নতুন বইয়ের গন্ধে জীবনের গল্প শুরু


Dhaka | Published: 2020-01-02 03:08:52 BdST | Updated: 2024-05-18 10:51:51 BdST

ক্লাস আর পরীক্ষার ব্যস্ততা নেই। তাই নতুন বছরের প্রথম দিনটা কেটে যায় নতুন বইয়ের সঙ্গে মিতালি করে। নতুন বইয়ের নতুন গন্ধ, নতুন গল্প, ছবির সঙ্গে যেন শুরু হয় জীবনের নতুন গল্প। নতুন বইয়ের সঙ্গে নিজেদের কল্পনার জগতের সঙ্গে মিলিয়ে আলাদা ভাবনায় ঘোরে মধ্যেই যেন দিন কেটে যায়। এই গল্প প্রত্যেকের। তবে, গত ১০ বছরে এই গল্প যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কারণ একটিই আর তা হচ্ছে, বছরের প্রথম দিনের সকালে তা হাতে পাওয়া।

প্রতি বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরের প্রথম দিনেও সারা দেশে শুরু হয়েছে বই উৎসব। বুধবার (১ জানুয়ারি) প্রাক প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত চার কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে নতুন বই।

নতুন বই হাতে পেয়েই উল্টেপাল্টে দেখছিলেন রাজধানীর উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী নৈঋত মাহমুদ। তার চোখে মুখে তখন শীত-সকালের রোদের মতোই চাপা আনন্দের ঝিলিক। বাংলা বইয়ের সবগুলো গল্প আজ রাতের মধ্যেই পড়ে শেষ করবে বলে বাবার কাছে বায়না ধরেছে সে। পুত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সম্মতিও দিয়েছেন বাবা।

সারাবাংলাকে নৈঋত জানায়, নতুন বই হাতে পাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে সে। সবগুলো বই পড়ার চেষ্টা করে। বইগুলোর মলাটে যত্নের সঙ্গে লেখে নিজের ও নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম। এসব করতে করতে একসময় বই জড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়ে সে। সকালে আবার শুরু হয় তার নতুন জগৎকে জানতে চাওয়ার অভিযান।

নৈঋতের বাবা রায়হানুল আবেদিন বলেন, আমরা কোনোদিন নতুন বছরের প্রথম দিনে বই হাতে পাইনি। নতুন ক্লাসের বই পেতে পেতে আমাদের মার্চ থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। যা পেতাম সেগুলোও হয়তো পুরনো বই। ফলে আমার ছেলে যখন বছরের প্রথম দিনে নতুন বই পায় তখন একই সঙ্গে গর্ব ও ব্যথার অনুভূতি হয়! সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে যেন এই রীতি কখনো বন্ধ করে দেওয়া না হয়।

নৈঋতের মতো আজিমপুরের ভিকারুন্নেসা স্কুলের লিয়ানা রাইসাও তৃতীয় শ্রেণীর বই হাতে পেয়ে হয়েছে আনন্দে মাতোয়ারা। বইগুলোকে একবার মায়ের কাছে দিয়ে পরক্ষণেই আবার নিচ্ছে নিজের দখলে। উল্টে দেখছে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। প্রাণ ভরে নিচ্ছে নতুন নতুন শব্দ-বাক্যের ঘ্রাণ।

আহ্লাদী কন্যা লিয়ানা বলে, সবগুলো বই আমার। এরপরেই চুপ করে মনোযোগী হয় বইয়ের পৃষ্ঠায়। যে পাতায় আঁকা ছবি ভালো লেগেছে সেখানেই দৃষ্টি পড়েছে তার। মায়ের কাছে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছে এসব ছবির অর্থ।

লিয়ানার মা আফরোজা সোমা বলেন, আমার মেয়েটা অনেক চঞ্চল। নতুন নতুন বই হাতে পেয়ে কেমন স্থির হয়ে গেছে সে! ছবিগুলো দেখে আমাকে দেখানোর চেষ্টা করছে। একটা দুটো বাক্য পড়ে শোনানোর চেষ্টা করছে। মা হিসেবে আনন্দটা বলে বোঝাতে পারব না। বছরের প্রথম দিনে বই পাওয়ায় একটি শিশু কতটা আনন্দিত হয় সেটি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

বছরের শেষ দিন সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে শিশুদের হাতে বই তুলে দিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন। এরপর বুধবার (১ জানুয়ারি) আবারো শিশু-কিশোরদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে বই তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। এরপরই সারা দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেন শিক্ষকেরা। শুরু হয় দেশব্যাপী বই উৎসব।

এবারের বই উৎসবে অংশ নিয়েছে ৪ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থী। এদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪ কপি নতুন বই। এরমধ্যে প্রাথমিকে ১০ কোটি ৫৪ লাখ দুই হাজার ৩৭৫ কপি এবং মাধ্যমিকে ২৪ কোটি ৭৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭৯ কপি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে শিশুদের হাতে আমি নিজে বই তুলে দিয়েছি। বই হাতে পেয়ে কচি শিশুরা যে আনন্দ পেয়েছে, আমার দিকে তাকিয়ে যে স্বস্তির হাসি হেসেছে সেটিই আমার কর্মজীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।

মো. জাকির হোসেন আরও বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থাকে বদলে দেবার আগে প্রচলিত যে ব্যবস্থাটি আছে সেটিকে গতিশীল করতে হবে। এর জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে চাহিদা অনুযায়ী সহযোগিতা করতে হবে। নতুন বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার মানে হলো তাদেরকে সহজ শিক্ষার দিকে আরেকটু এগিয়ে দেওয়া। আমরা এখন পর্যন্ত এই কাজটি চমৎকারভাবেই করতে পারছি। এটি আমাদের জন্য আনন্দের ও গর্বের।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেন, বছরের প্রথম দিনে নতুন বই হাতে পাওয়ার কোনো স্মৃতি আমার নেই। কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নতুন বই পাওয়ার এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। এই ধারা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি, তাহলে পরবর্তীতে যে প্রজন্মগুলো বাংলাদেশে বেড়ে উঠবে তাদের শিক্ষাজীবন আরো বেশি সুন্দর ও সহজ হবে।

বই ছাপানো থেকে শুরু করে বই বিতরণ এর পুরো কাজটি এবার করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি।

এনসিটিবি সূত্র জানায়, পাঠ্যবই ছাপাতে এবার প্রায় ১১শ’ কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। এরমধ্যে প্রাথমিক স্তরের বই ছাপাতে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা এবং মাধ্যমিক স্তরসহ অন্য বই ছাপাতে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ১০০ কোটি টাকা কম।

২০২০ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক স্তরে দুই বিষয়ে ৩২ লাখ ৭২ হাজার ১৮৬ জন শিক্ষার্থীকে ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৬টি বই দেওয়া হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির শিক্ষার্থীরা পেয়েছে ৯৭ হাজার ৫৭২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে দুই লাখ ৩০ হাজার ১০৩টি বই।

মাদ্রাসা শিক্ষায় ইবতেদায়ি পর্যায়ে ৩২ লাখ ৬৯ হাজার ৭১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৬ বিষয়ে ২ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার ৩৫টি বই বিতরণ করা হয়েছে। দাখিলে ২৬ লাখ ২৬ হাজার ৬২৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে দেওয়া হয় ৩৯ বিষয়ে ৩ কোটি ৮৫ লাখ ৩৭ হাজার ৯০৫টি বই।

কারিগরিতে ২ লাখ ৭১ হাজার ৮৯৩ জন শিক্ষার্থীর ৬১ বিষয়ে ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ৬৩৩টি, এসএসসি ভোকেশনালে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৫০ শিক্ষার্থীর ১৯ বিষয়ে ৩৫ লাখ ২ হাজার ৭৬৫টি এবং দাখিল ভোকেশনালে ১২ হাজার ২৫৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৭ বিষয়ে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৯৬৫টি বই দেওয়া হয়েছে।

২০২০ শিক্ষাবর্ষে ৭৫০ জন শিক্ষার্থীকে ১১০টি বিষয়ে ৯ হাজার ৫০৪টি ব্রেইল বই দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে এনসিটিবি চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা।

২০১০ সাল থেকে সরকার নতুন বছরের প্রথমদিনেই সারাদেশে বিনামূল্যে বই বিতরণ করে আসছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ২৯৬ কোটি সাত লাখ ৮৯ হাজার ১৭২টি বই বিতরণ করা হয়েছে।

এর মধ্যে ২০১০ শিক্ষাবর্ষে ২ কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৫২৯ জন শিক্ষার্থীকে ১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬১টি; ২০১১ শিক্ষাবর্ষে ৩ কোটি ২২ লাখ ৩৬ হাজার ৩২১ জন শিক্ষার্থীকে ২৩ কোটি ২২ লাখ ২১ হাজার ২৩৪টি; ২০১২ শিক্ষবর্ষে ৩ কোটি ১২ লাখ ১৩ হাজার ৭৫৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২২ কোটি ১০ লাখ ৬৮ হাজার ৩৩৩টি বই; ২০১৩ শিক্ষাবর্ষে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার ১৭২ জন শিক্ষার্থীকে ২৬ কোটি ১৮ লাখ ৯ হাজার ১০৬টি; ২০১৪ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫৩ হাজার ২০১ জন শিক্ষার্থীকে ৩১ কোটি ৭৮ লাখ ১২ হাজার ৯৬৬টি; ২০১৫ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার ৩৩৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৩টি; ২০১৬ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ জন শিক্ষার্থীকে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৬০টি বই; ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯২৯ জন শিক্ষার্থীকে ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি; ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ৩৬ লাখ ৯৮ হাজার ৬৬৩ শিক্ষার্থীকে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি এবং ২০১৯ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থীকে ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২টি বই বিতরণ করা হয়েছে।