খাদ্যের মধ্যে বিদ্যমান জরুরি কিছু জৈব অনু কেই ভিটামিন বলা হয়ে থাকে। রক্তস্বল্পতা দূর করতে এবং শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে ভিটামিনের কোন বিকল্প নেই। বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থের ঘাটতি যদি দীর্ঘদিন ধরে শরীরে বিদ্যমান থাকে তা দীর্ঘমেয়াদি রক্তস্বল্পতার জন্য দায়ী হতে পারে।
ভিটামিনের অভাবে বিভিন্ন ধরনের অসুখে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো: ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা, বারোমাস ই ঠোট ফেটে যাওয়ার সমস্যা, শিশুদের বিলম্বিত বিকাশ, মাথাব্যথা, গর্ভধারণের সমস্যা অথবা বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কোন ভিটামিনের অভাবে কি রোগ হয় তা জানার জন্য আমাদের সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন।
ভিটামিনের অভাবজনিত লক্ষণ
কোন ভিটামিনের অভাবে কোন রোগ হয় এবং ভিটামিনের অভাব জড়িত লক্ষণ গুলো কি কি তাই একটি ছকের মাধ্যমে নিচে প্রকাশ করা হলো:
ভিটামিন এবং খনিজের নাম |
অভাবজনিত লক্ষণ |
ভিটামিন এ |
রাতকানা, জেরোফথালমিয়া, সংক্রমণের প্রতি সংবেদনশীলতা, রুক্ষ ও শুষ্ক ত্বক, বিলম্বিত বিকাশ, ক্ষত নিরাময়ে বিলম্ব ইত্যাদি। |
ভিটামিন বি১
|
বেরিবেরি। |
ভিটামিন বি ২
|
দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, চোখের সমস্যা, মুখের ভিতর আলসার, গলায় ব্যথা, ঠোঁট লাল হয়ে যাওয়া, মুখের ভেতর নানান ধরনের সমস্যা ইত্যাদি। |
ভিটামিন বি ৩
|
পেলেগ্রা, ত্বকের প্রদাহ ও চুলকানি, মানসিক কার্যক্ষমতা ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, ডায়রিয়া, বদহজম, বমি ভাব, মানসিক অবসাদ এবং ক্লান্তি। |
ভিটামিন বি ৬
|
লোহিত রক্তকণিকার সমস্যা কমে যাওয়া, ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা, খিটখিটে মেজাজ ও স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া ইত্যাদি। |
ভিটামিন বি ৭ |
হার্ট ও লিভারের দুর্বলতা, হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া, চুল পড়া, রক্তশূন্যতা, দুর্বলতা ও ক্লান্তি, বিভ্রান্তি ও বিষন্নতা, ইমিউনিটি সিস্টেম কমে যাওয়া ইত্যাদি। |
ভিটামিন বি১২ |
শ্বাসকষ্ট ও রক্তশূন্যতা |
ভিটামিন সি |
বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যথা, পা ফুলে যাওয়া, ঠোঁটের দুপাশে এবং মাড়িতে ঘা, রক্তস্বল্পতা, রক্তপাত, ক্লান্তি ও দাঁতের ক্ষতি। |
ভিটামিন ডি |
হাড় ও পেশীতে দুর্বলতা, মানসিক চাপ ও উদ্বেগ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি। |
ভিটামিন ই |
পেশীর দুর্বলতা, চলাফেরায় সমস্যা, কোষের ক্ষয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি। |
ভিটামিন কে |
পেটে ব্যথা, হাড়ের বিকৃতি, পেটিচিয়া , হেমাটোমাস ইত্যাদি। |
ভিটামিন এইচ |
খুদা কম অনুভূত হওয়া, চুল পড়ে যাওয়া, রক্তস্বল্পতা ইত্যাদি। |
আইরন |
ক্ষুধায় পরিবর্তন, নখ ভেঙে যাওয়া, ত্বক সুস্থ হয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, জিভেয় ব্যথা, ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। |
আয়োডিন |
হাড়ের সন্ধিস্থলে ব্যথা, মাসিক অনিয়মিত হওয়া, থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, মুখ ফুলে যাওয়া এবং চুল পাতলা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। |
ফ্লুরাইড |
দাঁতের ক্ষয় |
ক্যালসিয়াম |
হাড় ও দাঁতের দুর্বলতা |
ফসফরাস |
বিলম্বিত শারীরিক বৃদ্ধি। |
ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ
ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা হলে বুঝতে হবে ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন এ এবং ভিটামিন ডি এর অভাব রয়েছে। এ সমস্যাগুলো থেকে মোকাবেলার জন্য সূর্যের আলো গ্রহণের পাশাপাশি মাছ, টুনা, সার্ডিন, ডিম, দুধ, মাখন, সবুজ পাতাজাতীয় সবজি খাবার তালিকায় রাখতে হবে।
দ্রুত পরিশ্রণের জন্য খাবার তালিকায় কাঠগোদাম এবং ওয়ালনাট রাখতে পারেন। যদি ভিটামিনের অভাব প্রকর আকার ধারণ করে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।
হাতে অথবা পায়ের অসাড়তা প্রধান কারণ হলো বি৬ এবং বি১২ এর অভাব। এছাড়া ভিটামিন ৬ এবং ভিটামিন ১২ এর অভাবে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, এনিমিয়া, অবসন্নতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য খাদ্য তালিকায় বাদামি ভাত, বাদাম, ডিম, মুরগি, খাসির মাংস, কলা, ব্রকলি, বাঁধাকপি রাখুন।
পেশির খিচুনি এবং পায়ের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা হয় ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম এর অভাবে। এই ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ করার জন্য খাদ্য তালিকায় কলা, বাদাম, নারকেল পানি, গাজর, বাদামি ভাত, কাজুবাদাম রাখুন।
মুখে লাল র্যাশ এবং অতিরিক্ত চুল পড়ার কারণ হলো ভিটামিন বি ৭ এর অভাব। ভিটামিন বি ৭ এর ঘাটতি পূরণ করার জন্য অ্যাভাকাডো, মাশরুম, ফুলকপি, সয়াবিন, বাদাম ইত্যাদি খাবার তালিকায় রাখুন।
দাঁত এবং মুখের বিভিন্ন সমস্যা ভিটামিন সি এর অভাবে হয়ে থাকে। ভিটামিন সি এর ঘাটতি পূরণ করার জন্য খাবার তালিকায় উদ্ভিজ্জ: আমলকী,লেবু, পেয়ারা, টম্যাটো, প্রাণীজ: মাতৃদুগ্ধ, গোরুর দুধ ইত্যাদি রাখতে পারেন।
বন্ধ্যাত্ব, বিলম্বিত ভ্রূণের বৃদ্ধি ইত্যাদি ভিটামিন ই এর অভাবে হয়ে থাকে। ভিটামিন ই এর ঘাটতি পূরণ করার জন্য খাদ্য তালিকায় অঙ্কুরিত গম থেকে নিষ্কাশিত তেল, লেটুস শাক, মটরশুঁটি রাখুন।
রক্ততঞ্চন ব্যাহত হওয়া, মাইটোকনড্রিয়ায় শক্তি উৎপাদন পদ্ধতি বিঘ্নিত ইত্যাদি ভিটামিন কে এর অভাবে হয়ে থাকে। ভিটামিন কে এর ঘাটতি পূরণ করার জন্য টাটকা শাকসবজি, পালংশাক, টম্যাটো, অঙ্কুরিত গম, মাখন, যকৃত, বৃক্ক ইত্যাদি রাখুন।
হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি, ক্লান্তি ও দুর্বলতা, রুক্ষ চুল এবং শুষ্ক ত্বক, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া ইত্যাদি হয় আয়োডিন এর অভাবে। আয়োডিনের ঘাটতি পূরণ করার জন্য খাবার তালিকার প্রতিবেলায় দুধ, ডিম, রসুন, বাদাম, ডালিম, আপেল, কলা, কমলা, আঙুর, আয়োডিনযুক্ত লবণ, তরমুজ ইত্যাদি রাখতে পারেন।
অস্বাভাবিক ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, ত্বক ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া, শুষ্ক ত্বক ও চুল ইত্যাদি আয়রন এর অভাবে হয়ে থাকে। আয়রন এর ঘাটতি পূরণ করার জন্য খেজুর, কচু শাক, মুরগির মাংস, আপেল, কলিজা, ডালিম, কাঁচা ও পাকা কলা ইত্যাদি খাবার তালিকায় রাখুন।
ভিটামিনের অভাব প্রতিরোধ
আমরা আমাদের প্রতিদিনের খাবার তালিকায় কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং কিছু খনিজ পদার্থ রাখলেও ভিটামিন নিয়ে আমাদের তেমন কারো কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু শরীরে ভিটামিনের অভাব থাকলে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ও বড় বড় রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
শরীরে ভিটামিন বি ১২ এর পরিমাণ ঠিক রাখার জন্য স্যামন মাছ, রেড মিট, দই এবং পনির রাখুন। হার্ট এবং লিভারের রোগীরা এজাতীয় খাবার বেশি খাওয়ার আগে অবশ্য ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। ভিটামিন সি এর অভাবে মাড়ি থেকে রক্ত বের হলে বা মুখের ভেতর ঘা হলে লেবু জাতীয় ফলগুলো বেশি করে খান। ভিটামিন বি ৭ বা বায়োটিনের পরিমাণ ঠিক রাখার জন্য খাবার তালিকা প্রতিদিন একটি করে ডিম এবং এক মুঠো করে বাদাম রাখতে পারেন।
শরীরে ভিটামিনের অভাব থাকলে সারা বছর ঠোঁট ফাটা, ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়া, ঠোট শুকিয়ে আসার প্রবণতা ইত্যাদি দেখা দেয়। ভিটামিনের অভাবে এ সমস্যা থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য রেড মিট, বিভিন্ন ধরনের সি- ফুড, নানা রঙের শাকসবজি খাবার তালিকায় রাখতে পারেন।
দীর্ঘদিন ভিটামিনের অভাবজনিত সমস্যায় ভুগলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট ভিটামিন গ্রহণ করতে পারেন।
উপসংহার
আমাদের আজকের আর্টিকেল কোন ভিটামিনের অভাবে কি রোগ হয় পড়ে আপনারা ভিটামিনের অভাবজনিত লক্ষণ, ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ এবং ভিটামিনের অভাব প্রতিরোধ করতে কি কি করা প্রয়োজন তা সম্পর্ক হয়তো বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। ভিটামিনের অভাবজনিত লক্ষণ বা ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ সম্পর্কে যদি আপনাদের কোন প্রশ্ন থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে কমেন্টের মাধ্যমে জানান। এবং এরকম তথ্যবহুল আর্টিকেল পাওয়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটের সাথেই থাকুন।