেঁচে থাকার জন্য এটা খুব জরুরি!

সাজেদা হোমায়রা || রাজ নোটিশ

//