অপটিকসের জনক ইবনে আল-হায়সাম


মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা | Published: 2024-12-28 20:02:48 BdST | Updated: 2025-02-08 15:41:31 BdST

বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার প্রতিটি বিভাগেই জনকের আসন অলংকৃত করেছেন অনেক মুসলিম বিজ্ঞানী। যাঁদের রেখে যাওয়া আবিষ্কার কিংবা পাণ্ডুলিপি অনুসরণ করে বিশ্ব এগিয়ে চলেছে বিদ্যুতের গতিতে। কিন্তু আমাদের মধ্যে এসব ইতিহাসচর্চা না থাকার কারণে আমরা নিজেদের অকর্মা জাতি ভাবতে শুরু করেছি।

বিশ্বকে যাঁরা বিভিন্ন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন উপহার দিয়ে গেছেন, সেই মহান মনীষীর একজন হলেন মুসলিম বিজ্ঞানী আল-হাজেন।

পুরো নাম আল-হাসান ইবন আল-হায়সাম। তবে তিনি পশ্চিমা বিশ্বে আল-হাজেন নামেই পরিচিত। তিনি ছিলেন বিজ্ঞান চিন্তার একজন অগ্রদূত। দৃষ্টিবিজ্ঞান (অপটিকস), আলোকবিজ্ঞান ও আলো সম্পর্কে তিনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত আবিষ্কার করে গেছেন।
এ বিষয়ে তাঁর রচিত বুক অব অপটিকস বা কিতাবুল মানাজিরের লাতিন অনুবাদের (দি এস্পাকটিবুস) মাধ্যমে তাঁর ধারণাগুলো ইউরোপীয় পণ্ডিতরা রেনেসাঁকে প্রভাবিত করেছেন।

১২ শতকে কিতাবুল মানাজিরের একটি লাতিন অনুবাদ ‘প্রস্পেটিভা বা দি এস্পাকটিবুস’ অধ্যয়ন করে বিস্মিত হয়েছিলেন ততকালীন ইউরোপের মধ্যযুগীয় শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী (যন্ত্রবিদ্যা, আলোকবিজ্ঞান, রসায়ন প্রভৃতি বিষয়ে খ্যাত) রজার বেকন, বিখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী রবার্ট গ্রোসটেস্ট (১১৭৫-১২৫৩), খ্রিস্টান ভিক্ষু, ধর্মতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী, প্রাকৃতিক দার্শনিক, গণিতবিদ ভিটেলন। (সূত্র : আরলি ডেজ অব এক্স-রে ক্রিস্টালগ্রাফি, পৃ. ২৩)

জন্ম-মৃত্যু : তাঁর জন্ম ইসলামী সভ্যতার সোনালি যুগে ইরাকের বসরায়। আনুমানিক ৩৫৪ হিজরি বা ১ জুলাই ৯৬৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

আনুমানিক ৪৩০ হিজরি বা ৬ মার্চ ১০৪০ সালে তিনি মিসরের কায়রোয় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। এ যুগে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে অভূতপূর্ব আবিষ্কার হয়েছে। তিনি আলোকবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, আবহাওয়াবিজ্ঞান, দৃষ্টি সম্পর্কীয় বিষয় ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আলোকবিজ্ঞানের অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এ মুসলিম বিজ্ঞানীকে আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক মনে করা হয়।

তিনি মধ্যযুগের ইউরোপে দ্বিতীয় টলেমি (মিসরীয় বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০-১৭০) কেবল পদার্থবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন কায়রোর ফাতেমীয় খলিফার সান্নিধ্যে। বিভিন্ন গবেষণামূলক পুস্তক রচনা ও অভিজাত ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।

বিজ্ঞান, বিশেষত জ্যোতির্বিদ্যায় প্রবল আগ্রহী ফাতেমীয় খলিফা আল-হাকিমের (৯৯৬-১০২১) আমলে তিনি কায়রো আসেন। আল-হায়সাম নীল নদের বন্যানিয়ন্ত্রণপদ্ধতির উন্নতির উদ্দেশ্যে খলিফার কাছে একটি হাইড্রোলিক প্রজেক্টের প্রস্তাব তুলে ধরেন। এতে বর্তমান আসওয়ান ড্যামের স্থানে একটি ড্যাম নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল, পরিকল্পনাটি প্রযুক্তিগতভাবে বাস্তবায়ন সম্ভবপর নয়। এরপর কায়রোর বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই বাকি জীবন অবস্থান করেন। এ সময় তিনি তাঁর বিখ্যাত পুস্তক বুক অব অপটিকস এবং জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, সংখ্যাপদ্ধতি, আলোকবিজ্ঞান ও প্রকৃতির দর্শন সম্পর্কে বিভিন্ন গবেষণামূলক পুস্তক রচনা করেন।

উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার 

পিনহোল ক্যামেরা : এটিই পৃথিবীর প্রথম ক্যামেরা। এটিই আজকের আধুনিক ক্যামেরাগুলোর পূর্বসূরি। এটি একটি আলোনিরোধক কাঠের বাক্স। এর কোনো এক পৃষ্ঠে ছোট একটি ছিদ্র হতো, একটি পিন দিয়ে ছিদ্র করলে যতটুকু ছিদ্র হয় ঠিক ততটুকু। তাই এই ক্যামেরার নাম ছিল পিনহোল ক্যামেরা। ছিদ্রযুক্ত তলটি আলোমুখী করে তার সামনে কোনো বস্তু এমনভাবে উপস্থাপন করা হতো, যেন এর ছায়া ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে বিপরীত তলে প্রতিবিম্বিত হয়। এভাবেই সেকালে পিনহোল ক্যামেরা দিয়ে তখনকার সময় পাওয়া যেত কোনো বস্তুর প্রতিবিম্বিত আউটলাইন। ক্যামেরা হিসেবে কখনো ব্যবহার করা হয়েছে কাঠের বাক্স, কখনো ঘর, কখনো দেয়াল।

ক্যামেরা অবসকিউরা : এটিও পিনহোল ক্যামেরার মতোই। তবে এতে কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে। (ওয়ান থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান ইনভ্যানসন্স মুসলিম হ্যারিটেজ ইন আওয়ার ওয়ার্ল্ড, পৃ. ২৬)

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক