বাংলাদেশের মেয়েদের পোশাক নিয়ে এত বিতর্ক কেন?


Dhaka | Published: 2020-10-09 02:20:54 BdST | Updated: 2024-05-18 18:33:23 BdST

ঢাকায় সম্প্রতি বোরকা পরিহিত এক নারীর তার সন্তানের সাথে ক্রিকেট খেলার দৃশ্য একটি সংবাদপত্রে প্রকাশের পর তা রীতিমত ভাইরাল হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি আর মা-সন্তানের মধ্যকার ক্রিকেটীয় উচ্ছ্বাস কিংবা খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।

বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে বহু মানুষের আলোচনার বিষয় হয়েছে ওই নারীর পোশাক। এ নিয়ে পক্ষ- বিপক্ষে আছে যেমন পুরুষ , তেমনি অনেক নারীও।

আবার শুধু চলার পথেই পোশাকের জন্য বিড়ম্বনায় পড়েছেন এমন অভিজ্ঞতা আছে বহু নারীর। তেমনি একজন ঢাকার একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক নাজমুন নাহার।

"আমি বোরকা ও হিজাব পরিধান করি ছোটবেলা থেকেই। আমাকে কেউ জোর করেছে পরার জন্য তা নয় কিন্তু। আমি যে আবহ বা পরিবেশে বড় হয়েছি তাতে মনে হয়েছে, এটাতে ভালো বোধ করি। কলেজে স্কুলে পড়ার সময় নানা জন নানা মন্তব্য করতো। পর্দা মানে বোরকা নাকি-মনের পর্দাই বড় পর্দা- এমন কথা বলতো।

''বোরকা পরে দুষ্টুমি ঢাকার জন্য কিংবা বোরকা প'রে এরা দেশের জন্য কি করবে এমন বলতো। মনে করে বোরকা সব কিছুর অন্তরায়। তারা টিপ্পনী কাটতো। অনেকে মিশতো না, কারণ তারা মনে করতো বোরকা পরে, এমন কারও সাথে মিশলে প্রেস্টিজ থাকবে না," বলছিলেন নাজমুন নাহার।

শহরের বাইরের এলাকাগুলোতে বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজেও নারীকে নিয়মিতই নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয় পোশাকের কারণে।

কুষ্টিয়া জেলায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মৌসুমি আক্তার বলছেন, কোনো পোশাক পরেই নারীকে বাজে মন্তব্য শুনতে হওয়ার ঘটনা গ্রামীণ শহর এলাকাগুলোতেও নেহায়েত কম দেখা যায় না।

"বোরকা পরলে অনেকে মনে করে মেয়েটা হয়তো কিছুটা ভদ্র। কিন্তু যে পোশাকই পরুক কটু মন্তব্য থেকে বের হতে পারছে না। বোরকা, শাড়ি, শার্ট প্যান্ট যাই পরুক, কোনো পোশাকেই মেয়েরা এখন নিরাপদ নয়, তাকে নিয়ে মন্তব্য হবেই," বলেন মৌসুমি আক্তার।

ঢাকার একজন গৃহিনী ফারজানা সাথী বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই হিজাব ও বোরকায় অভ্যস্ত। তার কাছে মনে হয়েছে যারা যেই পোশাকে অভ্যস্ত তারা নিজের সেই পোশাকটাই পছন্দ করেন। কিন্তু অন্য নারীদের পোশাককে কম পছন্দ করেন। বিশেষ করে অনেকের মধ্যে বোরকা হিজাবকে কিছুটা নিচু স্তরের বলে মনে করার প্রবণতা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

"যে যেভাবে চলে সে সেটাই প্রেফার করে। অনেকেই (বোরকা পরা) পছন্দ করে না এবং তাদের মধ্যে একটা সুপিরিয়র ভাব কাজ করে। বোরকা পরা বলতে তারা ভাবে স্ট্যান্ডার্ড না, ব্যাকডেটেড ভাবে তারা। আমিও আমার মতো সার্কেল মেনটেইন করতাম। কালচারে ভিন্নতা থাকবে। তবে ভার্সিটিতেও আমার সমস্যা হয়েছে, এখনও হচ্ছে," মন্তব্য ফারজানা সাথীর।

নারীর পোশাক নিয়ে মন্তব্য শুধু যে পুরুষদের দিক থেকে আসে তাও নয়। যেমনটি বলছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত শাহানা হুদা।

"আমি ঢাকার ধানমন্ডিতে হাঁটছিলাম। হঠাৎ এক ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন মাথায় তো কাপড় দিতে পারেন। আমি প্রথমে ইগনোর করলেও পরে আবার ফিরে এসে উনাকে বললাম যে আমি তো আপনার পোশাক নিয়ে কোনো মন্তব্য করিনি। আপনি কেন আরেকজনের পোশাক নিয়ে কথা বলছেন।

''আমি কি পরবো সেটাতো আমার সিদ্ধান্ত। আবার আমারই কয়েকজন বন্ধু আছে যারা ধর্মীয় বিধান মতো পর্দা করে তাদেরও এমন বিড়ম্বনার শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে।"

অর্থাৎ বাংলাদেশে কোনো ধরণের পোশাকই আসলে নারীকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারে না যে কেউ তার পোশাক নিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে উঠবে না। যদিও ইসলামপন্থীদের দিক থেকে একটি অভিযোগ আছে যে এখন বোরকা, হিজাব এ ধরনের ধর্মীয় পোশাকগুলোকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য বেশি হয় বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

ঢাকার একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা নুসরাত আমিন বলছেন নারীর পোশাক-কেন্দ্রিক যে সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়েছে সেটিকে বড় ধরণের একটি মনজাগতিক বা চিন্তার সমস্যা বলেই মনে করেন তিনি।

"বোরকা পরা মানে যে আমি প্রোগেসিভ না, তাতো না। আমার অধিকার আছে নিজেকে আবৃত করার। এটা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা চিন্তা। দেখুন ছেলেকে ক্রিকেট শেখাচ্ছে, সেটা নিয়ে কেমন ট্রল হচ্ছে। কী পরিমাণ লেখালেখি বা মতামত বিভক্ত হয়ে গেছে।

''এটা কি আপনার মনে হয় যে পোশাক থেকে এসেছে? এটা হলো আমরা কীভাবে চিন্তা করছি। আমরা আসলে একটা ভোগ্যপণ্যের দৃষ্টি থেকেই নারীকে দেখছিলাম," বলছেন নুসরাত আমিন।

তিনি বলছেন যে পোশাকেই একজন নারী থাকুক না কেনো, কোনো না কোনো শ্রেণির একজন তাকে হয়রানি করছে।

"হয়তো কখনো সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরছি। সেখানেই দেখছি মানুষ সহজলভ্য ভেবে ফেলছে। এমনকী ধরুন সব ক্যাটাগরির (মানুষ) -যেমন কোনো বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছি সেখানকার একজন গার্ড একটা কমেন্ট ছুঁড়ে দিলো," বললেন নুসরাত আমিন।

নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে পোশাক পরিধান শুরু করেছিলো মানুষ। কালক্রমে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর অনেকের মধ্যে পোশাকের একটি ধরণও তৈরি হয়। ফলে সবক্ষেত্রে না হলেও অনেক সময় পোশাক দেখেও ধারণা করা হয় যে ব্যক্তিটি কোন দেশ বা সমাজ বা অঞ্চলের।

তবে পোশাক বিষয়টি এভাবে একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে মূলত সমাজ আর পরিবেশের প্রভাবে। গত কয়েক দশকে সামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে যে কটি দেশে পোশাকের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে বাংলাদেশও একটি।

নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বলছেন পোশাকের ক্ষেত্রে নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রতি সম্মান আগেও কম ছিলো, এখন আরও কমেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে এটি আরও দৃশ্যমান হয়েছে মাত্র। তিনি বলেন হিজাব বা বোরকা পরলেই অনেকে ট্যাগ দেন এই নারী পশ্চাৎপদ। আবার অনেকে চাইলেও তার ইচ্ছে মতো পোশাক পরার সাহস দেখাতে পারেন না।

"আমার মাকে আশির দশকে স্লিভলেজ ব্লাউজ পরতে দেখেছি। তিনি কিন্তু মফস্বলের সাধারণ একজন নারী। কিন্তু আমি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লিভলেজ ব্লাউজ পরে ক্লাস নিবো চিন্তা করলেও ভরসা পাইনা।

''কারণ আমি জানি আজ স্লিভলেজ ব্লাউজ পরে আমি ক্লাস নিতে এলে সঙ্গে সঙ্গে মিছিল শুরু হবে। এমনকী ১২ বছর আগে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর পরীক্ষা হলে জিন্স প্যান্ট পরে ডিউটি করতে গিয়েছিলাম তখন একজন ডিন অভিযোগ করেছিলেন আমার বিরুদ্ধে," বলছিলেন জোবাইদা নাসরিন।

বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক বেসরকারি টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেন অনেক নারী। কিন্তু ২০১৯ সালে একজন উপস্থাপককে ঘিরে শোরগোল হয়েছিলো কারণ যখন তিনি সংবাদ পাঠ করছিলেন , তখন শাড়ির সাথে তিনি স্লিভলেজ ব্লাউজ পরেছিলেন। তার সংবাদ পাঠ ছাপিয়ে তখন আলোচনার তুঙ্গে ছিলো ওই ব্লাউজ ।

আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলে টি শার্ট পরে হল অফিসে যাওয়া যাবে না এমন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা তুলে নিতে হয়েছিলো প্রবল সমালোচনার মুখে।

২০১৪ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি মহিলা হোস্টেলে একদল বখাটের হামলার পর গণমাধ্যমে খবর এসেছিলো যে হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়ক- যিনি ছিলেন একজন নারী তিনিই হোস্টেলের মেয়েদের বলেছেন তারা কেন শার্ট প্যান্ট পরে বাইরে যায়?

আবার বছর খানেক আগে একটি বহুজাতিক কোম্পানির একটি পণ্যের ফ্যাশান শোতে একজন মডেল শাড়ির ওপর ব্লাউজ পরেছিলেন যা পণ্যটিকে নিয়ে আলোচনা থেকে সরিয়ে শোরগোল তুলেছিলো পোশাক নিয়ে। এই যে পোশাক এখন এতো আলোচনায় আসছে এটি কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে নাকি আসলে পোশাককেন্দ্রিক সামাজিক দ্বন্দ্বও প্রকট হয়ে উঠেছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আজরিন আফরিন বলছেন, সব ধরণের পোশাক নিয়েই বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়া দেখানোর একটা প্রবণতা চলছে এখন আর এটা নিয়ে সব পক্ষের অতি কট্টররাই সক্রিয়। তারা নারীর যোগ্যতা, মেধা, কাজ, ভালো লাগা কিংবা ইচ্ছা অনিচ্ছাকে ঢেকে দেন পোশাককে সামনে নিয়ে আসার মাধ্যমে, অথচ পোশাক নির্বাচন ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার ও পছন্দের বিষয়।

"যে যেই পেশারই হোক না কেন সব কিছু ছাপিয়ে আলোচনায় আসে পোশাক। পোশাক ডিফাইন করে দিচ্ছে আপনি কথিত 'প্রগতিশীল, উগ্রপন্থী, নাকি পশ্চাদ ধারণার অধিকারী'। পোশাক তো আর মানদণ্ড হতে পারেনা। অনেকে পোশাক পরে সামাজিক বা পারিবারিক চাপ বা আকাঙ্ক্ষার কারণে। এর সাথে আছে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য বা নিরাপত্তা বিবেচনা।

''বাংলাদেশে সাইবার বুলিং বাড়ছে। বিবিসির পেইজ দেখলেও দেখবেন কমেন্ট সেকশনে অনেকে পোশাককে আলোচনায় নিয়ে আসেন। দু ভাগে ভাগ হয়ে যায়- সেটা অতি প্রগতিশীলতা হোক বা অতি উগ্রবাদী হোক। এটা পোশাক এবং এ নিয়ে কমেন্টের ক্ষেত্রেও দেখতে পাই," বলেন মিজ আফরিন।

সব মিলিয়ে নারী কেন কোন পোশাক নির্বাচন করছেন তা নিয়ে চিন্তা না করেই পোশাক নিয়ে নিজের মতামতকেই চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা সমাজে জোরালো হয়েছে বলে মনে করেন আজরিন আফরিন।

বিবিসি বাংলা