নির্বিচার বোমা হামলার পর এবার ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। উপত্যকাটিতে খাবার, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হচ্ছে। এতে বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত গাজায় ভয়ানক মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে।
ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হামলার জবাবে শনিবার থেকে গাজায় বোমা হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলের বিমানবাহিনী। এরই মধ্যে গতকাল সোমবার উপত্যকাটি সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হলো। গাজায় স্থল অভিযানের জন্য সেনা সমাবেশও ঘটানো হয়েছে। এ লক্ষ্যে তিন লাখ সংরক্ষিত সেনাকে বাহিনীতে যুক্ত করেছে ইসরায়েল।
গাজা সম্পূর্ণ অবরোধ করার অর্থ হচ্ছে, গাজা উপত্যকায় জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো কিছুই ঢুকতে দেবে না ইসরায়েল। গতকাল দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওয়াভ গ্যালান্ট বলেছেন, ‘আমি গাজা উপত্যকা সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দিয়েছি। বিদ্যুৎ, খাবার, গ্যাসসহ সবকিছুই সেখানে বন্ধ থাকবে।’ শনিবার থেকেই গাজায় বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ বন্ধ করা শুরু হয়েছে।
ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী গাজা উপত্যকার সীমান্তের বড় অংশ ইসরায়েলের সঙ্গে, বাকিটা মিসরের সঙ্গে। গাজার আকাশপথ ও সৈকত ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। সেখান দিয়ে কারা যেতে পারবে এবং কী পণ্য ঢুকতে পারবে, সে বিষয়ে বিধিনিষেধ রয়েছে ইসরায়েলের। ফলে ইসরায়েল চাইলেই গাজা ঘিরে অবরোধ জারি করতে পারে।
শনিবার ইসরায়েলে হামাসের রকেট হামলার পর থেকেই একটি জল্পনা ছিল, গাজায় নজিরবিহীন স্থল অভিযানও শুরু করবে ইসরায়েল। এ নিয়ে ইসরায়েল বাহিনীর প্রধান মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হ্যাগারি বলেন, দুই দিনে তিন লাখ সংরক্ষিত সেনাকে বাহিনীতে যুক্ত করা হয়েছে। এর আগে এত সংখ্যক সংরক্ষিত সেনা একত্র করা হয়নি। ইসরায়েল স্থল হামলা শুরু করবে।
বেড়েই চলেছে রক্তপাত
শনিবার সকালে হামাসের চালানো রকেট হামলাটি ছিল নজিরবিহীন। জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজার বিভিন্ন আবাসিক এলাকা, টানেল, মসজিদ, শরণার্থীশিবির ও হামাস নেতাদের কার্যালয়ে হামলা চালানো হচ্ছে। রোববার রাতভর ও গতকাল সারা দিনও চলেছে হামলা। গতকাল ইসরায়েলি বিমানবাহিনী জানিয়েছে, সর্বশেষ ২০ ঘণ্টায় গাজায় প্রায় দুই হাজার বোমা ফেলা হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে ‘সর্বোচ্চ শক্তি’ প্রয়োগ করবেন তাঁরা।
বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, ইসরায়েলের বিমান হামলায় ধ্বংস হওয়া ভবনগুলোতে জীবিতদের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। হামলার পর গাড়িতে লাগা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন জরুরি সেবা দলের সদস্যরা। গাজা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত (গতকাল রাত সাড়ে ১২টা) প্রায় ৬০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
নিহত ইসরায়েলি নাগরিকদের মধ্যে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় মরুভূমিতে একটি উৎসবে যোগ দেওয়া অন্তত ২৬০ তরুণ-তরুণী রয়েছেন। গত শনিবার ওই অনুষ্ঠানে হামলা চালান ইসরায়েলে প্রবেশ করা হামাস যোদ্ধারা। অনেক ইসরায়েলিকে আটকও করেছেন তাঁরা।
গতকালও ইসরায়েলের বেশ কিছু এলাকায় হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনীর লড়াই চলেছে। এ নিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি বলেন, গাজা সীমান্তের কাছে সব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন তাঁরা। তবে ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীদের সঙ্গে এখনো বিচ্ছিন্ন লড়াই চলছে।
এদিকে পশ্চিম তীরও অবরুদ্ধ করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সেখানে শহরগুলোর প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় বসানো হয়েছে সেনা তল্লাশিচৌকি। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন পশ্চিম তীরের বাসিন্দারা। গতকাল এ অঞ্চলের রামাল্লায় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে চার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
সংকটে গাজাবাসী
গাজায় প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস। এর মধ্যে হামলার পর ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৩৮ ফিলিস্তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘরবাড়ি ছেড়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থা ওসিএইচএ বলছে, এই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ৭৩ হাজার বিভিন্ন স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর মুখপাত্র আদনান আবু হাসনা মনে করেন, বাস্তুচ্যুত এই মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে।
গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে রোববার বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। সেদিন থেকেই গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। বিবৃতিতে জাতিসংঘ বলেছে, ইসরায়েল বিদ্যুৎ বন্ধের পর গাজার একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রটি শেষ সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে এই কেন্দ্রের জ্বালানি শেষ হয়ে যেতে পারে।
গাজার বেশির ভাগ বিদ্যুৎ আসে ইসরায়েল থেকে। ইসরায়েল থেকে প্রতিদিন ১২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনে গাজা। আর দিনে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয়।