ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষা জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে। গত মে, জুন ও জুলাই এই তিন মাসে ক্যাম্পাসটাইমসের পক্ষ থেকে দুই হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে আমাদের নির্ধারিত ১০ জন প্রতিনিধি।
শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ শিক্ষা পরবর্তী জীবনে কি করে চলবেন অথবা পরিবার কিভাবে চালাবেন এ বিষয় হতাশা প্রকাশ করেছেন। অনেকেই প্রত্যাশা অনুযায়ী সাবজেক্ট না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, চাকরির বাজারে এসব বিভাগের গুরুত্ব খুবই কম।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি হচ্ছেনা। এমনকি চাকরির কোন নিশ্চয়তাও নেই। ৫ বছরের একাডেমিক পড়াশুনার ৫ ভাগও চাকরি পরীক্ষায় কাজে আসেনা।
সারাদিন লাইব্রেরিতে পড়াশুনা করেও চাকরি না পেয়ে গত ৫ বছরে হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৫ জন সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থী। তবে এদের কয়েকজন প্রত্যাশার চেয়ে নিম্নমানের চাকরি করতেন। যা তাদের হতাশায় নিমজ্জিত করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সারির একটি বিভাগ থেকে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণি পাওয়া শাকিল আদনান (ছদ্ম নাম) চাকরি খুঁজছেন ২০০৮ সাল থেকে। কিন্তু আজও তিনি চাকরি পাননি। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে লিখিত সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ঘুষের টাকা না থাকায় আজও তিনি বেকার।পরীক্ষা আর ভাইভা দিতে দিতে এখন তার চোখে-মুখে চরম হতাশা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করা ফখরুল ইসলামও চাকরি না পেয়ে ৩ বছর পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
কেবলশাকিল আদনান বা ফখরুল ইসলামই নয়, তাদের মতো সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা শেষ করে বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রায় অর্ধকোটি শিক্ষিত বেকার।
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, কাজের সুযোগ না পেয়ে অসংখ্য বেকার যুবক হতাশা থেকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। হতাশা থেকে আত্মহননের পথও অনেকে বেছে নিচ্ছেন। একই কারণে নিকটাত্মীয়কে হত্যা করার মতো ঘটনাও এই সমাজে ঘটছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা ড. মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী বলেন, দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়লে সামাজিক অস্থিরতাও বাড়বে। নতুন নতুন অপরাধ প্রবণতাও বাড়বে। শিক্ষিত যুবকদের অনেকেই হতাশা থেকে মাদকের সংস্পর্শে আসছেন। এই সুযোগে মাদক বাণিজ্যসহ অনেক বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আয় রোজগারের পথ খুঁজছেন অনেকে।
সোহেল রানা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, খেটে খেয়ে না খেয়ে করেছি পড়াশুনা কিন্তু মিলল না একটি চাকরি।
কী করে পূরন করব আমার মায়ের আশা, শিক্ষিত হয়ে পারিনা আমি। গ্রামে কাজ করতে, পারি না আমি মাথায় ডালি নিতে। পারি না আমি গায়ে গায়ে ফেরি করতে, সরকার আপনি বুঝুন শিক্ষিত বেকারদের জ্বালা কতটা ।
ইউজিসির তথ্য মতে, জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমবেশি ২৯ লাখ। এর বাইরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাড়ে তিন লাখের মতো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ৩৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছে ৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৮২ জন। ওই বছর ৭৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে ৬৫ হাজার ৩৬০ জন। সব মিলিয়ে ২০১৪ সালে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ৩০২ জন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছে। এর বাইরে পাশ করতে পারেনি বা ঝরে গেছে এমন শিক্ষার্থী সংখ্যা আরও বেশি। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা সম্পন্ন করেছে আরও কয়েক লাখ যুবক। কিন্তু এদের মধ্যে চাকরি হয়েছে হাতে গোনা কিছু যুবকের। একইভাবে প্রতি বছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন, অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমদ বলেন, উচ্চ শিক্ষিতরা বেকার হওয়ার কারণে সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। তিনি বলেন,বেসরকারি খাতে শ্রমিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের দরকার হয় ৭০ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের ৯০ শতাংশই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত, যার সঙ্গে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার সম্পর্ক থাকে না। এ কারণে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।
মোটা দাগে হতাশার মূল কারণঃ
১। চাকরি সঙ্কট
২। প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরি হচ্ছেনা
৩। অনার্স মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি পেতে দীর্ঘ সময় লাগছে
৪। পারিবারিক অর্থনৈতিক সঙ্কট
৫। চাকরি পরীক্ষার জন্য আলাদা পড়াশুনা
৬। চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি
৭। অনেকেই পড়াশুনার সময় নষ্ট করে ঘুরেফিরে দিন কাটিয়েছেন
৮। সামিজক প্রত্যাশার চাপ
৯। জুনিয়ররা হতাশ হচ্ছেন, সিনিয়রদের চাকরি না হওয়ায়
এমএসএল