বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মমূখী সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করুনঃ ইশা ছাত্র আন্দোলন


Dhaka | Published: 2021-09-18 04:09:43 BdST | Updated: 2024-03-19 15:09:55 BdST

দেশের জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করতে বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মমূখী সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করুন

ইশা ছাত্র আন্দোলন

শিক্ষাই শক্তি। শিক্ষা হচ্ছে যে কোন জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈক অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। যারা যত বেশী শিক্ষিত তারা ততবেশি উন্নত, সভ্য ও অগ্রসর। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বাজধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করলেও এখনো নৈতিকতা সমৃদ্ধ, গঠনমূলক, বিজ্ঞানমূখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারেনি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই সময়ে এসেও শিক্ষা ব্্যবস্থার এই দৈন্যদশা থেকে আমরা উত্তরণ করতে পারিনি। এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

আজ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ শুক্রবারা বিকাল ২:৩০ মিনিটে শাহবাগ জাতীয় যাদুঘর চত্ত্বরে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে জাতীয় শিক্ষা দিবস উপলক্ষ্যে “বিদ্যমান শিক্ষা কাঠামো সংস্কার ও চলমান সংকট নিরসনের দাবিতে শিক্ষা সমাবেশ” এ প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান উপরোক্ত কথা বলেন।

প্রধান অতিথি আরো বলেন, শিক্ষকদের বলা হয় আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে প্রতিনিয়ত ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষকদের নির্যাতিত হতে হচ্ছে ছাত্রদের হাতে। ফলে জীবন সংগ্রামে বিপর্যস্ত এই নাবিকরা দুয়েকটি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে নামলে প্রশাসনের জলকমানের শিকার হতে হয় তাদেরকে। সুতরাং আদর্শিক ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরি করার জন্য শিক্ষার সকল স্তরে কুরআন ও নামাজ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। তবেই আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ¯্নেেহর পরিবেশ তৈরি করতে পারবে।

সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নূরুল করীম আকরাম বলেন, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ ৫০ বছরে পা রাখলেও এখনো আমরা শিক্ষার সংকট থেকে বের হতে পারিনি। এখনো সার্বজনীন শিক্ষা কাঠানো প্রণয়নের জন্য আমাদেরকে রাজপথে নামতে হচ্ছে। ইশা ছাত্র আন্দোলন প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আমরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিভিন্নভাবে বলে আসছি “আদর্শ ও দক্ষ জাতি গঠনে চাই বিজ্ঞান ভিত্তিক কর্মমূখী সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু এসব দয়াদ্র আহ্বানে সরকারের কানে পানি যাইনি যার দরুন আজ শিক্ষা দিবসের এই দিনে বিদ্যমান শিক্ষা কাঠামো সংস্কারের দাবিতে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছি।

সেক্রেটারী জেনারেল শেখ মুহাম্মাদ আল-আমিন এর সঞ্চালনায় আয়োজিত সমাবেশে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে “শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাবনা” পেশ করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি শরীফুল ইসলাম রিয়াদ। বিগত ৫০ বছরে ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর তথ্যবহুল “চরম পত্র” পাঠ করেন সেক্রেটারী জেনারেল শেখ মুহাম্মাদ আল-আমিন।

সমাবেশে আরো উপস্থিত ছিলেন জয়েন্ট সেক্রেটারী জেনারেল গাজী মুহাম্মাদ ওসমান গণী, সাংগঠনিক সম্পাদক এম এম শোয়াইব, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক কে এম শরীয়াতুল্লাহ, প্রকাশনা সম্পাদক ইব্রাহীম হুসাইন, প্রচার ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক নূরুল বশর আজিজী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পাদক এম এ হাছিব গোলদার প্রমূখ।

বার্তা প্রেরক

নূরুল বশর আজিজী
কেন্দ্রীয় প্রচার ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক
ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন

চরমপত্র

আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করছি। কোনো দেশের জন্য সময়ের হিসাবে ৫০ বছর কম-না বেশি, এ নিয়ে মত-দ্বিমত থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে শিক্ষাব্যবস্থা ও এর কাঠামোকে সময়োপযোগী করার মতো যথেষ্ট সময় পাওয়া গেলেও শিক্ষাকে সময়োপযোগী ও কর্মমুখী করা সম্ভব হয় নি,শিক্ষার বিদ্যমান সংকট নিরসনে তেমন তোড়জোড় লক্ষ করা যায়নি।

বস্তুত শিক্ষাই সব শক্তির মূল- এই প্রবাদ বাক্যটি চারশো বছরের পুরনো। ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন কথাটি বলেছিলেন এবং তিনি তার যথার্থ ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। শত শত বছর পরেও কথাটি তার মূল্য হারায়নি। শিক্ষাই শক্তি। শিক্ষা হচ্ছে যে কোন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের মূল চালিকা শক্তি। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত,সভ্য এবং অগ্রসর। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এর প্রতি ওহির প্রথম নির্দেশ ছিল, ‘পড়ো’। অর্থাৎ পবিত্র কুরআনেও সর্বপ্রথম শিক্ষা গ্রহনের আহবান করা হয়েছে। বস্তুত একটি জাতিকে উন্নতির ক্রমবর্ধমান পথে ধাবিত হতে গেলে ও চূড়ায় পৌঁছাতে হলে শিক্ষা ছাড়া অন্য কোন রাস্তা নেই।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নানা রকম সংকটের মুখোমুখি।একদিকে এই সংকট সবার কাছে শিক্ষা না পৌঁছানোর এবং অন্যদিকে যাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে তা যথাযথ মানসম্পন্ন না হওয়ার। এই সংকটের অন্যান্য দিকগুলো হলো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া; পরীক্ষাগুলোয় বড় সংখ্যায় শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্য হওয়া; শিক্ষা উপকরণ, গবেষণাগার, মানসম্পন্ন শ্রেণিকক্ষ অথবা গ্রন্থাগারের অপর্যাপ্ততা এবং যোগ্য শিক্ষকের অভাব থাকা। শিক্ষার্থীরা যে নোট বই ও কোচিং-নির্ভর হয়ে পড়ছে এবং গণিত ও ভাষার ক্ষেত্রে তাদের যে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে, তাও শিক্ষার সংকটকে আরোও ঘনীভূত করছে।

আমরা পাঠদান-পদ্ধতি নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী কোনো পদ্ধতির উদ্ভাবন করতে পারছি না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা জ্ঞানমুখী না হয়ে ক্রমেই সনদমুখী হয়ে পড়ছে। আমাদের বিজ্ঞানচিন্তা, দর্শনচিন্তা সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা একটা নির্দিষ্ট মাত্রাতেই আটকে আছে। বর্তমান তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে আমরা তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জ্ঞানে রূপান্তর এবং জ্ঞানকে প্রক্রিয়াজাত করে প্রজ্ঞার স্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন তা আমাদের শিক্ষা কাঠামো করতে ব্যার্থ হচ্ছি। আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য যখন সীমিত ছিল, তখন শিক্ষার পেছনে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সরকারগুলো দিতে পারেনি। কিন্তু সক্ষমতা যখন বাড়ল, তখনো বিনিয়োগের পরিমাণ প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি।

অন্যদিকে শিক্ষকদের বলা হয় ‘মানুষ গড়ার কারিগর’।কিন্তু শিক্ষকদের জীবনধারণকে সহজ ও সামাজিক মর্যাদাবান করার ক্ষেত্রে সমাজ ক্রমাগত কার্পণ্য দেখিয়েছে। সমাজের পক্ষে রাষ্ট্রও সেই কার্পণ্যের ধারা বজায় রেখেছে। ফলে জীবনসংগ্রামে বিপর্যস্ত এই কারিগরেরা, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে এই দায়িত্ব যাঁরা পালন করেন, সেই শিক্ষকেরা তাঁদের দু-একটি অধিকার আদায়ে রাজপথে নামলে পুলিশের জলকামানের সামনে পড়তে হচ্ছে।

শিক্ষা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। শিক্ষাকে কখনো পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়, এ রকম একটি চিন্তা আমাদের শিক্ষাদর্শনের ভিত্তি। যেদিন থেকে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কোচিং-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা পেল সেদিন থেকে শিক্ষা পণ্যের মোড়কে হাজির হতে থাকল। এটি ঘটছে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী চিন্তার ফলে।আমরা মনেকরি, শিক্ষা যখন পণ্য হয়, তখন শিক্ষার মধ্য দিয়ে উচ্চতর জ্ঞানসাধনার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়, প্রধান হয়ে ওঠে বাজারের চাহিদা।

আবার, দেশে দিন দিন বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীও বাড়ছে। সমান্তরালে উচ্চশিক্ষিত বেকারও বাড়ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, উচ্চশিক্ষিত জনশক্তি ব্যবহার করার কার্যকর পরিকল্পনা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তার মূল লক্ষ্য গবেষণা ও উদ্ভাবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অপরাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
উচ্চশিক্ষা মূলত গবেষণাধর্মী। কিন্তু উচ্চশিক্ষাতে গবেষণা নেই বললেই চলে। পড়াশোনার লক্ষ্যই যেন হয়ে পড়েছে সরকারি বা বড় অংকের বেতনের চাকরি। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘দেশের সবাই যদি চাকরির পেছনে ছোটে, তাহলে তো দেশটা চাকরে ভর্তি হয়ে যাবে; মালিক থাকবে না।’ বাস্তবতা হচ্ছে, প্রকৃত শিক্ষা নিশ্চিত করা না হলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। চলমান সার্টিফিকেটসর্বস্ব বেকার তৈরির শিক্ষাই চলতে থাকবে। দেশের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানে যে অস্থিরতা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নৈরাজ্য চলছে, তা দেশের জন্য ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে।

শিক্ষাখাতকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের ছয় মাসের মধ্যেই শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে নানা রকম কনিশন গঠন করা হয়েছিলো। ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ড. কুদরাত-এ-খুদা কমিশন,১৯৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি, ১৯৭৯ সালে অর্ন্তর্বতীকালীন শিক্ষা কমিটি, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৯৭, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০, শিক্ষা সংস্কার কমিটি ২০০২, জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩, জাতীয় শিক্ষা উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন কমিশন। বর্তমান সরকারও শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার জন্য ২০০৯ সালে অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় শিক্ষা উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। কিন্তু শিক্ষার সংকট সমাধান না হয়ে তা তীব্র থেকে আরো তীব্র হয়েছে।
ঐ কমিশনগুলোর অতিমাত্রায় ইহজগতিকপ্রীতি ও ধর্মবিদ্বেষ সর্বজনবিদিত। তারা স্বজাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে দেখেন ব্রাহ্মণ্যবাদী ও নাস্তিক্যবাদী প্রকরণে এবং তারা যে সাম্রাজ্যবাদ, ইহুদিবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বলয়াবৃত, তা তাদের কৃতকর্মে প্রতিফলিত। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে বিভ্রান্ত বিশ্বাসের অনুবর্তী এসব লোকের উপলব্ধিতে বিজাতীয় সম্প্রকাশ ঘটেছে।ফলে এদেশের শিক্ষা কাঠামো দীর্ঘ ৫০ বছরের পশ্চিমা ও ঔপনিবেশিক কাঠামোর খোলশ মুক্ত হতে পারেনি।

অন্যদিকে কোভিড-১৯ এর কারণে ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে যা স্কুল বন্ধের ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম এবং বাংলাদেশে মহামারির পুরোটা সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার স্তর পর্যন্ত ৪ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ইউনিসেফের রিপোর্টে শিক্ষার্থীদের নানাবিধ ক্ষতির কথাও উঠে এসেছে। যেমন-

১.দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষের বাইরে থেকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ভুলে গেছে। ২. শিশু শ্রম, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩. জাতির ভবিষ্যৎ মেধা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ৪. বড় ঘাটতি নিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠেছে শিক্ষার্থীরা। ৫. পরীক্ষা নিতে না পারায় শেখার দক্ষতা যাচাই হয় নি। ৬. গ্রাম-শহরের শিক্ষার্থীদের বৈষম্য বেড়েছে। ৭. শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ৮. উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ে কর্মজীবনে প্রবেশে পিছিয়ে গিয়েছে।

শিক্ষা সংকট দূরীকরণে ও দেশপ্রেমীক জনশক্তি তৈরিতে আমরা মনে করি প্রশিক্ষিত শিক্ষক, মানসম্মত পাঠ্যবই, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংকল্প ও সদিচ্ছা, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, শিক্ষকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে এবং ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মীয় চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলীর যেমন- ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎ জীবনযাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ, অধ্যবসায় ইত্যাদির বিকাশ ঘটাতে হবে। শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার অবক্ষয় রোধে সকল শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়ে জনসম্পদ গড়তে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। ত্রিধারার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে চূড়ান্ত শিক্ষা কাঠামো ও শিক্ষা আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমরা বলতে চাই, জোড়াতালি দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, এমনকি সরকারি কাজকর্মও চলতে পারে, কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে জোড়াতালির কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা হচ্ছে বিনিয়োগের শ্রেষ্ঠ জায়গা, যার সুফল একটি জাতি ও পুরো দেশ পায়। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে অলাভজনক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করুন। দেশের জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করুন।

প্রস্তাবনা

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষিতজনেরাই একটি জাতির পরিচালক ও কর্ণধার। শিক্ষার গুণেই একজন মানুষ হয় পবিত্র ও আলোকিত। তাই একটি দেশের শিক্ষা, শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে জনআকাঙ্ক্ষিত, পরিকল্পিত ও সুচিন্তিত। শিক্ষা কারিকুলাম হবে সে দেশের মানুষের দীর্ঘকালের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, জাতীয় চরিত্র ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে। যে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা যতো সুন্দর ও বাস্তববাদী, সে জাতি ততো বেশি সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল। আমরা মনে করি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসেবে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গণমানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটুক। শিক্ষা হোক উন্মুক্ত। দেশ ও জাতি হোক আরও সমৃদ্ধ।

প্রিয় শিক্ষার্থী!
দুনিয়ার সকল শিক্ষাবিদই একমত যে, শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো- চরিত্র গঠন, দক্ষতার উন্নয়ন ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে তাকে সমাজের জন্য দক্ষ, যোগ্য ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা হয়। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সুন্দর মনন ও চরিত্র গঠন করার চেষ্টা প্রত্যেক জাতির কার্যসূচির প্রদান অঙ্গ। উন্নত জাতিসমূহের শিক্ষাব্যবস্থায় বাহ্যিক দিক দিয়ে অনেক সামঞ্জস্য থাকলেও মূলত তাদের সকলেরই একই ধরণের চরিত্র সৃষ্টি উদ্দেশ্য নয়। কারণ ভালো-মন্দের পার্থক্যজ্ঞান, নৈতিক মূল্যবোধ, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা এবং জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে ধারণা সবার এক নয়। ফলশ্রুতিতে আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় যে প্রকার মন, মস্তিষ্ক ও চরিত্র সৃষ্টি হচ্ছে, রাশিয়ায় হুবহু তার অনুকরণ হচ্ছেনা। রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় যে মনন সৃষ্টি হচ্ছে, তা চায়না বা কোরিয়াতে চর্চিত হচ্ছেনা। যে জাতির নিকট যে আদর্শ গ্রহণযোগ্য, সেই আদর্শকে সামনে রেখেই তাদের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তেলা হবে। এটাই বাস্তবতা এবং এটাই স্বাভাবিক প্রকৃতি।

প্রত্যেক দেশেরই কোন না কোন আদর্শ থাকে। আদর্শ নির্ধারণ ব্যতীত কোন জাতিই উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে না। যে জাতির কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, সে অপরাপর জাতির উচ্চিষ্ঠভোগী হতে বাধ্য। একটি জাতিকে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যত প্রকার পরিকল্পনাই গ্রহণ করা হোক, তা শেষ পর্যন্ত একই লক্ষ্যের দিকে দেশকে পরিচালিত করবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের বেলায় জাতীয় আদর্শ নির্ধারণ অপরিহার্য।

প্রিয় ছাত্র-জনতা!
আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তী পার করছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমরা একটি সর্বজনবিদিত ও জনআকাক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারিনি। বারবার শিক্ষাআইন, শিক্ষানীতি ও শিক্ষাকারিকুলাম পরিবর্তন করা হলেও জাতীয় চরিত্র বিবেচনায় স্বতন্ত্র কোন শিক্ষাকাঠমো গড়ে ওঠেনি। যার মাঝে দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠির চিন্তা ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটবে। আমরা এখনো বিতাড়িত ব্রিটিশ প্রদত্ত দর্শন ও থিওরি অনুযায়ী আমাদের দেশের শিক্ষক্রম পরিচালনা করছি। অধিকাংশ জনগোষ্ঠি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ড. কুদরতে খুদা প্রণিত ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে অন্যায্য ও অনৈতিক চাপিয়ে দেয়া শিক্ষা সিলেবাসে পাঠদান করছি। অপরদিকে ত্রিমুখী শিক্ষাধারার চলমান ব্যবস্থাপনার ফলে জাতীয় জীবনে চিন্তার ভিন্নতা ও দূরত্ব দিনদিন বর্ধ্বমান। ধর্মহীন কর্মশিক্ষা ও কর্মহীন ধর্মশিক্ষা আমাদের মাঝে তীব্র সঙ্কট সৃষ্টি করে চলেছে। সব মিলিয়ে দেশের সামগ্রিক শিক্ষাকাঠামো আমাদেরকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিদ্যালয়ে জ্ঞান উৎপাদন ও বিতরণের কথা থাকলেও রেঙ্কিংয়ে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠাই করে উঠতে পারছেনা। কোন কোন বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জ্ঞান শিক্ষা দিলেও তাদের চরিত্র গঠন, দক্ষতার উন্নয়ন ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে পারছেনা।

শিক্ষার সকল উপাদান যেমন বিদ্যালয়, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক এবং আধুনিক উপাদান গাইড বই, কোচিং সেন্টার, হাউজ টিউটর, সাজেশন্স ইত্যাদি সবকিছু থাকার পরও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে উত্তীর্ণ অনেক শিক্ষার্থীকে সমাজ তার প্রয়োজনের তুলনায় অনুপযোগী বিবেচনা করছে। বেকার সমস্যা যেন জ্যামিতিক হারেই বাড়ছে। চাকরির বাজারে সীমাহীন প্রতিযোগিতা থাকলেও উদ্যোক্তার বাজারে যেন ক্ষরা চলছে। স্পষ্টতই, সমাজের চাহিদা দ্রুত বদলে যাচ্ছে এবং শিক্ষাব্যবস্থা তার সাথে তাল রেখে চলতে পারছে না। তাহলে বিদ্যমান সমস্যা কোথায়?।

বিদ্যমান শিক্ষা কাঠামো সংস্কারে আমাদের নীতিগত প্রস্তাব:
১. বিদ্যমান শিক্ষা কাঠামো সংস্কার করে একমূখী অন্তর্ভূক্তিমূলক টেকশই শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
২. বিজ্ঞান ভিত্তিক, কর্মমূখী ও সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৩. ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামোর পরিবর্তে নিজস্ব বোধ-বিশ্বাসের আলোকে স্বকীয় জাতীয় শিক্ষাক্রম চালু করতে হবে।
৪. শিক্ষার সকল স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৫. জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে বরেণ্য শিক্ষাবিদ, অভিভাবক প্রতিনিধিদের সাথে বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

বিদ্যমান শিক্ষা কাঠামো সংস্কারে আমাদের প্রস্তাবনা:
১. বাংলাদেশী অভিবাসীরা যে শ্রম দেয় তার তুলনায় অনেক কম রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে। তার কারণ কারিগরি জ্ঞানের অভাব। তাই বাংলাদেশকে কাঙ্খিত উন্নয়নের স্তরে পৌঁছাতে অষ্টম ও দশম শ্রেণির পর বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতির পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলায় ২-৪ বছরের কারিগরি ডিপ্লোমা কোর্স শুরু করা হোক।

২. দ্বাদশ শ্রেণি বা সমমান পাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে সকল নাগরিক বাধ্যতামূলক ছয়মাসের ট্রেনিং নেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হোক। এই ট্রেনিংয়ে প্রতিটি নাগরিককে দেশপ্রেম, দেশের সংবিধান ও দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, ট্রাফিক আইন, মানবিকতা, সমাজকর্ম ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া হোক।

৩. বর্তমানে শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় যেভাবে সরকারী সার্টিফিকেট দেয়া হয়, সেভাবে সেচ্ছাসেবী কাজকে মূল্যায়ন করে সার্টিফিকেট প্রদান করা হোক।

৪. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দরিদ্র ও মেধাবি শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ চালু করা হোক। অন্তত ৫০% শিক্ষার্থীকে মেধা ও আর্থিক সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে দেওয়া হোক বৃত্তি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সরকার এত টাকা খরচ করছে, কিন্তু পকেটমানি জোগাতে আমাদের শিক্ষার্থীদের টিউশনি আর জ্যামের রাস্তায় পার করতে হয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। যদি মাসে পাঁচ হাজার টাকা স্কলারশিপ দেয়া হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের চার-পাঁচ ঘন্টা সময় সাশ্রয় হবে। যে সময়টাতে তারা গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারবে। আশা করি বৈশ্বিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে বাংলাদেশ ইতিবাচক পরিবর্তনের পথেই হাঁটবে।

৫. সময়ের বিবেচনায় এবং সমাজের চাহিদা মাথায় রেখে আমাদের শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে দূরদর্শী চিন্তাভাবনা করতে হবে। আগামী দশ বছরে সমাজে কী ধরনের দক্ষতা, যোগ্যতার প্রয়োজন হবে সে অনুযায়ী শিক্ষাক্রম সাজাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন দশ বছরে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি পর্বেই পাঁচ-সাত বছর কেটে না যায়। সাথেসাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা বিবেচনায় রাখতে হবে অপ্রয়োজনীয় বিষয় বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোনোভাবেই বিষয়বস্তুর ভার শিক্ষার্থীর জন্য অসহনীয় না হয়। প্রত্যেক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাকে মাথায় রাখতে হবে যে, শিক্ষার্থী শুধু একটি বিষয় পড়ে না, তাকে অন্যান্য বিষয়ও পড়তে হয়।

৬. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে ক্যাচমেন্ট এরিয়ার পাশাপাশি জনসংখ্যার ঘনত্বের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। তা না হলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ঠিক থাকবে না। এক্ষেত্রে জনবহুল এলাকার স্কুলগুলোতে এই অনুপাত ঠিক রাখতে শিফট অনুযায়ী বিদ্যালয় পরিচালিত হতে পারে।

৭. মূল্যায়ন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। আধুনিক মূল্যায়ন পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করতে হবে। পাঠ্যবইয়ের সাথে মিল রেখে অভীক্ষা তৈরি করতে হবে। তা হয় না বলেই শিক্ষার্থীরা অভীক্ষার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায় গাইড বইয়ের শরণাপন্ন হয়। খুঁজে ফেরে সাজেশন্স। আর বিদ্যমান মূল্যায়ন পদ্ধতিতে যারা মেধাবী হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে তারা অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তাদের সাফল্য ধরে রাখতে পারছে না

৮. আধুনিক শিখন-শেখানো পদ্ধতির প্রয়োগ, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা, শিক্ষার্থীর শিখনে সাহায্য করা, উপযুক্ত মূল্যায়ন কৌশলের প্রয়োগ সবকিছুর জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক। তার জন্য শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে উপস্থাপন করতে হলে এ পেশায় সম্মান ও সম্মানী দুটোই বাড়াতে হবে। শিক্ষককে দক্ষ করে তুলতে শিক্ষক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি প্রচলিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে তাত্ত্বিক জ্ঞানমূখী বাস্তব দক্ষতা ও তার প্রয়োগমুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. সবশেষে বলতে চাই- আদর্শ শ্রেণিকক্ষে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক যদি সময়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম এমন বিষয়বস্তু সম্বলিত পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করে আধুনিক শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীকে শিক্ষালাভে সহায়তা করেন এবং যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেন তবেই সম্ভব হবে আকাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শিখনফল অর্জন। সার্থক হবে শিক্ষাব্যবস্থা, অর্জন করা সম্ভব হবে শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য। শিক্ষার্থীর জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষার সার্টিফিকেট অটো পাসের মাধ্যমে আসা কিছুতেই কাম্য নয়। এসএসসিতে অটো পাস হলে পড়াশোনায় শিক্ষার্থীদের যে দুর্বলতা থেকে যাবে তার প্রভাব ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবনেও পড়বে।

কোভিড-১৯ পরবর্তী শিক্ষা সংকট নিরসনে আমাদের প্রস্তাবনা:
১. সেশনজট কমিয়ে নিয়ে আসতে আমাদের প্রস্তাবনা
যেখানে সাত কলেজের সামান্য সেশনজট সমস্যা সমাধান করতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে দীর্ঘ ১৮ মাস প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার প্রভাব কি হতে পারে এটি চিন্তার বিষয়। তাই শিক্ষাবর্ষের মেয়াদ কমিয়ে আনা ও শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। প্রতি শিক্ষাবর্ষ থেকে অনধিক তিন মাস করে কমিয়ে দিলে তিন-চার বছর পরে শিক্ষার এ ক্ষতি পুষিয়ে যাবে। অনুরূপভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতি চার মাসের সেমিস্টার থেকে এক মাস করে মাইনাস করলে এক বছরেই আরেকটি সেমিস্টার সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। এটি তুলনামূলকভাবে একটি যুক্তিসংগত ও কার্যকর বিকল্প হবে। ইথিওপিয়ার মত দেশে যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের প্রথম তিন বছর ৯ থেকে ১০ মাসে নিয়ে এসে তাদের পাঠদান চালাতে পারে আমাদের তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

২. অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ
দৈনিক প্রথম আলোর এক রিপোর্টে দেখা যায় শিক্ষা নিয়ে কাজ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ড ও এনসিটিবি। তাদের চিন্তা শুধু স্কুল খোলা ও পরীক্ষা নেওয়া। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তাদের কোন চিন্তা নেই। তাই সংকট চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারি-বেসরকারি, ব্যক্তিগত সংস্থা এবং সুশীলসমাজ ও বিজ্ঞ আলেম ওলামাদের সমন্বয় করে অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. কারিকুলাম ও পাঠ্যক্রম সংকুচিত করা
দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারনে পূর্ব নির্ধারিত সিলেবাসে পাঠদান করতে হলে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে, যা করোনা পরিস্থিতিতে অনেক কষ্টসাধ্য হবে। তাই ক্ষতি পোষাতে আমাদের প্রস্তাবনা হল। শিক্ষা কারিকুলামসহ পাঠ্যক্রম হ্রাস এবং সংশ্লেষিত করা। এমনটি হলে শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে মনোনিবেশ করতে এবং সেগুলো ভালোভাবে শিখতে সক্ষম হবে। যেমন ভারত এবং কানাডায় এটা চালু করে ভাল ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে।

৪. শিক্ষার্থীদের ড্রপআউট রোধ করতে আমাদের প্রস্তাবনা
সম্প্রতি সেভ দ্যা চিলড্রেনসহ শিশুদের নিয়ে কাজ করা ৬টি আন্তর্জাতিক সংস্থার এক গবেষণা রিপোর্টে প্রকাশ যে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪১ ভাগ মেয়ে ও ৩৩ ভাগ ছেলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে, নারী, প্রতিবন্ধী, আর্থিকভাবে অসচ্ছল, আদিবাসী ও পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

৫. আবাসিক হল খোলা রাখার ওপর আমাদের প্রস্তাবনা
ছাত্রাবাস বা আবাসিক হলগুলোতে যাতে শুধু শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে হলে অবস্থান করতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া হলগুলোতেও প্রাথমিক চিকিৎসা এবং শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট নিরসনের সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে কাজ করে পুরোদমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে আবাসিক হলের অবস্থা আর আগের মতো থাকতে পারে না। তাই এখনি বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা করার প্রস্তাব করছি।
৬. বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরপর ক্যাম্পাসগুলোতে অবস্থিত মেডিকেল সেন্টারগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, আইসোলেশনের ব্যবস্থা, অসুস্থ হলে শিক্ষার্থীদের দেখাশোনার ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।
পরিশেষে আমরা আশা করছি, সরকার আমাদের প্রস্তাবনাসহ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে একটি গঠনমূলক শিক্ষাকাঠামো তৈরির মাধমে দেশকে বিদ্যমান শিক্ষাকাঠামো সংস্কার ও চলমান সংকট নিরসনে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

প্রেস রিলিজ

//