দুই বছর পর জানা গেল যুবক খুনে ঢাবি ছাত্র অভিযুক্ত


prothomalo.com | Published: 2023-08-11 08:34:36 BdST | Updated: 2024-05-03 19:58:38 BdST

দুই বছর আগের একটি খুনের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। একটি মুঠোফোন নম্বরের সূত্র ধরে ওই শিক্ষার্থীর খোঁজ পাওয়া গেছে।

গ্রেপ্তার শেখ মারুফ হোসেন ওরফে সুজন (২৬) বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি।

২০২১ সালের ১ জুন আবুল হাসান (৩২) নামের এক যুবককে অচেতন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে চলে যান কয়েকজন যুবক। ওই দিনই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করে আবুল হাসানের বাবা আব্দুল মতিন।

সম্প্রতি আবুল হাসানের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পেয়ে পুলিশ জানতে পারে, এটি অপমৃত্যু নয়। হত্যা করা হয়েছিল আবুল হাসানকে। আবুল হাসান রাজধানীর ইস্টার্ন মল্লিকার একটি মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদরে। তিনি পরিবারের সঙ্গে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায় থাকতেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আবুল হাসান মাদক সেবন করতেন। সে কারণে ২০২১ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে এক দিন সন্ধ্যায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন নীলক্ষেতে যান। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মারুফ এবং তাঁর দুই বন্ধু তরিকুল ইসলাম (তারেক) ও রাজিব হোসেনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। এক পর্যায়ে তাঁদের সঙ্গে আবুল হাসানের কথা কাটাকাটি ও মারামারি হয়। এর জের ধরে এক সপ্তাহ পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আবুল হাসানের ওপর হামলা চালান মারুফ ও তাঁর ওই দুই বন্ধু। এদের মধ্যে তরিকুলও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আবুল হাসানকে আহত অবস্থায় ওই তিনজনই ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গিয়েছিলেন।

যেভাবে খুনি শনাক্ত

আবুল হাসানের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর গত ৪ জুন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন বাবা আবদুল মতিন। এরপর খুনি ধরতে তদন্তে নামে পুলিশ।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তাঁরা প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে আবুল হাসানকে ভর্তির কাগজ পরীক্ষা করেন। সেখানকার নিবন্ধন খাতায় একটি নাম ও একটি মুঠোফোন নম্বর পান। ওই নামে কাউকে খুঁজে পাননি। এরপর মুঠোফোন নম্বরটির কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) সংগ্রহ করে পুলিশ। কিন্তু মুঠোফোন নম্বরটি বেশ কয়েক বছর বন্ধ থাকায় সিডিআরের পূর্ণাঙ্গ তথ্য পায়নি পুলিশ।

তবে ওই নম্বরটি কার নামে নিবন্ধিত, সেই তথ্য বের করা হয়। তখন পুলিশ জানতে পারে, মুঠোফোন নম্বরটি পটুয়াখালীর জামাল হোসেন ওরফে পদার নামে নিবন্ধিত। আবুল হাসান খুনে জড়িত সন্দেহে জামালকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।

পরে ঢাকা মেডিকেলে মারা যাওয়া আবুল হাসানের ছবি জামালকে দেখানো হয়। কিন্তু জামাল তাঁকে চিনতে পারেনি। তখন জামালকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁর ভাই তরিকুলের নাম জানা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তরিকুলই এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে সন্দেহ করে পুলিশ। পরে তরিকুলের মুঠোফোনের সিডিআর সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করা হয়। তবে এখনো তরিকুলের সন্ধান পায়নি পুলিশ। তদন্তে হত্যাকাণ্ডে তরিকুলের বন্ধু শেখ মারুফ হোসেনের সংশ্লিষ্টতা পেয়ে তাঁর সন্ধান শুরু করা হয় বলে তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অমল কৃষ্ণ দে জানিয়েছেন।

 

বুধবার যশোরের বেনাপোল থেকে মারুফকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ জানান। তিনি বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মারুফ এদিন হত্যাকাণ্ডে দোষ স্বীকার করে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তরিকুলসহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই অমল কৃঞ্চ দে প্রথম আলোকে বলেন, খুনের ঘটনা থেকে বাঁচতে আসামি তরিকুল ইসলাম ইচ্ছাকৃতভাবে সেদিন ঢাকা মেডিকেলের নিবন্ধন খাতায় নিজের নাম-পরিচয় লুকিয়েছিলেন। আর যে নম্বরটি তিনি উল্লেখ করেছিলেন, সেটি ছয় বছর ধরে বন্ধ ছিল। ওই নম্বরের সূত্র ধরে তাঁরা আবুল হাসান খুনের বিস্তারিত ঘটনা জানতে পারেন।

যেভাবে হত্যা

পুলিশ সূত্রগুলো বলছে, নীলক্ষেতে মাদক সেবনকে কেন্দ্র করে মারুফ, তরিকুলদের সঙ্গে বিরোধ হওয়ার সপ্তাহখানেক পর ২০২১ সালের ১ জুন আবুল হাসান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যান। এ খবর পেয়ে মারুফ, তরিকুল ও রাজিবও সেখানে যান।

আগের ওই বিরোধের জের ধরে তাঁরা আবুল হাসানকে এলোপাতাড়ি মারতে থাকেন।
পুলিশের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, তরিকুল প্রথম আবুল হাসানকে সজোরে লাথি মারেন। এরপর তিনজনই তাঁকে এলোপাতাড়ি কিল–ঘুষি মারতে থাকেন। এর মধ্যে তরিকুলের এক লাথিতে আবুল হাসান কংক্রিটের ঢালাইয়ের ওপর পড়ে যান। তখন তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাঁর মাথার পেছনে আঘাত লাগে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

শাহবাগ থানায় আবুল হাসানের অপমৃত্যু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোলাম হোসেন খান বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার আগে কারা আবুল হাসানকে হাসপাতালে এনেছিলেন, সে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তবে কিছুতেই তাঁদের শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। দুই বছর পরে মুঠোফোনের সূত্র ধরে এই হত্যা রহস্য বের করা সম্ভব হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আবুল হাসান খুনের পর আসামি শেখ মারুফ, তরিকুল, রাজিব হোসেন প্রথম কিছু দিন গা ঢাকা দেন। পরে তারা সতর্কভাবে চলাফেরা করতেন। এ ঘটনায় খুনের মামলা দায়েরের পর তরিকুল, মারুফ ও রাজিব পালিয়ে বেড়ান।    

পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম হোসেন জানান, জামালকে আটকের পর তাঁর কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত তরিকুলের ছবি সংগ্রহ করা হয়। সেই ছবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় লোকজনকে দেখিয়ে তাঁর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

পুলিশের ভাষ্য মতে, তরিকুল, মারুফ ও রাজিব প্রায়ই নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মুক্তমঞ্চ, লেক পার্ক এলাকায় একসঙ্গে আড্ডা দিতেন এবং মাদক সেবন করতেন।

মারুফের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. মারিয়াম জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, শেখ মারুফ হোসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতির দায়িত্বে আছেন। তবে তিনি খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন কি না, সেটা তাঁর জানা নেই।

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, শেখ মারুফ হোসেন খুনের মামলায় জড়িত হয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিলে অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মারুফের বিষয়ে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মাকসুদুর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ মারুফ খুনের ঘটনায় জড়িত কি না, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পুলিশ এখনো জানায়নি। খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে থাকলে অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

prothomalo.com