ঢাকা মেডিকেল কলেজের মডার্ন মেধাবী হুজুর


টাইমস অনলাইনঃ | Published: 2018-06-01 08:36:16 BdST | Updated: 2024-04-23 12:31:20 BdST

জুবায়ের বিন মেসবাহঃ আমার জন্মের কিছুদিন পরেই আমাকে ওমান চলে যেতে হয়। বাবা ছিলেন ওমানের এক মসজিদের ইমাম। আমার শৈশবের প্রথম ৪টি বছর ওমানেই কাটে। আমার শিক্ষার হাতে খড়ি বাবার হাত ধরে। বাবা একবার হজ্বে গিয়ে পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ ধরে মনে মনে দোয়া করেছিলেন আমি যাতে কুরআনের হাফেজ হতে পারি। আল্লাহ বাবার সেই দোয়া কবুল করেছেন। আমার জীবনের সেরা অর্জনের কথা যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আমি নির্দ্বিধায় বলব পবিত্র কুরআন শরীফ স্মৃতিতে এবং হৃদয়ে ধারণ করার যোগ্যতা অর্জন করা।

আমার একাডেমিক লাইফের শুরুটা একদমই মসৃণ ছিল না। ৫ বছর বয়সে ওমান থেকে দেশে ফিরে আসি। এর মাঝে ঘটে যায় আমার জীবনের সবচেয়ে ট্র‍্যাজিক ঘটনা। গলায় হাড় বিঁধে, ভুল চিকিৎসায় আমার জীবনের ২ টি মূল্যবান বছর যায় নষ্ট হয়ে। আমার ক্লাস ১-৪ এর বিষয়গুলি পড়িয়েছিলেন আমার বাবা। মাদরাসায় একেবারে ভর্তি হই ক্লাস ফাইভে। হঠাৎ করে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল আমাকে। কিন্তু তারপরেও আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি তে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় বরিশাল বোর্ডে প্রথম স্থান অর্জন করি। এরপর ভর্তি হই নেছারাবাদ মাদ্রাসার জামাতে তাহেলীতে । সেখানে ৬ষ্ঠ,৭ম,৮ম-তিন ক্লাসের পড়া ১ বছরে পড়ানো হত। সেখানেও বেশ পরিশ্রম করতে হয় আমাকে এবং আল্লাহর মেহেরবানিতে জুনিয়র বৃত্তিতেও অর্জন করি প্রথম স্থান। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর এসএসসি,এইচএসসিতে ভাল ফল অর্জনের পর প্রথমবারের চেষ্টাতেই টিকে যাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এখানেও প্রথম পেশাগত পরীক্ষায় অর্জন করি তৃতীয় স্থান।

আমি যখন হাফেজী মাদ্রাসায় ভর্তি হই, ওখানকার নিয়ম অনুযায়ী ভোর চারটায় পড়া দিতে হত। কিন্তু ছোটবেলায় আমার ছিল ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স এর সমস্যা । রাতে নাপাক হয়ে যাওয়ায় বাবা প্রতিদিন ভোর ৪টার আগে আমাকে বাসায় নিয়ে গোসল করিয়ে নিয়ে আসতেন। আমার হেফজ করার পুরো সময়টা বাবার যে সাহায্য পেয়েছিলাম সেটা ছাড়া আমার হাফেজ হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। এসব কষ্ট দূর হয়ে যায় যখন বাবা আমার ইমামতিতে রমজানের তারাবি আদায় করতেন। ২০০৬ থেকে ২০১৩, পুরোটা সময় প্রত্যেক রমজানে বাবার ইমামতিতে আমি আদায় করতাম এশার সালাত।এরপর আমার ইমামতিতে বাবা তারাবির সালাত আদায় করতেন। আমার তিলাওয়াত ছিল বাবার খুব পছন্দের। নামাজের মাঝে মাঝে পিছনে ফিরে দেখতাম বাবা কাঁদছেন। বাবা নামাজের বিরতিতে প্রায়ই খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরতেন। এটা সন্তান হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। মেডিকেলে আসার পর থেকে আর নামাজ পড়ানো হয় না। সেই সময়গুলোর কথা খুব মনে পড়ে।

মাদ্রাসায় পড়ার সময় আমি প্রথমদিকে ইংরেজিতে খুব দুর্বল ছিলাম। আমার একটা চ্যালেঞ্জ ছিল যে করেই হোক ইংরেজিতে ভাল করতে হবে। তাই সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ত শুরু হত আমার নতুন যুদ্ধ। একটা সময় এতটাই প্রোগ্রেস করি যে কলেজে ওঠার পর সবাই আমাকে ইংরেজির জোবায়ের বলে ডাকা শুরু করল। আর ক্যাম্পাসে যত প্রোগ্রাম হত,যেমন-গান, নাটক, ডিবেট; প্রতিটার ইংরেজি সেগমেন্টে আমার অংশগ্রহণ আর পুরস্কার পাওয়া নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। ইংরেজি ছাড়াও বাংলা ডিবেট করতাম। পুরস্কার পেয়েছিলাম বরিশাল জেলা ডিবেটিং সোসাইটি থেকে "The most promising debater of the year" হিসেবে। এছাড়া গানও গাইতাম টুকটাক। একবার রবীন্দ্র সংগীত প্রতিযোগিতায় পেয়েছিলাম প্রথম পুরস্কার। বন্ধুরা এজন্য আমাকে মাঝেমধ্যে ডাকে 'মডার্ন হুজুর' বলে। এতকিছু করলেও আমি যে হাফেজ এই সম্মানজনক অবস্থানের কোন অসম্মান জ্ঞাতসারে কখনো করিনি আমি।

একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে যখন ওয়ার্ডে যাই, আমার পোশাকের কারণে দেখি রোগীর লোক আমাকে খুব শ্রদ্ধা করে এবং আমার কথা মন দিয়ে শুনে। বন্ধু মহলেও সবাই আমাকে খুব ভালবাসে। এসব কিছুর জন্য আমি কৃতজ্ঞ সৃষ্টিকর্তার প্রতি। আমার মনে হয় আমার অন্তরে কুরআনের যে আলো প্রবেশ করেছে সেটাই আমাকে আত্মিকভাবে অনেক শান্তি এবং সম্মান দিয়েছে। একজন ডাক্তার সাধারণত রোগীকে কেবল দাওয়া দিতে পারেন, কিন্তু একজন হাফেজ হিসেবে দোয়া এবং দাওয়া এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটানোর সক্ষমতা মহান আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন।

লেখাটি হিউম্যান্স অব ডিএমসি পেজ থেকে নেয়া

বিদিবিএস