দেড় বছরেরও বেশি সময় যৌন হয়রানি মুখ বুজে সহ্য করেছি: ঢাবি ছাত্রী


DU Correspondent | Published: 2024-02-11 10:36:13 BdST | Updated: 2024-04-28 05:53:21 BdST

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনায়েদের বিরুদ্ধে প্রক্টরের কাছে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের অভিযোগ করেছেন এক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর বরাবর অভিযোগপত্র জমা দেন ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০২২ সালে করোনার পর একটি কোর্সে উনাকে আমরা প্রথম সশরীরে ক্লাসে পাই। প্রতি ক্লাসেই তিনি অ্যাসাইনমেন্টের টপিক নির্ধারণ করতে বলতেন এবং টপিক অনুমোদনের জন্য উনাকে সরাসরি ফোন দিতে বলতেন। এ সুবাদে আমি টপিক নির্ধারণের জন্য তাকে চারবার ফোন দেই, কেননা তিনি বারবার টপিক বাতিল করছিলেন। প্রতিবার ফোন দিলে তিনি রাতে কল ব্যাক করতেন এবং ন্যূনতম এক ঘণ্টা ধরে কথা বলেছেন।

এ সময় তিনি টপিকের বাইরে গিয়েও ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আগ্রহ সহকারে কথা বলেছেন। একই বছরের ২৫ অক্টোবর তিনি আমার ফেসবুক ইনবক্সে উনার অ্যাকাউন্ট (বর্তমানে Centaur Phoenix নামে অ্যাকাউন্টটি আছে)। তিনি ঘনঘন ফেসবুক আইডির নাম পরিবর্তন এবং আইডি খোলেন) থেকে মেসেজ করেন, ছোট চুলে কেমন লাগছে? কোন ধরনের ভূমিকা ছাড়া এমন প্রশ্নে অবাক হলেও নিজেকে সামলিয়ে উত্তর দেই।

সেদিন খুব সাধারণ কথোপকথন হয়। ২০২২ সালে উনার কোর্স শেষ হয়। এরমধ্যে উনি একদিন আমাকে ফেসবুকে নক দিয়েছিলেন, কিন্তু ফেসবুকে না থাকায় রেসপন্স করতে পারিনি। পরে উনার মেসেজ দেখে আমি উনাকে কল দেই। সেদিন উনার সঙ্গে পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে কথা হয়।

এক পর্যায়ে উনি আমার ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে জানতে চান, আমার কারও সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা এ নিয়েও জানতে চান। উনি সবসময় জিজ্ঞেস করতেন উনাকে আমার কেমন লাগে, ইত্যাদি। এক পর্যায়ে তিনি তার বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলেন এবং স্পষ্টভাবে আমার দিকে ইঙ্গিত করেন। আমি খুব অবাক হই এবং খুব অস্বস্তিতে পড়ি।

তবে, আমি কৌশলে তাকে নাকচ করে দিই। আমার বক্তব্যে শব্দ বা বাক্যের তারতম্য থাকতে পারে, কিন্তু আমার সেই দিনের কথার অর্থ এটাই ছিল। এরপর উনি আমাকে নিজে থেকে বলেন, আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে পারে। আমি সেই সময় হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়েছি। আবার বলেন, আচ্ছা ভাবতে তো দোষের কিছু নাই। আমরা না হয় ভাবলাম! ধরে নাও না।

আমাদের বিয়ে হলে কেমন হবে? ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেমন হবে? এই ধরনের কথাগুলো ছিল আমার জন্যে প্রচণ্ড রকম বিব্রতকর এবং অপ্রীতিকর। কিন্তু শিক্ষক হওয়ায় উনাকে না-ও করতে সাহস পাচ্ছিলাম না। যতটা না বলে পারা যাচ্ছিল না, ততটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছিলাম। আমি আগ্রহ দেখাচ্ছি না দেখে উনি প্রচণ্ড বিরক্ত হতেন।

এক পর্যায়ে (১৬ ডিসেম্বরে) উনি রাগ করে আমাকে হোয়াটসআপে ব্লক করে দেন। কিন্তু পরে একমাস পর উনি নিজে থেকেই আবার যোগাযোগ করে আমার খোঁজ নেন। মূলত কোন একটা বইয়ের বিষয়ে উনি আমার কাছে একটা পাবলিকেশন এর নাম জানতে চেয়েছিলেন, তারপর আমিও শিক্ষার্থী হিসেবেই উনার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেছিলাম।

এভাবেই উনার সঙ্গে আবার একটা যোগাযোগ শুরু হলো। উনি উনার লেখা পাঠাতেন বা বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করতেন, উনার বিভিন্ন ব্যক্তিগত অভিমত জানাতেন। এই পর্যন্ত সব সহ্যের মধ্যে ছিল, সীমার মধ্যে ছিল। এভাবেই ২০২৩ সাল শুরু হয় কখনো দুইমাসে, কখনো একমাসে উনার সঙ্গে যোগাযোগ হতো।

কিন্তু হঠাৎ উনি যোগাযোগ বাড়িয়ে দেন। এ সময় অন্তরঙ্গ বিষয় নিয়ে অনেক কথা বলতে চাইতেন। তিনি বিভাগের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ বিষয়ও আমাকে জানান (যেমন বিভাগের বিভিন্ন কমিটি, সিদ্ধান্ত, পরীক্ষার ফলাফল, এমনকি শিক্ষকদের আচার-আচরণ সম্পর্কে)। তিনি আমার শারীরিক অবয়র সম্পর্কে নোংরা মন্তব্য করতেন এবং যৌন উত্তেজনা প্রকাশ করতেন।

একই সঙ্গে আমাকে উনার সঙ্গে বাজে জিনিস কল্পনা করতে প্ররোচিত করতেন। বলতেন, ধরে নাও তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে, তোমার সঙ্গে এটা করলে ওটা করলে কেমন হতো, মনে কর, আমরা সি-বিচ গিয়েছি, সান- বার্থ...। এছাড়াও বিভিন্ন Double meaning কথাবার্তা বলতেন এবং সারাক্ষণ ‘sexual’ কথোপকথনে প্ররোচিত করতেন।

বিষয়টি সহ্যের সীমার বাইরে যেতে থাকলো। উনি বিভাগের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে আমাকে নজরদারি করতেন। এছাড়াও অন্য শিক্ষার্থীদেরও নজরদারি করতেন এবং তাদের নিয়ে আমার কাছে বিভিন্ন মন্তব্য করতেন। আমাকে কোন ছেলে সহপাঠীর সঙ্গে দেখলে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন এবং তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করতেন।

উনি আমার সঙ্গে এমন কথাবার্তা বলতেন, এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন আমার প্রতি, যার বেশিরভাগ কথাই সাধারণত স্বামী স্ত্রীর মধ্যে হয়ে থাকে। এই ধরনের কথাগুলো ছিল আমার জন্যে তীব্র যন্ত্রণার। আমি কত রাত ঘুমাতে পারিনি, কত দিন এই অস্বস্তি এবং মানসিক কষ্ট নিয়ে রাত দিন পার করেছি কেউ জানে না। উনার বেশিরভাগ কথায় আমি হাসতাম বা হেসে উড়িয়ে দিতাম বা না বোঝার ভান করতাম। কারণ এছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না।

উনার ঐ ধরনের অন্তরঙ্গ কথাবার্তা বা ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তার অনেক আমি বুঝেও উনাকে বলতাম বুঝিনি, বিভিন্নভাবে এড়িয়ে গেছি। কিন্তু আমার নীরবতা বা আমার অট্টহাসিকে সম্মতি বা দুর্বলতা ভেবেছেন। এরপরও উনি এইসব কথা বলা থামাননি বরং সেটা বিভিন্ন আকার ইঙ্গিতে তা আরও বেড়েছে। উনি সাধারণত ১০ থেকে ১১টার মধ্যে কল দিতেন। কিন্তু যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শুরু করলে গভীর রাত পর্যন্ত কথা বলতে চাইতেন। তিনি বিভিন্ন সময় আমাকে বিয়ের পর তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিতের কথাও বলেছেন।

আমি ফ্রি থাকলেই ঘন ঘন দেখা করতে চাইতেন এবং তার বাসায় আমন্ত্রণ জানাতেন। আমি প্রতিবারই বিভিন্ন অযুহাতে নাকচ করতাম। বিষয়টি উনি বুঝতে পারলে বকাঝকা করতেন। পরে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে দেখা করি। ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর উনার জন্মদিন উপলক্ষে আমাকে নভেম্বরেই দাওয়াত দেন। জন্মদিন কাছে আসলে উনি আমাকে বারংবার বাসায় যাওয়ার জন্য বলতে থাকেন। আমি বলি, আপনার পরিবার অবগত আছে কিনা। উনি নিশ্চিত করলে জন্মদিনে তার বাসায় যাই।

উনার বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করি। এক পর্যায়ে উনি ছাদে নিয়ে যান। এ সময় সিঁড়ির কাছে তিনি আমার উচ্চতা পরিমাপের কথা বলে কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করেন। তখন তিনি আমার কাছে এসে বলেন, এটাকেই বলে 'জিরো ফিট ডিসট্যান্স'। এ সময় আমি প্রচণ্ড অসহায়বোধ করতে থাকি। আমি ফিরে আসার পর উনি আমাকে আবার ফোন দেন। বলেন, '(বাসায়) কী ইচ্ছা করছিল জান, তোমাকে হাগ করে, ইচ্ছেমতো যা করার...'। আমি কোনোভাবে বিষয়টি এড়িয়ে যাই।

উনার সঙ্গে কথা বলাটা ছিল আমার জন্যে যন্ত্রণাদায়ক। আমি ঘুমের ঔষধ নিতে শুরু করলাম, কারণ আমি ঘুমাতে পারতাম না, উনার কথাবার্তাগুলো আমার চিন্তায় আসতো। আমি চোখ বন্ধ করলে আজেবাজে স্বপ্ন দেখতাম। আমি প্রচণ্ড মানসিক চাপে থাকতাম। উনার সঙ্গে আবার আমার কথা বলতে হবে ভেবেই আমার আতঙ্ক লাগত। অনিচ্ছা স্বত্বেও কারও সঙ্গে কথা বলা, তার উপর আবার যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বলা বা শোনা কতটা টর্চার, কতটা কষ্টের, কতটা বেদনাদায়ক! আমি প্রায়ই অনাগ্রহ দেখাতাম, পাশ কাটিয়ে যেতাম, এটা উনিও বুঝতেন।

কিন্তু তাতে উনি এসব কথা বলা বন্ধ করেননি, উনি আমার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন করতেন, দেখতে কেমন, ইত্যাদি নানান কথার প্রশ্ন উনি খুব আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করতেন। এড়িয়ে গেলেও আবার একই কথা রিপিট করতেন, আমাকে প্রায় জিজ্ঞেস করা হতো আমার কেন কোনো অনুভূতি হয় না? আমার শারীরিক কোনো চাহিদা কেন নাই? আমার ইচ্ছা করে কিনা? আমাকে এমনও বলেছেন, 'আই অ্যাম সরি টু সে, তুমি স্বাভাবিক না, তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত।' উনি বার বার আমাকে মানসিক চাপ দিতেন, 'কেন কোনো অনুভূতি নাই? কেন উনাকে আমি ফিল করি না! উনি আমাকে এত বুঝাচ্ছেন, তবুও আমি সাড়া দিতাম না।

উনি আমাকে এই বলে চিৎকার করে বলেন যে, 'তুমি একটা নির্বোধ, অনুভূতিহীন গবেট।' ২০২৩ সালে। ম্যামের পরিবর্তে একটি কোর্সে ক্লাস নেয়া শুরু করলেন। আমি কেন উনার সঙ্গে যৌন উত্তেজনাকর কথায় স্বতঃফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করছি না, সেই বিরক্তি ক্লাসেও প্রকাশ করতে থাকলেন।

একজন শিক্ষার্থী হিসেবে দিনের পর দিন উনার যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছি, কারণ উনার কাছে অনেক ক্ষমতা এই ভেবে। আমি একজন সামান্য শিক্ষার্থী। পাশাপাশি উনি আমাদের সামনের চেয়ারপারসন। শুধু এই ভয়ে আমার পরিবারের কাছে আমার দেড় বছর আগে থেকে বলতে হচ্ছে যে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করবো না। দরকার হলে নিজের টিউশনির টাকা দিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করব।

কারণ আমি অনেক কাছ থেকে দেখেছি একজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত আক্রোশ কত ভয়ংকর হতে পারে। যেই ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হতে পারি বলে আমি গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে নিজের উপর হওয়া যৌনহয়রানি মুখ বুজে সহ্য করেছি। আমি বিগত দেড় বছর প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। কিন্তু এ যন্ত্রণার প্রকাশ আমি উনার সামনে করতে পারিনি। এক পর্যায়ে এ যন্ত্রণার পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় যে আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না। গত বছরের শুরুতে আমি কাউন্সিলিং-ও করি। ঘুমানোর জন্য ঘুমের ওষুধ খেতে হত।

উনি নিজে সবসময় বলেন আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার না করতে, কেনো এত সময় অপচয় করা হয় অথচ উনি নিজেই অন্যদের ফেসবুকে কি আলোচনা হচ্ছে সেই বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করেন। উনার নামে কে কি বলছে তাই উনার চিন্তার এবং কথার মূল বিষয় হয়ে উঠে। এছাড়া উনি ১৬তম ব্যাচের ক্লাসে গিয়ে বলেছিলেন ওদের ফেসবুক পোস্ট নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে। আমরা নিজ বিভাগে ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠছি, নিজেদের মধ্যে সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করছি। একজন শিক্ষকের কাছে সবাই কোণঠাসা হয়ে পড়লাম! যেখানে উনি উনার মতো একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন, আর সামনে করতে যাচ্ছেন।

সবমিলিয়ে উনাকে আমার মানসিকভাবে অস্থিতিশীল মনে হয়েছে। উনি পরিচয়ের শুরুতে উনার সুন্দর আচরণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের মুগ্ধ করেন। আদর্শের ভেক ধরে থাকেন। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। আমার সঙ্গে কথোপকথনের সময়ও উনি বিভিন্ন নারী শিক্ষার্থীদের নাম উল্লেখ করতেন। এমনকি বিভিন্ন সময় তাদের শারীরিক অবয়ব নিয়েও নোংরা মন্তব্য করেছেন। আমার মত অনেক শিক্ষার্থীকেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন বিভিন্ন সময় জানতে পেরেছি।

অতএব, আপনার নিকট বিনীত প্রার্থনা, অধ্যাপক নাদির জুনাইদের কৃতকর্মের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হোক। এর মধ্য দিয়ে বিভাগের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নারী শিক্ষার্থীদের একজন যৌন বিকারগ্রস্থ মানুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা করুন।