
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আমেরিকার হামলার পর হরমুজ প্রণালি বন্ধের একটি প্রস্তাব দেশটির পার্লামেন্টে পাস হয়েছে।
নিউইয়র্ক পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর এখন ইরানের সুপ্রিম কাউন্সিলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। এরপরই এটি কার্যকর হবে।
এই প্রণালি হয়ে বিশ্বের ২০ শতাংশ জ্বালানি তেল রপ্তানি হয়ে থাকে। ইরান যদি এই পথ বন্ধ করে দেয় তাহলে প্রতিদিন অন্তত ১ বিলিয়ন ডলারের তেল পরিবহন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এ প্রণালি বন্ধের স্বল্প মেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। এতে বলা হয়েছে, গত ১৩ জুন ইরানে ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার পর থেকেই জ্বালানি খাতের উদ্যোক্তারা চরম সতর্কতামূলক অবস্থায় ছিল। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সরবরাহে বাধা আসার শঙ্কা তৈরি হয়, বিশেষ করে হরমুজ প্রণালি দিয়ে। ১৩ জুনের পর বেঞ্চমার্ক ব্রেন্টের অপরিশোধিত জ্বালানি বা ক্রুডের দাম ১০ শতাংশ বা ব্যারেল প্রতি ৭৭ ডলারে উন্নীত হয়।
এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে বিশ্ব জ্বালানির বাজারে তাৎক্ষণিক বড় প্রভাব পড়তে পারে। তবে ইতিহাস এবং বাজারের বর্তমান অবস্থা বলছে, উদ্যোক্তারা যতটা দুশ্চিন্তা করছেন, এতটা প্রভাব হয়ত বাজারে পড়বে না।
ইরান কি হরমুজ বন্ধ করতে পারবে?
প্রথমে যে প্রশ্ন সামনে আসছে, ইরান কি আসলেই হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে সক্ষম? এর উত্তর হলো, সম্ভবত হ্যাঁ। ইরান ৫৫ কিলোমিটার প্রস্থের এই প্রণালীতে মাইন পুঁততে পারে। দেশটির আধা সামরিক বাহিনী ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) উপসাগরীয় এলাকায় থাকা বিভিন্ন জলযানে আঘাত করতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে বহুবার এ ধরনের হামলা হয়েছে।
অবশ্য এর আগে কখনোই হরমুজ প্রণালি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে কয়েকবার এতে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৮০ সালে উপসাগরে ইরান-ইরাক যুদ্ধে দুইপক্ষ ‘ট্যাংকার যুদ্ধে’ অবতীর্ণ হয়। এ সময় ইরাক ইরানের জাহাজ এবং ইরান বাণিজ্যিক জাহাজ, সৌদি এবং কুয়েতের তেলের ট্যাংকারসহ মার্কিন জাহাজে হামলা করে।
১৯৮৭ এবং ১৯৮৮ সালে কুয়েতের অনুরোধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান এই এলাকায় নৌবাহিনীকে নিযুক্ত করে। এটি অপারেশন আর্নেস্ট উইল নামে পরিচিত। মার্কিন নৌবাহিনী হামলায় এয়ার ইরানের একটি ফ্লাইটের ২৯০ জন মানুষের প্রাণ গেলে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়।
২০০৭ সালে ইরান এবং মার্কিন নৌবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হলে আবারও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে একটি ইরানি স্পিডবোট আমেরিকার রণতরির সামনে চলে আসে।
২০২৩ সালের এপ্রিল ইরানি বাহিনী ওমান উপসাগরে সেভরনের ভাড়া করা একটি ক্রুড ট্যাংকার জব্দ করে। প্রায় ১ বছর পরে ট্যাংকারটিকে মুক্তি দেওয়া হয়।
উপসাগরীয় অঞ্চলের নৌপথে বাধা প্রধান ইরানের জন্য নতুন কিছু নয়। তবে ইরান এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিলে তা মার্কিন সেনাবাহিনীর তীব্র বাধার মুখে পড়বে।
ইতিহাস যা বলছে
ইতিহাস বলছে এ ধরনের বাধার ফলে বিশ্বে তেল সরবরাহে যে বাধা এসেছে তা স্বল্প মেয়াদি। ১৯৯১ সালে কুয়েতে ইরাকের আগ্রাসনের ফলে অক্টোবরের মাঝামাঝিতে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম প্রায় দ্বিগুণ ব্যারেল প্রতি ৪০ ডলারে পৌঁছায়। পরের বছর মার্কিন জোট অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম শুরু করলে জানুয়ারি নাগাদ দাম স্বাভাবিক হয়।
২০০৩ সালের মার্চ ও মে মাসে দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় প্রভাব ছিল আরও কম। ২০০২ সালের নভেম্বর থেকে ২০০৩ সালের মার্চের মধ্যে বাজারে ৪৬ শতাংশ উত্থান হয়। কিন্তু মার্কিন সেনা অভিযান শুরুর পর তা দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসে।
একই ভাবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে ব্যারেল প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে হয় ১৩০ ডলার। কিন্তু আগস্টের মাঝামাঝিতে এসে দাম নেমে আসে ৯৫ ডলারে।
জ্বালানি মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান পিভিএমের বিশ্লেষক টামাস ভার্গা বলছেন, জ্বালানির দামের দ্রুত পতন মূলত তখনকার পর্যাপ্ত অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা এবং দ্রুত চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে হয়েছিল।
জ্বালানির বাজারে আঘাত এসেছিল ১৯৭৩ সালে আরবের তেল নিষেধাজ্ঞা এবং ১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লবের পর। সে সময় ইরানের তেলের খনিগুলোতে উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। অবশ্য এসবের সঙ্গে হরমুজ বন্ধের কোনো সম্পর্ক ছিল না বা আমেরিকাও সরাসরি কোনো সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
অতিরিক্ত সক্ষমতা
বর্তমানে বিশ্বে তেলের যে বাজার তার যথেষ্ট অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। জ্বালানি উৎপাদক দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাসের বর্তমানে দৈনিক ৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন ব্যারেল অতিরিক্ত জ্বালানি উৎপাদন সক্ষমতা আছে। এরমধ্যে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের সক্ষমতাই ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন ব্যারেল।
তবে শঙ্কার বিষয় হলো আজকের দিনে সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত যে তেল সরবরাহ করে তার বড় অংশ হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে।
উপসাগরীয় এই দুই শক্তি অবশ্য হরমুজের পরিবর্তে পাইপ লাইন দিয়েও সরবরাহ জারি রাখতে পারে। বিশ্বের শীর্ষ জ্বালানি তেল উৎপাদক সৌদি আরবের বর্তমান সক্ষমতা প্রতিদিন ৯ মিলিয়ন ব্যারেল। দেশটির উপসাগরীয় উপকূলের আবকাইক তেলক্ষেত্র থেকে লোহিত সাগর সংলগ্ন শহর ইয়ানবুর মধ্যে দীর্ঘ ক্রুড পাইপলাইন আছে। এই পাইপলাইনের সক্ষমতা প্রতিদিন ৫ মিলিয়ন ব্যারেল। ২০১৯ সালে সাময়িকভাবে এই সক্ষমতা আরও ২ মিলিয়ন ব্যারেল বৃদ্ধি করা হয়েছিল।
গত এপ্রিলে দিনে ৩ দশমিক ৩ ব্যারেল ক্রুড উৎপাদন করেছে আরব আমিরাত। দেশটির ফুজাইরাহ তেল টার্মিনালের সঙ্গে বিভিন্ন তেলক্ষেত্রের মধ্যে দৈনিক ১ দশমিক ৫ ব্যারেল তেল পরিবহন করতে পারে এমন পাইপলাইন আছে।
সমস্যা হলো, এই পাইপলাইনগুলোতে ইরান সমর্থিত হুতি গোষ্ঠী হামলা চালাতে পারে। সম্প্রতি সুয়েজ খাল দিয়ে জাহাজা চলাচলে গোষ্ঠীটি ব্যাপক বাধা তৈরি করেছে। ইরাক, কুয়েত এবং কাতারের সামনে হরমুজের কোনো বিকল্প নেই।
অবশ্য এটাও সম্ভব যে, ইরান হয়ত হরমুজ প্রণালি অবরোধের মতো নাটকীয় কোনো পদক্ষেপ নেবে না। কারণ এতে তার নিজেরও তেল রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তেহরান হয়তো আমেরিকার সঙ্গে নতুন কোনো উত্তেজনাকে অর্থহীন বিবেচনা করতে পারে এবং পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলাকে গুরুত্বহীন বিবেচনা করে আবারও আলোচনার টেবিলে ফিরতে পারে।
চরম পরিস্থিতিতেও যদি হরমুজ প্রণালি সম্পূর্ণ অবরোধের মুখে পরে ইতিহাস বলছে, বাজারে এর কোনো ধাক্কাই দীর্ঘস্থায়ী হবে এমন আশা করা ঠিক হবে না।