৩ পাকিস্তানী শাসকের ঢাবির ডিগ্রি বাতিল দাবী মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের


Dhaka | Published: 2020-07-20 22:30:21 BdST | Updated: 2024-05-17 18:02:00 BdST

শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কমুক্ত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রী প্রদানের আগেই বঙ্গবন্ধু, বাংলা ভাষা, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ বিরোধী খাজা নাজিমুদ্দিন, ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দেয়া ডক্টর অব লজ ডিগ্রী বাতিলের দাবিতে আজ ঢাবির টিএসসি সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে দুপুর ১২ টায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। মানববন্ধন শেষে মিছিল সহকারে উপাচার্যের কার্যালয়ে যেয়ে ঢাবির উপাচার্যের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আল মামুনের সঞ্চালনায় উক্ত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আরোও বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনেট মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত তূর্যসহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, " জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কে ঢাবির সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রী প্রদানের আগে পাকিস্তানি দোসর কুখ্যাত খাজা নাজিমুদ্দিন, ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দেয়া ডক্টর অব লজ ডিগ্রী বাতিল করতে হবে। শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে আমরা কলঙ্কমুক্ত দেখতে চাই। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিরোধী পাকিস্তানী জান্তাদের কলঙ্কের বোঝা বইতে পারে না। অবিলম্বে এই তিনজনের ডক্টর অব লজ ডিগ্রী বাতিল করতে হবে।"

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আল মামুন বক্তব্যে বলেন, "সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রী প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে এ বছরের ৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আয়োজন করতে যাচ্ছে এক বিশেষ সমাবর্তনের এবং সেখানেই তাঁকে অর্পণ করা হবে `ডক্টর অব লজ` ডিগ্রি। বঙ্গবন্ধু কে ডিগ্রী প্রদানের উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। শতভাগ সমর্থন জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও জানাই অকুণ্ঠ অভিনন্দন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই ডিগ্রী প্রদানকে কেন্দ্র করে আমাদের রয়েছে সামান্য কিছু বক্তব্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শতবর্ষে ৫২টি সমাবর্তনের মাধ্যমে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী দিয়েছে মোট ৫২ জনকে। এদের মধ্যে কুখ্যাত খাজা নাজিমুদ্দিন কে ১৯৪২ সালে, ইস্কান্দার মির্জা কে ১৯৫৬ সালে এবং মোহাম্মদ আইয়ুব খান কে ১৯৬০ সালে ডক্টর অব লজ ডিগ্রী দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই তিনজনকে ডিগ্রী প্রদান করা হয়েছিল তাদের অনুকূল সময় ও পরিস্থিতিতে। ডিগ্রী প্রাপ্তিতে এনাদের আগ্রহ যেমন ছিল, ধারণা করা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্তাব্যক্তিদের স্তুতিরও নিতান্ত ঘাটতি ছিল না। তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল

খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলা কে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার বিরোধিতা করেছিলেন। ইস্কান্দার মির্জা ছিলেন পাকিস্তানের শেষ গভর্নর জেনারেল এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট, যদিও দুটি পদেই তিনি ছিলেন অবৈধ। নিয়মিত গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন গেলে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সুস্থ হয়ে ফিরে গোলাম মোহাম্মদের দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক আগ মুহূর্তে ইস্কান্দার তাঁকে স্বপদে যোগদান করতে না দিয়ে নিজেই পদটি দখল করেছিলেন। আর ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ সংবিধান কার্যকর হওয়ার দিন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো নির্বাচনই না করে তিনি প্রেসিডেন্টের পদটি দখল করেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পৌনে ৯ বছর পর বহু প্রতীক্ষিত সংবিধান প্রবর্তিত হলেও মাত্র আড়াই বছরের মাথায় তিনি সংবিধানটি বাতিল করে দেন। সংবিধান বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সামরিক আইন জারি করে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে দেন, দুই সরকারকেই বরখাস্ত করেন, সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন এবং ব্যাপক গ্রেপ্তার-জেল-জুলুম শুরু করেন। এর আগে ৫৫ সালের ১ জুন থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি পূর্ববাংলার গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন। ১ জুন তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে পা রেখেই সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মওলানা ভাসানীকে গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। এতটাই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন যে, দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম সপ্তাহেই তিনি বঙ্গবন্ধুসহ শ`পাঁচেক রাজনীতিককে গ্রেপ্তার করেছিলেন। ৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারির মাত্র ৪ দিনের মাথায় আবার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই অবৈধ গভর্নর জেনারেল ও অবৈধ রাষ্ট্রপতি, ত্রাসের রাজত্ব কায়েমকারী, সংবিধান ও গণতন্ত্র হত্যাকারী এবং সামরিক আইনের সূচনাকারীকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে তাকে গৌরবান্বিত করেছে। প্রচণ্ড ক্ষমতালিপ্সু, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও দাম্ভিক আইয়ুব খান নামে-বেনামে সামরিক শাসনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় সাড়ে ১০ বছর। অবৈধ প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার কর্তৃক জারিকৃত সামরিক আইনের মাত্র ২০ দিনের মাথায় পিস্তলের মুখে ইস্কান্দারকে সরিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আরেক অন্যায়ের মাধ্যমে আইয়ুব সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। সারাবিশ্বে এটিও নজিরবিহীন যে, তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায়ই। আইয়ুবের ঘৃণ্য কর্মের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তার মধ্যে কয়েকটি হলো: মৌলিক গণতন্ত্র নামে অদ্ভুত পদ্ধতি প্রবর্তন, বিডি মেম্বারদের মাধ্যমে প্রহসনমূলক প্রেসিডেন্ট হওয়া, দলবিহীন পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগকে ক্ষমতায় আনা, উদ্ভট আইয়ুবের সংবিধান প্রবর্তন, এনএসএফ নামে পেটোয়া বাহিনী তৈরী, কুখ্যাত মোনায়েম খান ও ড. ওসমান গণিকে যথাক্রমে পূর্ববাংলার গভর্নর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ, ছাত্রদের কাছে অগ্রহণযোগ্য শরিফ শিক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠা, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং পরাজিত হয়েও নির্লজ্জভাবে `ফিল্ড মার্শাল` উপাধি গ্রহণ, ব্যাপক বৈষম্যের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে দেওয়া, বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা। আইয়ুবের শাসনামলে যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে বেশি জুলুমের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। `৬২ থেকে `৬৬ পর্যন্ত তাঁকে মোট ১০ বার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৯৬৬ সালের প্রথম ৩ মাসেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় মোট ৮ বার। এই জঘণ্য আইয়ুবকেই ডিগ্রি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- কুখ্যাত খাজা নাজিমুদ্দিন, ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খানকে ডিগ্রী প্রদান কতটুকু যুক্তিসঙ্গত হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বঙ্গবন্ধুকে ডিগ্রী দিয়ে তাঁর নাম এই তিন কুখ্যাতের সঙ্গে একই তালিকায় রাখা কতটুকু শোভন? বঙ্গবন্ধুর বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাঁর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিতে পারলে এই তিনজন কুখ্যাত ব্যক্তির ডিগ্রী কেন প্রত্যাহার করা হবে না? আইয়ুব গেটকে আসাদ গেট, পাক মটরকে বাংলামটর, জিন্নাহ অ্যাভিনিউকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, জিন্নাহ হলকে সূর্য সেন হল করা গেলে এই তিন জনের নাম কেন মুছে ফেলা যাবে না? বঙ্গবন্ধুকে ডিগ্রী দেয়ার আগে এই তালিকা থেকে জঞ্জাল ও আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।

আল মামুন আরোও বলেন, আমরা চাই মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হোক। কোন স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে না। অতীব দুঃখের বিষয় এই যে, আজও পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু'র কোন ম্যুরাল বা ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়নি। আমরা আশা করি মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধু'র ম্যুরাল বা ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে কটূক্তি করার অপরাধে আজও পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোর্শেদ হাসান কে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়নি। আগামী সিন্ডিকেট সভায় অবিলম্বে এই স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির দালাল মোর্শেদ হাসানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা কলঙ্কমুক্ত দেখতে চাই। বঙ্গবন্ধু, বাংলা ভাষা, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ বিরোধী খাজা নাজিমুদ্দিন, ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খানে ডক্টর অব লজ ডিগ্রী বাতিলের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি। মায়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হত্যাকে সমর্থন দেয়ার অপরাধে ১৯৯৩ সালে অংসান সুচিকে দেয়া ডক্টর অব লজ ডিগ্রী সম্প্রতি প্রত্যাহার করে নিয়েছে যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ।

কুখ্যাত খাজা নাজিমুদ্দিন, ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান সবসময় বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিরোধী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর শোষণ-নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান সূচক ডিগ্রী প্রদান তালিকায় কখনোই এসব কুখ্যাত ব্যক্তিদের নাম থাকতে পারে না। যাদের শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন সংগ্রাম করেছেন তাদের নামের পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম থাকতে পারে না। বঙ্গবন্ধু কে সম্মান জানানোর আগে সিন্ডিকেট সভায় অবশ্যই এই তিনজন কুখ্যাত ব্যক্তির ডক্টর অব লজ ডিগ্রী বাতিল করতে হবে। অন্যথায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে। দাবি আদায় না হলে প্রয়োজনে অনশন কর্মসূচী পালন করবে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।"