রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অভিনব উদ্যোগ ‘ধুয়ে দেই’


RU Correspondent | Published: 2023-02-26 00:17:27 BdST | Updated: 2024-04-19 07:13:12 BdST

ভাবুনতো, ব্যাচেলর জীবনে সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজ কোনগুলি? অবশ্যই এর একটি হবে পরিধেয় পোশাক পরিষ্কার করা। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্যই এই কাজটা আরো কঠিন। কারণ দিনের অধিকাংশ সময় ক্লাস, ল্যাব, পরীক্ষায় কাটানোর পরে যে সময়টুকু পাওয়া যায়, তখন ব্যবহৃত প্রতিদিনের ময়লা কাপড় পরিষ্কার করার মত মানসিক শক্তি আর থাকেনা। এমন যদি কোনো সার্ভিস থাকে যেখানে ময়লা কাপড়গুলো কেউ ধুয়ে দিবে, তাহলে কেমন হয়?

অর্থের বিনিময়ে কাপড় ধুয়ে দেওয়ার এমন অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) পরিসংখ্যান বিভাগের চার শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাস সংলগ্ন কাজলাতে একটি ভাড়া বাসাতে এই কাজ করেন তারা। 'ধুয়ে দেই' নামক একটি ফেসবুক পেজ এবং 'ধুয়েদেই.কম' নামে ওয়েবসাইটও রয়েছে তাদের। তিন বছর ধরে বেশ সফলতার সঙ্গে এই কাজ করে আসছেন তারা। অভিনব উদ্যোগ নেয়া এই শিক্ষার্থীরা হলেন- হামিম শেঠ, পলাশ বিন ফারুক, অভিষেক বিশাল চৌধুরী ও সালমান খান ফারসি।

শুরুটা যেভাবে

২০২১ সালে শীতের পড়ন্ত বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়ামের পাশে বটগাছ তলায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন দুই বন্ধু হামীম ও সালমান। নিজেদের খরচ চালানোর জন্য কি করা যায় তা নিয়ে ভাবছিলেন তারা। পরেরদিন সকালে সালমানের কাপড় ধুতে গিয়ে মনে হলো, ইশ! যদি এমন কোনো ম্যাজিক থাকতো, যাতে প্রতিদিন ময়লা কাপড়গুলো কেউ ধুয়ে দিত। তাহলে আলাদাভাবে কাপড় ধোয়ার জন্য কষ্ট করতে হতোনা। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের ময়লা কাপড় ধুয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিলে কেমন হয়? হামীমকে জিজ্ঞেস করে সালমান। হামীম প্রস্তাবে সাড়া দেন। এভাবেই অভিনব এই উদ্যোগের বিষয়টি তাদের মাথায় আসে।

কিস্তিতে স্বপ্নের যাত্রা

অভিনব এই উদ্যোগে প্রথমেই প্রয়োজন ছিল একটি ওয়াশিং মেশিন। কিন্তু তা কেনার মতো সামর্থ্য তাদের দুজনের নেই। তাদের এই আইডিয়ার কথা জানান পলাশ ও বিশালকে। তারাও বিষয়টি ভালোভাবে নেন। এরপর প্রত্যেকেই দুই হাজার টাকা করে দিয়ে ৮ হাজার টাকা ডাউনপেমেন্ট দিয়ে কিস্তিতে নেন ওয়াশিং মেশিন। সেইদিন নিজেদের কাপড় ধুয়ে ট্রায়াল দেন তারা। পরদিন অর্থাৎ ২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় তাদের যাত্রা।

সালমান ফারসি বলেন, 'প্রথমে ভেবেছিলাম প্যাকেজ সিস্টেমে করবো। একজন শিক্ষার্থীর একমাসে কতগুলো জামা ব্যবহার করে, সেই হিসেব করলাম। ৪-৫টি প্যান্ট, ৭-৮টি শার্ট-গেঞ্জি হলেই মোটামুটি হয়ে যায়। সেই হিসেবে আমরা যদি মাসে একবার কাপড় ধুয়ে দেওয়ার জন্য ১২০ টাকার প্যাকেজ করি, তাহলে খুব বেশি না। কারণ একবার ধুয়ে নিলেই সারা মাস আর চিন্তা করতে হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের ১১টি হল রয়েছে। প্রত্যেক হলে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪০০-৫০০ জন। আমরা যদি তাদের মধ্যে থেকে ১০ জনও পাই, তাহলে মোটামুটি ভালো ব্যবসা হবে। সেই আইডিয়া থেকেই সাহস নিয়ে এমন উদ্যোগ নিলাম। ফেসবুক পেজ খুললাম 'ধুয়ে দেই'। কিছুদিন আগে 'ধুয়েদেই.কম' আমরা আমাদের একটা ওয়েবসাইটও চালু করেছি।'

শুনতে হয়েছে ঠাট্টা

প্রথম যখন তারা কাজটা শুরু করেন, তখন অনেকেই তাদের কাজ নিয়ে হাসাহাসি করে। ধোপা বলেও ঠাট্টা করেছিলো তাদের সাথে। সহপাঠী, বন্ধু, এমনকি শিক্ষকরাও এটা নিয়ে বাজে মন্তব্য করে। ছাত্র অবস্থায় কি শুরু করছো? তোমাদের কেউ বিয়ে করবে না। বাসায় জানে এসব ধোপাগিরি করছো? আরো কত অপমান সহ্য করতে হয়েছে তাদের। তারপরও তারা পিছু হটে যায়নি।

করোনার হানা, স্বপ্নে হোঁচট

এদিকে ২০২০ সালে সারাবিশ্বে হানা দেয় করোনা মহামারি। দেশেও তা ছড়িয়ে পড়ে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। লকডাউনে বন্ধ হয়ে যায় এই চার শিক্ষার্থীর স্বপ্নের উদ্যোগ ‘ধুয়ে দেই’ সার্ভিস। তারপরও প্রতিমাসে কিস্তি পরিশোধ করতে হতো তাদের। কোনো রকমে সে কিস্তি চালিয়ে নেয় তারা। করোনা মহামারির পর বিশ্ববিদ্যালয় খুললে, আবারো নতুন করে শুরু করে তারা। এরপর থেকে বেশ ভালোভাবেই চলছে।

কাপড় পরিষ্কার করার রেট

হামীম জানান, শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করেই কম খরচে এই সেবা দেন তারা। প্রতিটি পায়জামা, সাদা গেঞ্জি, ফুল হাতা গেঞ্জি, সাদা শার্ট, পাঞ্জাবি, গামছা এবং লুঙ্গি পরিষ্কার করতে নেন ১০ টাকা। বালিশের কভার ৫ টাকা, শার্ট ৮ টাকা, গেঞ্জি এবং সেন্ডো গেঞ্জি ৭ টাকা, সোয়েটার ২০ টাকা, হুডি, জিন্সের জ্যাকেট এবং বেড কভার ২৫ টাকা, পাতলা কাথা ৫০ টাকা, মোটা কাথা ৮০ টাকা, মোটা কম্বল ১২০ টাকা এবং পাতলা কম্বল ৮০ টাকা। আর প্রতিটি কাপড় ইস্ত্রি করতে নেয়া হয় ৫ টাকা। সবমিলিয়ে প্রথম দিকে যেমন চলেছে, তার থেকে এখন ৩-৪ গুণ ভালো চলছে বলে জানান হামীম।

যেসব জায়গায়, যেভাবে দেয়া হয় সেবা

রাবি ক্যাম্পাস ছাড়াও রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন জায়গায় এই সেবা চালু করেছেন তারা। হামীম বলেন, প্রথমে শুধু রাবি ক্যাম্পাসে এই সেবা সীমাবদ্ধ ছিল। এখন আমরা রুয়েট, বিনোদপুর, কাজলা, অক্ট্রয় মোড়, তালাইমারি, নর্দান মোড়, মুন্নাফের মোড়, সুইটের মোড়সহ শহরের বিভিন্ন জায়গাতে এই সেবা দিয়ে আসছি। আলহামদুলিল্লাহ এখন খুব ভালো চলছে।

কেউ যদি তাদের সার্ভিসটি নিতে চায়, তাহলে তাদের ফেসবুক পেজে (ধুয়ে দেই) বা ওয়েবসাইটে গিয়ে জানাতে পারবেন বা প্রদত্ত নাম্বারে কল দিতে পারবেন। এ সময় হলের নাম, রুম নম্বর ও ফোন নম্বর জানাতে হবে। যারা ক্যাম্পাসের বাইরে থাকে তাদেরকেও একইভাবে ঠিকানা দিয়ে মেসেজ করতে হবে। এক কথায়, পেজ, ওয়েবসাইট এবং মোবাইল কলের মাধ্যমে অর্ডার কনফার্ম করা হয়। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সেই সব জায়গায় গিয়ে কাপড়গুলো সংগ্রহ করা হয়। এরপর ধুয়ে, রোদে শুকিয়ে, ইস্ত্রি করে পরেরদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সবার কাপড়গুলো পৌঁছে দেওয়া হয়।

উপহাসকারীরাই এখন করেন প্রশংসা

শুরুতে যারা তাদের ‘ধুয়ে দেই’ সার্ভিস নিয়ে উপহাস করেছে এখন তারাই প্রশংসা করে। নিয়মিত সেবাও নেন তাদের থেকে। সালমান বলেন, এখন আমাদেরকে অনেকে উৎসাহিত করে। মূলত, এই পরিবর্তনটা তখন আসে, যখন আমাদের সার্ভিসে সবাই উপকৃত হতে থাকে।

বিষয়টি যখন পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষকরা জানতে পারেন, তখন তাদের এই অভিনব উদ্যোগকে স্বাগত জানান তারা। তাদের কাজে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে সহযোগিতাও করেছেন।

পরিসংখ্যান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম হোসেন বলেন, 'বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছি। তাদের সৃজনশীল বুদ্ধি রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের এই কাজের জন্য উৎসাহ প্রদান করেছি। বিভাগ তাদের নিয়ে গর্ব করে। এ ধরনের সৃজনশীলতা এবং নতুনত্ব নিয়ে কোনো শিক্ষার্থী যদি কিছু করতে চায় অবশ্যই আমরা তাদের পাশে থাকবো।'

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে হামীম বলেন, 'আমাদের এই কার্যক্রমটা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। আমাদের প্রথম টার্গেট হলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সেবা পৌঁছে দেওয়া। সেখান থেকে ধীরে ধীরে শহরকেন্দ্রিক জায়গাগুলোতে সেবাটা পৌঁছে দেওয়া।'

সালমান বলেন, 'এখন আপাতত রাবি, রুয়েট এবং এর আশেপাশের এলাকায় সার্ভিস চালু রয়েছে। এই মাস থেকেই আমরা পুরো শহরে সার্ভিস দেওয়া শুরু করবো। আমরা একটা ভ্যানগাড়ি নিয়েছি, এর সাহায্যে পুরো রাজশাহী শহর কাভার করার চেষ্টা করবো।'