প্রতিষ্ঠার তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তিতে ঢাকা কলেজ


Dhaka | Published: 2020-07-20 05:08:24 BdST | Updated: 2024-04-29 21:10:32 BdST

ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। দিন দিন শিক্ষার প্রসার ও প্রচারের ব্যপ্তি ঘটতে থাকে এই প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। দেশবিভাগ পূর্ববর্তী কিংবা স্বাধীনতা পরবর্তী— উভয় সময়ই রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির স্বর্ণালি অতীত। বর্তমানে নিজেদের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তিতে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি।

দেশের প্রাচীনতম এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পালন হয় না প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ফলে কয়েক বছর ধরে কলেজটির সঠিক প্রতিষ্ঠার তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন সাবেক-বর্তমান ছাত্র-শিক্ষকরা। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেককে ১৮ জুলাই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ধরে নিজ প্রতিষ্ঠানকে শুভেচ্ছা জানাতে দেখা গেছে।

ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- ফেসবুক গ্রুপ ‘অদম্য ডিসিয়ান’। এই গ্রুপে শামীম রহমান নামের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘শুভ জন্মদিন ঢাকা কলেজ’। আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন ‘শুভ জন্মদিন প্রাণের ঢাকা কলেজ, ১৭৯ বছরে তোমাকে স্বাগত’। এমন আরও অনেক শিক্ষার্থী ফেসবুক গ্রুপসহ নিজেদের টাইমলাইনে কলেজের জন্মদিন উপলক্ষে শুভেচ্ছার বার্তা দিচ্ছেন। তবে প্রশ্ন জেগেছে অন্য জায়গায়। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিগত কয়েক বছর ধরে কেন এমন নিরুত্তাপ ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ?

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিষয়ে কলেজের তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ১৮ জুলাইকে ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে জমকালো আয়োজনে পালন করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু গত কয়েক বছর ১৮ জুলাইয়ের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে ২০ নভেম্বর। তাও আবার কোনো আয়োজন ছাড়াই, মৌখিকভাবে।

প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান প্রশাসন বলছে, আগের কয়েকজন অধ্যক্ষ কোনো ধরনের গবেষণা ছাড়াই ১৮ জুলাইকে ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘোষণা করেন। তবে ২০ নভেম্বর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের পক্ষেও কলেজ প্রশাসনের কাছে নেই কোনো তথ্যপ্রমাণ। এতে কলেজের ইতিহাস বিকৃতি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন কলেজটির সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

তারা বলছেন, ঢাকা কলেজ উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের সঙ্গে এ অঞ্চলের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর ইতিহাসও জড়িত। অথচ ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিহাস বিকৃতি শুরু হয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে দ্রুত এর প্রতিষ্ঠার সঠিক দিনটি অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। এটি করা না গেলে ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানটির জন্মের ইতিহাস পরিবর্তন হয়ে যাবে। এখনই কলেজ প্রশাসনকে এই উদ্যোগ নিতে হবে।

উইকিপিডিয়া বলছে, ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন (General committe of public Instruction) লর্ড কেন্টিকের কাছে একটি প্রতিবেদন পেশ করেছিল। ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছিল ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি স্কুল, যা বর্তমানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি স্কুলকে একটি কলেজে বা একটি আঞ্চলিক উচ্চতর ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়। যার নাম দেয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ বা ঢাকা কলেজ। শুরুতে কলেজটি পূর্বের স্থাপিত ঢাকা গভর্মেন্ট স্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত করে গড়ে তোলা হলেও পরবর্তীতে এজন্য একটি পৃথক ভবনের প্রয়োজন হয়।

ঢাকা কলেজের জন্য ভবন নির্মাণের দায়িত্ব পায় মিলিটারি বোর্ড। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বিশপ রেভারেঞ্জ ড্যানিয়েল ঢাকা কলেজ হিসেবে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

প্রতিষ্ঠালগ্নে ঢাকা কলেজের ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। সদরঘাটের স্থপতি কর্নেল ড্যানিয়েল এর নকশা করেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং হিন্দু কলেজের শিক্ষক জে. আয়ারল্যান্ডকে ঢাকা কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল নিযুক্ত করা হয়।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক শরীফ উদ্দীন আহমেদ ঢাকা কলেজের ইতিহাস নিয়ে ‘ঢাকা কলেজের ইতিহাস ও ঐতিহ্য (১৮৪১-১৯২১)’ নামের একটি বই রচনা করেন। সেই সূত্র মতে, তৎকালীন সময়ে ‘স্থানীয় জনশিক্ষা কমিটি’ ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে কলেজ প্রতিষ্ঠা নিয়ে যে চিঠিগুলো চালাচালি করা হয় তার মধ্যে ৭ জুলাই ও ১১ আগস্টের মধ্যবর্তী কোনো চিঠি পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ৭ জুলাই পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে কলেজ প্রতিষ্ঠা নিয়ে আলোচনা সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায় এবং ১১ আগস্ট লেখা চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, কলেজিয়েট স্কুল ভবনে কলেজ শাখা চালু করা হয়েছে যার জন্য আলাদা ভবন নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে সরকারের সূদৃষ্টি প্রয়োজন। কিন্তু ঠিক কত তারিখে কলেজ শাখা খোলা হয় তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।

পরবর্তীতে ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর ভারতের তৎকালীন মেট্রোপলিটন ও কলকাতার লর্ড বিশপ ‘রেভারেঞ্জ ড্যানিয়েল’ কলেজের নিজস্ব ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন যেখানে লেখা ছিল- "The College of Dacca" Founded by the British government of India for the instruction of the nation youths of the eastern Districts of Bengal in European literature and science.

This first stone of the odifice is laid by Lord Bishop Reverend Daniel.

Lord Bishop of Calcutta and Metropolitan of India on the 20th day November, A.D, 1841 the reign of her Most gracious honourable the eari of Auckland, G.OB/Governer General.

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিভ্রান্তি এড়াতে ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মোয়াজ্জেম হোসেন মোল্লা একটি কমটি গঠন করেছিলেন। তবে ওই পর্যন্তই, আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. আয়েশা বেগম বলেন, ‘ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিয়ে বিভ্রান্তি দীর্ঘদিনের। জুলাই মাসের যে তারিখটি ধরা হয় ওই তারিখে ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেখান থেকে পরবর্তীতে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। যেটি ২০ নভেম্বর ৷ তবে আমি অধ্যক্ষ থাকাকালীন নির্দিষ্ট তারিখ ধরে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করিনি। সাবেক, বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে মিলনমেলার আয়োজন করেছি কয়েকবার।

যেহেতু প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনটি নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে সেহেতু একটি কমিশন গঠন করে বিষয়টি গেজেট আকারে প্রকাশ করে বিভ্রান্তি দূর করা যেতে পারে— এমনটি মনে করেন সাবেক এই অধ্যক্ষ।

এ বিষয়ে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর নেহাল আহমেদ বলেন, ‘ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমরা সবাই মিলে উদযাপন করতে চাই। কিন্তু প্রাচীন কলেজ হওয়ায় এর প্রতিষ্ঠা দিবস নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই। এমনকি কোনো গেজেটও নেই। দিনটি উদযাপন করা যাচ্ছে না। এছাড়া ভিন্ন ভিন্ন দুটি দিনে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছিলেন সাবেক দুই অধ্যক্ষ। বিতর্ক এড়াতে আপাতত দিনটির উদযাপন বন্ধ রয়েছে। তবে আগামী বছর থেকে দিবসটি উদযাপনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।