ইশ! দেখা যাবে কে কাকে মারে


Dhaka | Published: 2020-10-17 07:42:48 BdST | Updated: 2024-04-20 14:33:49 BdST

সারাদিন ক্লাস করে, স্যারের একগাদা বকা খেয়ে, জ্যাম ঠেলে বাসায় আসলে এমনিতেই মন-মেজাজ খারাপ থাকে। তার উপর বিকালে বাসায় এসে যখন দেখলাম আমার রুমের বিছানায় এক গাদা গল্পের বই ছড়ানো, আক্ষরিক অর্থে রাগে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। এই বইগুলো আমার জানপ্রাণ, এগুলি কাউকে ধরতে দেই না। নিশ্চয়ই এটা শায়লার কাজ! শায়লা আমার ছোটবোন, ক্লাস ফাইভে পড়ে। পৃথিবীতে এমন শয়তান ছোটবোন আর আছে কিনা সন্দেহ। আমি মেঘস্বরে ডাক দিলাম,

-- শায়লা!
-- কি?
-- আমার বুকশেলফ থেকে বই ধরেছিস কেনো?
-- আমি ধরিনি।
-- তুই না ধরলে কে ধরেছে? তুই ছাড়া এই কাজ আর কে করবে?
-- রুমকি আপু পড়ার জন্য বই খুঁজতেছিলো তাই এগুলি নামিয়েছে।
-- রুমকি কে?
-- কেন? ভুলে গেছিস? শফিক চাচার মেয়ে।

আমার তখন মনে পড়লো আজকে শফিক চাচার ঢাকায় আসার কথা চিকিৎসার জন্য। উনার হার্টের সমস্যা, অপারেশন করাবেন। শফিক চাচা আমার আপন চাচা না। আমাদের গ্রামে থাকেন, সেই সূত্রে চাচা ডাকি।
-- কে কে এসেছে?
-- চাচা, চাচী আর রুমকি আপু।
-- কই উনারা? চলে গেছে?
-- নাহ। চাচা-চাচীকে নিয়ে আব্বু-আম্মু হাসপাতালে গিয়েছে। আর রুমকি আপু বারান্দায় বই পড়ছে।

শায়লার সাথে তাহলে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। বারান্দায় এসে দেখি চেয়ারে বসে রুমকি ভাঁজ করে বই পড়ছে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার বইয়ে মন দিলো। আমি বললাম,
-- বই ভাঁজ করে পড়লে নষ্ট হয়ে যায়।
মেয়েটা আমার দিকে তাকালো না। ভাঁজটা পর্যন্ত খুললো না। রাগে আমার গা জ্বলে গেলো। কিছু না বলে চলে আসলাম। বইগুলো শেলফে গুছিয়ে তালা লাগিয়ে দিলাম।

রাতে রুমকি নতুন বই নিতে আসলো আমার রুমে। আমি তখন 'তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সুত্র' পড়ছি। রুমকির রুমে ঢোকার শব্দে একবার তাকিয়ে আবার পড়ায় মন দিলাম। রুমকি বই নিতে গিয়ে দেখলো শেলফে তালা। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-- বই নিবো। তালা খুলে দেন।
আমি একবার তাকিয়ে আবার 'কার্নো ইঞ্জিনের গঠন' পড়ায় মন দিলাম। রুমকি আরেকবার বললো,
-- তালা খুলে দিন।
আমি এবার তাকালামই না। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে আবার বললো,
-- শেলফটা খুলে দিন। বই নিবো।
আমি ফিরেও তাকালাম না। রুমকি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রাগত পায়ে হেঁটে চলে গেলো।

রাতে খাবার টেবিলে শফিক চাচা আর চাচীর সাথে দেখা হলো। শফিক চাচা কাল সকালে হাসপাতালে ভর্তি হবেন। দুইদিন পর অপারেশন হবে। সিদ্ধান্ত হলো চাচী চাচার সাথে হাসপাতালে থাকবেন, রুমকি থাকবে আমাদের বাসায়। আমরা মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসবো। রুমকি এবং আমি দুইজনেই এই সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধিতা করলাম। রুমকির কথা হলো সে বাবাকে রেখে এখানে থাকতে পারবে না। আমিও মনে মনে রুমকিকে সাপোর্ট দিলাম। মেয়েটাকে আমার সহ্য হচ্ছে না, আপদ চলে গেলেই ভালো। মুখে তো আর সেই কথা বলা যায় না তাই চুপ করে থাকলাম। তবে রুমকির আপত্তিতে কোন কাজ হলো না। এই হাসপাতালের নিয়ম কড়া। রোগীর সাথে একজনের বেশী থাকার ব্যবস্থা নেই।

রুমকি যে কত বড় আপদ সেটা টের পেলাম পরদিন সকালে। দরজায় ঠক ঠক ঠক বিশ্রি শব্দে আমার ঘুম ভাংলো। কে যেনো নক করছে। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। আজকে শুক্রবার, আরাম করে ঘুমাবো ভেবেছিলাম। রাতে পড়াশোনা শেষ করে ঘুমাতে দেরী হয়ে গিয়েছিলো। সপ্তাহে এই একটা দিন সকালে আরাম করে ঘুমানোর সুযোগ পাই। এই সময়ে ডিস্টার্ব সহ্য হয়? আমি চোখ ডলতে ডলতে উঠে দরজা খুললাম। রুমকি আর শায়লা দাঁড়িয়ে আছে, রুমকির হাতে একটা শোলার ঝাড়ু। আমি একটা কঠিন ধমক দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তার আগেই আমাকে সরিয়ে দুইজন রুমে ঢুকে মশারি খুলে বিছানা ঝাট দেওয়া শুরু করলো। আমি শায়লাকে কঠিন ধমক দিয়ে বললাম,
-- কি ব্যাপার?
-- গেস্ট আসবে। আম্মু আমাদের বলেছে বিছানা গুছিয়ে রাখতে।

আমার বিশ্বাস করতে বেশ কষ্ট হলো। শায়লা বিছানা গুছাচ্ছে? এটা এই মাত্র নিজের চোখে না দেখলে আমি বিনা দ্বিধায় অসম্ভব বলে রায় দিতাম। শায়লাকে দিয়ে কখনোই ঘরের কোন কাজ করানো যায় না। সেই শায়লা হাসিমুখে বিছানা ঝাঁট দিচ্ছে? আমি নিশ্চিত এর মাঝে গভীর কোন ষড়যন্ত্র আছে। রুমকিও নিশ্চয়ই শায়লার সাথে একজোট হয়েছে। এক শায়লার যন্ত্রণায় বাঁচি না, নতুন আরেক আপদের আগমন।
-- আমি ঘুমাবো, বিছানা গুছানোর দরকার নাই।
রুমকি ঝগড়া করার ভঙ্গিতে বললো,
-- আর ঘুমানো যাবে না। বিছানা গুছিয়ে রাখতে হবে, চাচার গেস্ট আসবে। ৯টা বেজে গেছে।
-- ঘুমানো যাবে কি যাবে না সেটা তোমার বলতে হবে না। বেরোও!
আমার মারমুখী ভঙ্গি দেখে রুমকি শায়লাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো। আমি আবার ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। তখনই আম্মুর আগমন।
-- কিরে তুই এখনো শুয়ে আছিস? কয়টা বাজে খেয়াল আছে? বাসায় মেহমান আসবে সেই খবর আছে? নিজের বিছানা তো নিজে গুছিয়ে রাখোস না আবার ওদেরও গুছাতে দেস না। উঠ! এক্ষুনি উঠ!
আম্মুর পিছনে রুমকি মিটমিটিয়ে হাসতেছে। আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। কিন্তু আপাতত উঠে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই।


রুমকি মনে হয় জাদুবিদ্যা জানে। শায়লাকে তো বশ করেছেই, আমার এতো রাগী আম্মুকে কয়েকদিনেই এমনভাবে পটিয়ে ফেললো যে আম্মু এখন রুমকি বলতে অজ্ঞান! আম্মু রান্না করার সময় পাশে পাশে থাকে। গল্প করে আর টুকটাক সাহায্য করে। আব্বু অফিস থেকে আসার সময় প্রতিদিন এটা-ওটা নিয়ে আসেন রুমকির জন্য। স্বাভাবিকভাবে শায়লা সেখান থেকে ভাগ বসায়। আগে যখন শায়লার জন্য নিয়ে আসতো, আমি সেখান থেকে ভাগ বসাতাম। এখন তো আর সেই সুযোগ নেই। আমি মনে মনে ক্ষোভে জ্বলতে থাকি।

সেদিন দুপুরে খেতে গিয়ে দেখলাম শাকসবজি ছাড়া আর কিছু নেই। আমি শাকসবজি খুব একটা পছন্দ করি না। আম্মু সেটা জানে তাই আমার জন্য সবসময়ই বিকল্প তরকারি থাকে। আজকে কিছুই নেই, একটা ডিমভাজিও না। আমি বললাম,

-- আমি এগুলি খাবো না। ডিম ভেজে দাও।
-- এগুলিই খেতে হবে। শাকসবজি না খেয়েই তো শরীরের এই হাল করেছিস। এই যে কয়েকদিন আগে রুমকিদের বাড়ির এক ছেলে মারা গেলো হার্ট এটাক করে। সারাদিন গরু-মুরগী খেতো নইলে কি আর এই বয়সে হার্ট এটাক হয়? শাকসবজি খা, ব্রেইনের উপকার হবে। মেধা বাড়বে।
আমি বুঝলাম খাবারের এই মেন্যু চেঞ্জের পিছনের ভূমিকা কার। শক্ত গলায় বললাম,
-- শাকসবজি খেয়ে মাথায় অমন শয়তানি বুদ্ধির দরকার নাই আমার।
আম্মু এক মুহূর্ত বিরক্তির চোখে তাকিয়ে ডিম ভাজতে যাচ্ছিলেন। রুমকি দ্রুত উঠে বললো,
-- আপনি বসেন চাচীআম্মা। আমি নিয়ে আসছি।
-- আম্মু তুমিই যাও। পুড়ে গেলে বা লবণ-টবন কম হলে খেতে পারবো না।
আমার কথা শুনে রুমকির মুখে কালো ছায়া পড়লো। আম্মু ধমক দিয়ে বললো,
-- সমস্যা কি তোর? নিজে পারোস না আবার আরেকজনকে খোঁচা দিস।
ধমক খেয়েও আমার কোন বিকার হলো না। রুমকির অপমানিত মুখটা দেখে মন তৃপ্ত হয়ে গিয়েছে।

তবে ডিম ভাজি খেতে গিয়ে আমি বেশ লজ্জা পেলাম। খারাপ হওয়া তো দূরের কথা, আম্মুর ডিমভাজির চেয়েও ভালো হয়েছে। সে কথা তো আর বলা যাবে না। এমন ভাব দেখালাম যেনো এর চেয়ে বাজে ডিমভাজি কখনো খাইনি।


পরের দুইদিন খোঁচাখুঁচিতেই গেলো। মেয়েটার মাথায় এমন ফিচলে বুদ্ধি, পেরে ওঠা কঠিন। তার উপর আম্মু শায়লা সবাই ওর পক্ষে। তবু আমিও ছেড়ে দেইনি। সুযোগ মতো ঠিকই প্রতিশোধ নিয়েছি। রুমকি আম্মুকে বুঝালো সকালে ঘুমানো খারাপ। ব্যাস, আম্মু আমার সকালের ঘুমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। খুব সকালে রুমকি আম্মুকে নিয়ে আসে বিছানা গোছাতে। না উঠলে শুরু হয় আম্মুর চিল্লাচিল্লি। সকালের আধঘন্টা বেশী ঘুমের জন্য আমি অর্ধেক পৃথিবী দিয়ে দিতে রাজি। সেখানে এই অত্যাচার কিভাবে সহ্য হয়? আমি নরম সুরে, রাগারাগি করে, জিদ দেখিয়ে নানাভাবে চেষ্টা করলাম, আম্মুকে টলাতে পারলাম না। খাবারের মেন্যুতেও একই অবস্থা। নানারকম ভর্তা আর শাকসবজি দিয়ে ভরা। খুব চাপাচাপি করলে একটা ডিমভাজি পাই, এইটুকুই। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে করেই হোক এই মেয়েকে বাসা থেকে তাড়াতে হবে। নইলে সামনে সমূহ বিপদ!

সকালে রুমকি এবং শায়লা বিছানা ঝাঁট দিতে এসে অবাক হয়ে গেলো। আমি আগে থেকেই জেগে বসে আছি। আরো অবাক হয়ে দেখলো পুরা রুম লণ্ডভণ্ড। আমার জামা কাপড়, বই-খাতা থেকে শুরু করে সব জিনিস উলটপালট অবস্থায় মেঝেতে, বিছানায় ছড়িয়ে রাখা। রুমকি এক মুহূর্তেই বুঝে গেলো ঘটনা কি হচ্ছে। তবে কিছু বললো না। মাথা নীচু করে রুম গোছানো শুরু করলো। আমি ভেবেছিলাম রাগে ফেটে পড়বে। অন্তত আম্মুকে তো বলবেই। এমন নীরব আত্মসমর্পণ দেখে ঠিক তৃপ্তি পেলাম না। শায়লা অবশ্য কয়েকবার ফিসফিস করে বললো,

-- আম্মুকে নিয়ে আসি।
কিন্তু রুমকি সায় দিলো না। সব গোছাতে গোছাতে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগলো। আমি চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে রুমকি এবং শায়লার কাজ করা দেখলাম। আমার মুখের বিজয়ের হাসি দেখে শায়লা রাগে জ্বলতে লাগলো। তবে রুমকি সরাসরি কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আমি জানি এটার প্রতিশোধ সে নিবে। কিভাবে নিবে সেটা হচ্ছে কথা।


আমাকে অবাক করে দিয়ে রুমকি কোন প্রতিশোধ নিলো না। আমি উশখুশ করতে লাগলাম। একদিন গেলো, দুইদিন গেলো, রুমকির পক্ষ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া আসলো না। তৃতীয় দিন সকালে হাসপাতাল থেকে ফোন এলো শফিক চাচার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। আম্মা তড়িঘড়ি করে আমাদের রেখে হাসপাতালে চলে গেলেন। রুমকি যাওয়ার জন্য খুব চেষ্টা করলো কিন্তু রুমকিকে নেওয়া হলো না। আমি আমার রুমে এসে পড়তে বসলাম। একটু পর শায়লা এসে ফিসফিস করে বললো,

-- আচ্ছা, শফিক চাচা কি মরে যাবে?
-- যাহ গাধা! কে বলছে তোরে?
-- রুমকি আপু তাহলে কাঁদছে কেনো?
-- এমনি চাচা অসুস্থ দেখে কাঁদছে। আমি অসুস্থ হলে তুই কাঁদোস না?
-- কই কাঁদছি? ইস!
-- হা হা। আমার যেবার হাত কেটে গিয়েছিলো হাউমাউ করে কেঁদেছিলো কে?
শায়লা লজ্জা পেয়ে দৌড় দিয়ে চলে গেলো।

আমার রুমকির জন্য একটু একটু খারাপ লাগলো। যতই শত্রুতা থাকুক, মেয়েটার এখন খারাপ সময় যাচ্ছে। আমার বাবা অসুস্থ হলে এই অবস্থায় আমি তো পাগল হয়ে যেতাম! খারাপ লাগার কারণেই বোধহয় আমি আমার বইয়ের শেলফটা খুলে দিলাম। রুমকি চাইলে বই পড়ে মনকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখতে পারবে।

আম্মু চলে যাওয়ায় দুপুরের রান্না হয় নি। কি করবো বুঝতে পারছি না। আম্মু তাড়াহুড়ায় টাকা দিয়ে যায় নি যে কিছু কিনে নিয়ে আসবো। আমি ক্ষুধা বেশীক্ষণ সহ্য করতে পারি না। ক্ষুধার সময় পড়ায়ও মন বসে না। হঠাৎ শায়লা ডাক দিলো,
-- ভাইয়া।
-- বল।
-- খেতে আয়।
আমি কিছুটা অবাক হলাম। টেবিলে এসে দেখলাম ভাত, ডাল আর ডিমভাজি রাখা। রুমকি আর শায়লা খেতে বসে গেছে। এই না শুনলাম কান্নাকাটি করছে? রান্না করলো কখন?
আমি খাওয়া শুরু করতেই রুমকি বললো,
-- ডিম পুড়ে যায় নি তো? লবণ ঠিক আছে?
আমি মাথা নীচু করে খোঁচাটা হজম করে নিলাম। খাবার যে পেয়েছি সেজন্যই কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ।
-- হ্যাঁ, বেশ ভালো হয়েছে। চাচার কি অবস্থা?
-- এখন ভালোই।
-- তুমি চাইলে বই পড়তে পারো। আমি শেলফ খুলে দিয়েছি।
-- কেনো?
-- এমনি। বই পড়লে মন ব্যস্ত থাকবে। তবে কোন বই ভাঁজ করে পড়া যাবে না। মনে থাকে যেনো।
-- আচ্ছা।

বিকালে আব্বু এসে রুমকিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। শুধু আমি আর শায়লা বাসায় থাকলাম। হঠাৎ করে বাসাটাকে খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সন্ধ্যায় আমি পড়তে বসলাম, শায়লা এসে আমার পাশে ঘুর ঘুর করতে লাগলো। আমি ধমক দিয়ে বললাম,
-- কিরে? এখানে কি?
-- একা একা ভালো লাগে না। আম্মু কখন আসবে?
-- জানি না। ওই চেয়ারে বসে থাক চুপচাপ।
-- রুমকি আপু কখন আসবে?
-- আমি কি জানি।
কিছুক্ষণ পর পড়ায় বিরতি দিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম শায়লা একা একা কাঁদছে। আমি নরম সুরে বললাম,
-- কিরে? কি হয়েছে?
-- রুমকি আপুর জন্য খারাপ লাগছে।
-- ধুর গাধী! রুমকির জন্য কান্নার কি আছে?
মুখে বললেও আমার নিজেরই শায়লার জন্য কেমন যেনো খারাপ লাগলো। পড়া বাদ দিয়ে শায়লার সাথে গল্প শুরু করলাম। শায়লা ঘুরেফিরে রুমকির কথাই বলে। কবে কি করেছে, কি খাইয়েছে, কেনো রুমকি পৃথিবীর বেস্ট আপু, এসব। রাত এগারোটার দিকে সবাই ফিরে আসা পর্যন্ত সেই গল্প আর থামলো না।


শেলফ খুলে দেওয়ার পর থেকে রুমকির সাথে আমার প্রকাশ্য শত্রুতা কমে গেলো। তবে কোন কথায় খোঁচা দেওয়ার সুযোগ পেলে ছাড়তাম না। রুমকি মারাত্মক পড়ুয়া। কয়েকদিনেই আমার কালেকশনের অর্ধেক বই পড়ে শেষ করে ফেলেছে। চাচা মোটামুটি সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে আমাদের বাসায় চলে এসেছেন, কাল সকালে গ্রামে চলে যাবেন। আমার কিছুটা খারাপ লাগছে, রুমকির সাথে এতোদিন ঝগড়া আর খোঁচাখুঁচি করে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া রুমকি সামনে না থাকলে আমার অদ্ভুত রকমের একটা অনুভূতি হয়। কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগে, বলে ঠিক বুঝাতে পারবো না।

রাতে রুমকি আমার রুমে বই ফেরত দিতে এলো। আমি হাসিমুখে বললাম,
-- শেষ?
-- হ্যাঁ। আরো কত বই বাকি! পড়ে যেতে পারলাম না। তালা দিয়ে না রাখলে এতোদিনে শেষ হয়ে যেতো।
-- ভাঁজ করে না পড়লে তালা দেওয়া হতো না।
-- ভাঁজ করলে এমন কিছু হয় না। এটা আপনার ঢং।
-- ঢং না। ভাঁজ করলে কয়েকদিন পর ছিঁড়ে যায়।
-- ভালো হয়েছে। নেক্সটবার ইচ্ছা করে ভাঁজ করে পড়বো।
-- নেক্সটবার পড়তেই দিবো না। আগে থেকে তালা মেরে রাখবো।
-- তালা ভাঙ্গার প্রস্তুতি নিয়ে আসবো।
-- তাহলে মাইর খাওয়ার প্রস্তুতিও নিয়ে আইসো।
-- ইশ! দেখা যাবে কে কাকে মারে।
-- কাল কখন যাচ্ছো?
-- সকালে। আপনার তো সুবিধা, আপনাকে আর কেউ জ্বালাবে না। আরাম করে ঘুমাতে পারবেন।
-- হ্যাঁ বাঁচলাম! তুমিও বেঁচে গেলা, সমস্ত রুম গোছানো লাগবে না, হা হা।
-- আমি সেদিন ইচ্ছে করে গুছিয়েছি। চাইলে না গুছিয়ে আপনাকে বিপদে ফেলতে পারতাম।
-- ইচ্ছে করে কেনো গুছাইছো?
-- এমনি। ভাবলাম আপনাকে জিতিয়ে দেই।
-- জিতিয়ে দেওয়া লাগতো না। এমনিতেই আমি জিততাম।
-- তাই নাকি? আপনার আম্মু এই অবস্থা দেখলে আপনার খবর করে ফেলতো। সেজন্য আপনাকে বাঁচিয়ে দিলাম।
-- কেনো?
-- বলবো না। বললেও বুঝবেন না। আপনি এমনিতেই একটু কম বুঝেন। অনেক কিছুই বুঝেন না।
বলে রুমকি হাসতে হাসতে চলে গেলো। আমি হতম্ভব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। একটু পর আবার এসে বললো,
-- শুনুন, এতো রাত জেগে পড়বেন না। এটা খুব খারাপ অভ্যাস। কিছুদিন পর যখন শরীর খারাপ হবে তখন বুঝবেন। আর সকালে জলদি উঠবেন। এতো বেলা করে ঘুমানো ঠিক না। আপনি অবশ্য আমার কথা শুনবেন না জানি। তবুও বললাম।
-- বাপ রে! আর কিছু?
-- আর মুরগী খাওয়া কমিয়ে শাকসবজি খাবেন। নইলে কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার ভালোর জন্যই বলছি। আপনি তো ভাববেন আপনার ক্ষতি করার জন্য বলছি।
-- হঠাৎ আমার ভালো চাওয়া শুরু করলা যে?
-- সবসময়ই চেয়েছি, আপনি বুঝেন নাই। বলেছি না আপনি কম বুঝেন?
রুমকি আবার বিচিত্র চাহনি দিয়ে চলে গেলো। আমি আর পড়ায় মন দিতে পারলাম না। বইয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। বইয়ের হিজিবিজি অক্ষরগুলো দুর্বোধ্য লাগছে, পড়া মাথায় ঢুকছে না।
পড়া শেষে ঘুমানোর আগে পানি খেতে গিয়ে দেখি রুমকি বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। আমি বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম,
-- কি ব্যাপার? কি হয়েছে?
রুমকি চোখ মুছতে মুছতে বললো,
-- কিছু না।
-- কেউ খারাপ কিছু বলেছে?
-- কে বলবে? খারাপ কিছু বললে আপনিই তো বলবেন।
-- আমার অতীত আচরণের জন্য সরি।
-- সরি হওয়ার কিছু নাই। এমনি, চলে যাবো তাই মন খারাপ।
-- অনেকদিন নিজের বাড়িতে যাবা, মন তো ভালো হওয়ার কথা।
-- ওখানে তো আর আপনার মতো কাউকে পাবো না যাকে জ্বালাতে পারবো। আপনি বুঝবেন না, ঘুমাতে যান। এতো রাত পর্যন্ত পড়েন কেনো?

সকালে শফিক চাচারা বিদায় নেওয়ার সময় শায়লা আর রুমকি অনেকক্ষণ জড়াজড়ি করে কাঁদলো। তারপর চোখ মুছে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-- আপনাকে জ্বালানোটা খুব মিস করবো। ঈদে বাড়িতে আসবেন না? কিছু বই নিয়ে আসবেন প্লিজ?
-- আচ্ছা।


দুপুরে খাওয়ার সময় আমি হঠাৎ মুরগীর বাটি ঠেলে বললাম,
-- আজকে মুরগী খাবো না। পটল তরকারি দাও।
আম্মু অনেকক্ষণ বজ্রাহত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
-- কি ব্যাপার? শরীর খারাপ নাকি তোর?
-- নাহ। এমনি।
আমি এখন বেশ সকালেই ঘুম থেকে উঠি। তারপর শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করি। কেউ একজন যদি দরজা নক করে বলে,
-- অনেক ঘুমিয়েছেন। উঠেন। বিছানা ঝাঁট দিতে হবে। না উঠলে কিন্তু চাচীআম্মাকে ডাক দিবো।

আমি সেই কেউ একজন এসে জোর করে ঘুম ভাঙাবে এই আশায় শুয়ে শুয়ে ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করি।

রাফ্খাতা থেকে নেয়া