তৃণমূলে ধুঁকছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ


ঢাকা | Published: 2021-03-12 16:29:27 BdST | Updated: 2024-04-29 04:54:58 BdST

যেকোনো মুহূর্তে ৩০তম সম্মেলনের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে বিক্ষোভ মিছিল

শিগগিরই হচ্ছে, হবে- দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা নেতাদের এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েই দিন পার করছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। কিন্তু ঘোষণা করছেন না বছরের পর বছর মেয়াদোত্তীর্ণ থাকা জেলা ও উপজেলা কমিটি। ইতিমধ্যে জয় ও লেখক তাদের দায়িত্বের ১৮ মাস সময় পার করেছেন। কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে সাংগঠনিক কোন পরিবর্তনই আনতে পারেননি তারা। দিনে দিনে এই দুই শীর্ষ নেতার প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতাদের। অনেকেই ৩০ তম সম্মেলন দাবি করে ফেসবুকে লেখালেখি করছে।

এদিকে ক্ষোভে-হতাশায় সম্ভাবনাময় অনেক তরুণই ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনে। দীর্ঘদিন ধরে কমিটি নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ইউনিটে এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল কলেজ, ইডেন কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে।

ছাত্রলীগের তৃণমূল নেতাদের ভাষ্য, জেলা ও উপজেলা কমিটি দেওয়ার বিষয়ে হাইকমান্ড থেকে কোনো বাধা নেই। যত বিপত্তি কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃত্বে। মূলত শীর্ষ এই দুই নেতা জেলায় যার যার মতো বলয় তৈরি করতে চাইছেন। সঙ্গে রয়েছে টাকার বিনিময়ে নেতা বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির অভিযোগ।

গুরুত্বপূর্ণ দুই জেলার সভাপতি পদপ্রত্যাশী ছাত্রলীগ নেতা জানান, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক একসঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচিতে গেলেও বিগত শোভন-রাব্বানী কমিটির মতোই গ্রুপিং রাজনীতি অব্যাহত রেখেছেন। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে তৃণমূল- সব জায়গাতেই তারা তৈরি করছেন ‘মাইম্যান’।

কেন্দ্রীয় কমিটির জয় ও লেখক এর কাছের গুটিকয়েক নেতার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে বিভিন্ন কাজ এবং তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলা নেতা পছন্দ করা হচ্ছে। এমনকি নেতা হওয়ার জন্য বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার প্রার্থীরা জয় ও লেখক এর পরিবারের সদস্যদের তোষামোদি করছেন এবং তাদের বন্ধুদের পেছনে পেছনে ঘুরতে হচ্ছে।

জেলা ও উপজেলা কমিটিতে যোগ্যতার চেয়ে পছন্দকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাই বেশিরভাগ জেলাতেই সভাপতি ও সাধরণ সম্পাদক পদে নিজেদের লোক বসাতে দুজনের মধ্যে চলছে তুমুল দ্বন্দ্ব। জয় একজনকে চাইছেন কিন্তু লেখকের পছন্দ আরেকজন। কেউ কাউকে ছাড় না দেওয়ায় কমিটি দিতেও বিলম্ব হচ্ছে।

জয় ও লেখক

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, নেত্রী কেন্দ্রীয় সম্মেলনের বিষয়ে কোন নির্দেশ দেননি। সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা সম্মেলন নিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরপরই কমিটি গঠন ও জেলা পর্যায়ের কমিটির বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। আর মার্চ মাসের কর্মসূচি বাস্তবায়নে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন নেত্রী।

সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) দুপুরে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে গণভবনে ডাকেন সংগঠনের অভিভাবক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পরপরই সংগঠনকে গতিশীল করতে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে নতুন কমিটি এবং জেলা কমিটির বিষয়েও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান জয় এ বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সম্মেলন করার কোনো গাইডলাইন বা নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এখনও আমাদের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। সম্মেলনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে—যারা এ ধরনের কথা ছড়াচ্ছে, আমরা মনে করি তারা গুজব ছড়াচ্ছেন। তাদের নিশ্চয় অন্য কোনো এজেন্ডা আছে।’

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের দেশব্যাপী ১১১টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। এর মধ্যে ১০৪টিই মেয়াদোত্তীর্ণ। দেশের অন্যতম এই প্রাচীন ছাত্র সংগঠনটির কোনো কোনো ইউনিট কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে নয় বছর আগে। এগুলোর কয়েকটিই ২০০৬-২০১১ সালের মাহমুদ হাসান রিপন ও মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন কমিটির দেওয়া কমিটি। অথচ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ছাত্রলীগের ইউনিট কমিটির মেয়াদ এক বছর। আর কেন্দ্রীয় কমিটি হয় দুই বছর মেয়াদি। এর মধ্যে অন্তত ৩৭টি জেলা শাখার মেয়াদ শেষ হয়েছে চার থেকে নয় বছর আগে। ৭২টি চলছে দুই থেকে তিন বছরের পুরনোদের নেতৃত্বে। আবার কয়েকটিতে কোনো কমিটিই নেই। সব মিলিয়ে এসব জেলার নেতাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। ছাত্রলীগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট বলে বিবেচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। সংগঠনটির ‘প্রাণ’ ১৮টি আবাসিক হল কমিটিরও মেয়াদ ফুরিয়েছে অনেক আগে। অথচ সেশনজট, ছাত্রলীগের বয়সসীমা, শিক্ষাজীবনের সমাপ্তির কারণে কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ না পেয়ে ছাত্রত্ব শেষ করছেন সংগঠনটির অনেক ত্যাগী কর্মী।

ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, জয়-লেখকের সময়ে কেবল প্রেস রিলিজ দিয়ে ঘোষণা হয় কুষ্টিয়া, নড়াইল, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, কক্সবাজার ও গোপালগঞ্জ জেলার কমিটি। সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে রাজশাহী মহানগর কমিটি এবং দ্রুতই দেয়া হবে পটুয়াখালী জেলার কমিটি। অথচ কথা ছিল সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি দেওয়ার। এক্ষেত্রে অবশ্য করোনার দোহাই। আবার মাসে একটি সাধারণসভা হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি গত এক বছরে।

শুধু তাই নয়; বিভিন্ন জেলা, মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে একটি টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংগঠনের সহসভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, সহসম্পাদক, সম্পাদক, উপসম্পাদক ও সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয় এই টিম। কিন্তু ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই সম্মেলন করে ছাত্রলীগের কমিটি হলেও আজ পর্যন্ত বণ্টন হয়নি সাংগঠনিক দায়িত্ব। ফলে এক রকম বিশৃঙ্খলভাবেই চলছে বিভিন্ন কার্যক্রম, যার প্রভাব পড়ছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত।

ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের পর ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই সভাপতি পদে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক পদে গোলাম রাব্বনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগে পূর্ণাঙ্গ মেয়াদে দায়িত্ব পালনের আগেই ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ওই দুই নেতা। তাদের অব্যাহতির পর সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য। মাস তিনেক ভারপ্রাপ্ত থাকার পর ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাদের পূর্ণ দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

এদিকে প্রায় প্রতিদিনই ছাত্রলীগ কোথাও-না-কোথাও নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে কিংবা প্রতিপক্ষের হাতে মারধরের শিকার হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, এটি কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের নেতৃত্বের দুর্বলতা। ছাত্রলীগকে ঢেলে সাজানোর এটাই সর্বোচ্চ সময়। অন্যথায় জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে তখন ছাত্রলীগ সাজান সম্ভব নয়।