দেশে প্রথমবারের মতো পটেটো গ্রেডার উদ্ভাবনের দাবি বাকৃবি গবেষকের


Md Likhon Islam | Published: 2024-03-25 16:23:12 BdST | Updated: 2024-04-27 18:24:52 BdST

বিশ্বে বর্তমানে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। দেশের বাৎসরিক আলুর উৎপাদন এখন প্রায় কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন টনের অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে আলুর উৎপাদন হয় ১১ মিলিয়ন টনেরও বেশি। যা চাহিদার তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত উৎপাদিত আলু। কিন্তু যথাযথ প্রক্রিয়ায় বাছাইকরণ এবং সংরক্ষণের অভাবেই এসব অতিরিক্ত আলু নষ্ট হয়ে যায়। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমমূল্যের। উৎপাদন পরবর্তী সংরক্ষণের অন্যতম বাধা সঠিক প্রক্রিয়ায় আলু বাছাইকরণ ও রোগাক্রান্ত আলু সনাক্তকরণ। কারণ যথাযথ ভাবে রোগাক্রান্ত আলু সনাক্ত না করার কারণে ভালো আলুও সংক্রমিত হয়ে যায়। ফলে একসাথে সংরক্ষিত সকল আলু রোগাক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এতে একদিকে কৃষক যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তেমনি দেশের মোট জিডিপিও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বিদেশের বাজারে আলু রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অপার সম্ভাবনা।

দেশ ও কৃষকের এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। গবেষণার মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো স্বয়ংক্রিয় আলু বাছাই করার যন্ত্র (অটোমেটেড পটেটো গ্রেডিং মেশিন) উদ্ভাবনের দাবি করেছেন প্রকল্পের প্রধান গবেষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান। উদ্ভাবিত ওই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটির মাধ্যমে আলুর আকার, রং এবং ক্রটি (কোনো ক্ষত আছে কিনা, কোনো দাগ-ছোপ আছে কিনা) নির্ণয় করে বাছাই করতে পারবে। এতে আলুর সংরক্ষণ পরবর্তী ক্ষতি অনেকটাই কমে যাবে বলে আশাবাদী গবেষক দলের সদস্যরা।

ড. আনিসুর রহমান জানান, ‘মেশিন ভিশন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আলুর জন্য স্বয়ংক্রিয় গ্রেডিং পদ্ধতি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যন্ত্রটির গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। দুই বছর মেয়াদি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা অর্থায়ন করে বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেম (বাউরেস)। বর্তমানে যন্ত্রটির অধিকতর উন্নয়নের জন্য গবেষকদল কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি। ইতোমধ্যে প্রকল্পের গবেষণাপত্রটি আন্তর্জাতিক সাইন্টিফিক জার্নাল ‘স্মার্ট এগ্রিকালচার টেকনোলজি’এ জমা দেওয়া হয়েছে এবং তা প্রাথমিকভাবে প্রকাশনার জন্য নির্বাচিতও হয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রধান গবেষক জানান, যথাযথ প্রযুক্তির অভাবে দেশে কৃষকরা হাত ও চোখের আন্দাজেই আলু গ্রেডিং এবং সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে থাকে। এতে আলু সঠিক প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণ নিয়ে বিপাকে পড়েন তারা। মাঠ থেকে আলু তোলার পর সংরক্ষণের জন্য আকার, রং ও ক্রটি অনুযায়ী বাছাই (গ্রেডিং) করা অন্যতম প্রধান কাজ। খালি চোখে বা কোনো ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া সেটি গ্রেডিং করা হলে নির্ভুলভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া খালি চোখে আলুর আকার ও রোগ ভালোভাবে বুঝা যায়না। এতে রোগাক্রান্ত আলু থেকে যায় এবং সংরক্ষিত অন্যান্য আলু নষ্ট করে দেয়। উদ্ভাবিত গ্রেডিং যন্ত্রটি এ সমস্যা দূর করবে।

তিনি আরোও বলেন, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটি সরবরাহকৃত প্রতিটি আলুর ছবি নিবে এবং তা প্রক্রিয়াকরণ করবে। এরপর যন্ত্রটি আলুর রং, আকার ও রোগাক্রান্ত অংশ সনাক্তকরণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিবে কোন আলু কোন গ্রেডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সে অনুযায়ী মোটরের মাধ্যমে আলু বাছাই করবে যন্ত্রটি। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের আলু বাছাইয়ে স্বয়ংক্রিয় এই যন্ত্রটির সফলতা হার ৮৬ শতাংশ। প্রতি ঘন্টায় এটি ৩০-৩৫ কেজি আলু গ্রেডিং করতে পারে। যন্ত্রটির অধিকতর উন্নয়ন কার্যক্রম হিসেবে প্রতি ঘন্টায় আরো বেশি পরিমাণে আলু গ্রেডিং করা এবং তার সফলতার হার আরো কয়েক শতাংশ বৃদ্ধি করা নিয়ে কাজ করছি।

যন্ত্রটি সম্পর্কে মাস্টার্সের শিক্ষর্থী আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলেন, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটিতে রয়েছে মোটরচালিত ৭ ফুট দীর্ঘ ও ১.৫ ফুট প্রস্থের কনভেয়ার বেল্ট (আলু পরিবহনের জন্য), ছবি তোলা ও বিশ্লেষণের জন্য কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ক্যামেরা, এলইডি লাইটিং সিস্টেম এবং প্রতিটি গ্রেডের আলুকে সুনির্ধারিত স্থানে রাখতে সার্ভো মোটর ও মাইক্রোকন্ট্রোলারের সমন্বয়ে নিক্ষেপন পদ্ধতি। যন্ত্রটিতে ছবি বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ম্যাটল্যাব প্রোগ্রাম, যা খুবই সহজে ও দ্রুত আকার নির্ধারণ এবং পূর্ব নির্ধারিত আলুর আকারের সাথে তুলনা করে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে। যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিন আকারের আলু বাছাই করতে পারে। কম্পিউটার প্রযুক্তনির্ভর হওয়ায় হাতে গ্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টিগোচর না হওয়া সব ক্রটিও ধরা পড়বে যন্ত্রটিতে। ফলে যথাযথভাবে কম সময় ও পরিশ্রমে আলু সংরক্ষণ সম্ভব হবে এবং উৎপাদিত অতিরিক্ত আলু বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বার উন্মোচন হবে।