শেখ হাসিনাঃ প্রতিশ্রুতি চেতনায় প্রত্যাবর্তন


Dhaka | Published: 2023-05-17 06:35:11 BdST | Updated: 2024-03-29 04:33:24 BdST

শেখ হাসিনাঃ প্রতিশ্রুতি চেতনায় প্রত্যাবর্তন

ডি ডেল্টা’ পত্রিকায় ১৯৭৫-এর ১৮ আগষ্ট তিনটি ছবিসহ চার কলামের একটি সংবাদ ছাপা হয়,– ‘বনে শোকাগ্রস্ত শেখ মুজিবের কন্যারা’॥ স্বজন পরিজনদের মৃত্যু সংবাদ টুকু পাওয়াও যে মুহূর্তে সিন্ধু সেঁচে মুক্তা খুঁজে বেড়ানোর মত, সে মুহূর্তে কেউ বলছে শেখ রেহানা ও রাসেল বেচেঁ আছে কেউ বলছে পরিবারের কেউ বেঁচে নেই।

১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে থাকার কারনে বঙ্গবন্ধু তনয়ারা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা শুধু প্রানেই বেচেঁ ছিলেন ঠিকই, তবে বেচেঁ রইলনা পরিবারের অন্য সদস্যরা। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাবা, প্রতিশ্রুতি যত্রতত্র ছড়ানোর বিষয়বস্তু না। প্রতিশ্রুতি চেতনার স্তরে স্তরে সপ্তসিন্ধুজলের মর্মর।

জয় ও পুতুল জলবসন্তে আক্রান্ত হওয়ায়, অন্যদিকে শেখ হাসিনার দেশে ফেরা প্রতিরোধের জন্য পাকিস্তানপন্থি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং দেশব্যাপী প্রচারণা চালায় বিএনপি সমর্থক গোষ্ঠী । সারা দেশে প্রচুর লিফলেট ও হ্যান্ডবিল বিতরণ কিছুই গতিরোধ করতে পারেনি পিতার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে কন্যার দেশে আগমন।

শহর জুড়ে কালে মেঘের ছায়া যেন শোষকের কড়াল দৃষ্টিতে সবকিছু নিষ্প্রাণ। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রকৃতির ঝড়বৃষ্টি আর স্বৈরতান্ত্রিকতার এ কালো ছায়া সেদিন গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি।

সকাল থেকেই সাধারণ মানুষ ছুটে গিয়েছে কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সবারই অপেক্ষা কখন আসবেন প্রিয় নেত্রী, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা। অপেক্ষার প্রহর পেড়িয়ে বিকেল ৪টায় পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাঙালির ভাগ্য পরিবর্তনের আমলনামা নিয়ে বাংলার মাটিতে দ্বিতীয়বার আশার আলো হয়ে ফিরলেন; বাংলার মা, মাটি ও মানুষের নেত্রী আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাকে এক নজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত রাস্তাগুলো রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে। ১৫ লক্ষ মানুষ প্রিয় নেত্রীকে বরণ করে নিতে রাস্তায় সামিল হয় সেদিন। তখন স্বাধীনতার অমর স্লোগান “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ বাতাস। জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদ ঘোষিত হয়েছিল ‘পিতৃহত্যার বদলা নিতে/লক্ষ ভাই বেঁচে আছে, শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’ বিমানবন্দর থেকে ধানমণ্ডি, মানবঢাল তৈরি করে তাকে সাদরে গ্রহণ করেছিল জনতা। যেন সূর্যের বল্লম হাতে তেজস্বী এক নারী।

দেশে আসার পর তার নিজ বাড়ি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় ঢুকতে দেয়নি স্বৈরশাসক জিয়া। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও বাড়িতে ঢুকতে না পেরে ফিরে যান তিনি। অবস্থান নেন সুধাসদনে। এরপর স্বৈরশাসক জিয়া তাকে পদে পদে মৃত্যুর হুমকি আর গণতান্ত্রিক সকল কার্যক্রমকে বাধা দিতে থাকে। এ সময় তার একমাত্র সম্বল ছিল দলের নিবেদিত কমীর্রা।
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের (১৯৮১ সালের ১৭ মে) আগে ৫ মে বিশ্ববিখ্যাত ‘নিউজউইক’ পত্রিকার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, জীবনের ঝুঁকি আছে তা জেনেও তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চের সামরিক শাসন জারির দুইদিন পর স্বাধীনতা দিবসে একমাত্র শেখ হাসিনাই সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি সামরিক শাসন মানি না, মানবো না। বাংলাদেশে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবোই করবো।’ তাই তো কবি ত্রিদিব দস্তিদার শেখ হাসিনার উদ্দেশে লিখেছেন, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ।’

এক দিকে সামরিক স্বৈরচারী জিয়া সরকারের মৃত্যু হুমকি অন্য দিকে মৌলবাদী জামায়াত গোষ্ঠীর দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র। তবে এ ষড়যন্ত্রকে পেছনে ফেলে বিরামহীন বিস্ময়কর ছুটে চলার নামই শেখ হাসিনা।

১৯৯৬-২০০১, এরপর ২০০৯ থেকে বর্তমান পর্যন্ত সরকার গঠন করে বর্তমানে দেশের জিডিপি ৭.২৫ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পেছনেই রয়েছে বাংলাদেশ। তবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪তম। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৬০০ কোটি ডলার। এদিকে মৌলবাদী জঙ্গি দমন, বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে তাঁকে। জনগণকে একেবারে বিনামূল্যে অতিমারি করোনা প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছে। করোনা মহামারিতে যখন সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা করুণ, তখনও ডিজিটাইজেশন করে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ডিজিটাইজেশনের রূপকার তারুণ্যের এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা সজীব ওয়াজেদ জয়। ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে মানুষ ঘরে বসে নিজের ব্যবসা, প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে পেরেছে। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ই-কমার্স ব্যবস্থা চালু করে নবদিগন্ত উন্মোচিত করেছে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের দিকে ঝুঁকছে তরুণ শিক্ষিত যুবকেরা। প্রধানমন্ত্রীর নারী ক্ষমতায়নের বার্তা নিয়ে সুদক্ষ্য যে নেতৃত্বে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবার সুউচ্চ স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। এখানে ঘর সামলে নারীরা এখন বিমানের ককপিটে। যে মেয়েদের পড়াশুনা এ সমাজে নিষিদ্ধ ছিল, খেলাধুলা তো দূরের ব্যাপার সেই সমাজে সালমা বাহিনীদের ক্রিকেট বিজয় আজ বাংলাদেশে গর্ব করার মতো। তাই তো বরাবরের মতই সামাজিক অচলায়তন ভেঙে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কিছু বাধা আসে, আসবে। সেই বাধা অতিক্রম করেই এগিয়ে যেতে হবে।’

ইসলাম ধর্মের নারীর অধিকারের কথা স্বরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী-পুরুষের পাশাপাশি কাজ করার সব বন্দোবস্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বাসটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিনিস। বিশ্বাসটা করতে হবে। নারীরা শুধু ভোগের বস্তু না, নারীরা সহযোদ্ধা, সহযোগী। সহযাত্রায় চলতে হবে। সমান অধিকার দিতে হবে।’ নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে চিন্তা-চেতনা পরিবর্তনে কাজ করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন করেছি, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন করা হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু আইন করলে হবে না, এখানে মানসিকতাও বদলাতে হবে। চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্বাসটা করতে হবে। নারীরা শুধু ভোগের বস্তু নয়, নারীরা সহযোদ্ধা, সহযোগী। সহযাত্রায় চলতে হবে।’ শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘প্রথমবার যখন সরকার গঠন করি, নারী শিক্ষা অবৈতনিক করেছি। পাশাপাশি প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষক বাধ্যতামূলক করি। এই সিদ্ধান্তের পর অনেক বাবা-মা মেয়েদের বাধা দেয়নি। অন্তত মেয়ে যে একটা চাকরি পাবে সেটা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে। তা ছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে মেয়েদের কর্মের ব্যবস্থা হয়। তাই তো নারী নির্যাতন আজ অনেক অংশে কমছে।’

এতকিছুর পরও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। কেউ কেউ বলতে চাইছে, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হবে। তবে এর মোক্ষম জবাবটা মনে হয় বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সমালোচক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘যদি শেখ হাসিনা না থেকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতো তাহলে শ্রীলঙ্কার আগেই বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যেত।’ তিনি বর্তমান সরকারের ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন। আজ সমালোচকেরাও এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব গুণের কারণে বাংলাদেশ আজ অনন্য উচ্চতায়। একজন শেখ মুজিব না হলে যেমন বাংলার মানুষ আরও হাজার বছর পরাধীনতায় থাকতো ঠিক তেমনি ১৭ মে যদি শেখ হাসিনা দৃঢ়চিত্তে বাংলার মাটিতে না ফিরতেন তবে বাংলাদেশ পাকিস্তানে ফিরে যেত। শেখ হাসিনা দৃঢ়চিত্তের নারী, যিনি আকাশ সমান কষ্ট বুকে চেপে বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশকে। একজন শেখ হাসিনা আছেন বলেই আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যেতে পারি, আমরা গর্ব করে বলতে পারি আমরা বাঙালি, আমরা বাংলাদেশি। ১৭ মে প্রত্যাবর্তন দিবসে এইটুকুই চাওয়া, তিনি যেন সুস্থ থেকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যান আরও উচ্চতায়।

রক্তে তবু এ পৃথিবী যায়না ভেসে বরং বাঁ দিকে ‘বেঁচে থাকা’ লিখে রাখে। বঙ্গবন্ধু রক্তে যে দেশের মাটি রক্তিম হয়েছিল , সে দেশের মাটি জননেত্রী রাঙিয়ে দিল সোনালু আলোর আভা দিয়ে।

তিলোত্তমা সিকদার
সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশবিদ্যালয়।

//