আমাদের কেন ভয় নিয়ে চলতে হবে: সায়মা ওয়াজেদ


Dhaka | Published: 2020-10-15 15:05:23 BdST | Updated: 2024-05-18 09:58:30 BdST

বাংলাদেশে ধর্ষণ-নারী নিপীড়নের ঘটনা কমাতে চাইলে সবার আগে নারীর প্রতি মানসিকতার পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ কাঙ্ক্ষিত ওই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ঘরের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই ছেলে ও মেয়ে শিশুদের সমান অধিকার ও সম্মান দিয়ে বড় করার পরামর্শ দিয়েছেন। একটি মেয়ে শিশু যেন ছেলের মতো সাহস, তেজ নিয়ে চলতে পারে সেই শিক্ষা ও মর্যাদাবোধ তার মধ্যে তৈরি করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।

সায়মা ওয়াজেদ বলেন, “আমরা মেয়েরা কেন অস্বস্তিতে থাকব? আমরা কেন ভয়ে থাকব? আমরা কেন গা-টা ঢেকে এভাবে চলতে হবে, না হলে আমাদের দোষ দেওয়া হবে? আমাদের ছোটবেলা থেকে ভয় দিয়ে কেন বড় হতে হবে? আমরা সাহস নিয়ে কেন চলতে পারব না?

“হ্যা, সেলফ প্রটেকশন স্কিলস জানা উচিৎ, অফকোর্স। কিন্তু আমাদের কেন এভাবে থাকতে হবে? কেন আমরা জেন্ডার আইডেন্টিটি নিয়ে চলব? আমরা মেয়ে বলে কেন ভয়ে চলতে হবে? এক্সট্রা কেয়ারফুলি চলতে হবে, অন্যভাবে চলতে হবে? আমাদের যেটা মনে চায়, যেটা ইচ্ছা, যেটা আমরা করতে পারি, সেটা কেন আমরা করতে পারব না?”

বুধবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই), জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) যৌথ উদ্যোগে শুরু হওয়া ‘পাবলিক প্লেসে নারীর নিরাপত্তা’ বিষয়ক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন উদ্বোধনী বক্তব্যে এ বিষয়ে কথা বলেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন।

সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি ও কো-চেয়ারম্যান সায়মা ওয়াজেদ এখন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) দূতের ভূমিকায় আছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ডব্লিউএইচওর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্যও করা হয়েছিল তাকে।

নিপীড়নমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সায়মা ওয়াজেদ বলেন, “আমাদের দেশকে যেন আমরা এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই যেখানে কোনো মেয়ে হয়রানির শিকার হবে না। কোনো মেয়ের অশ্রদ্ধাও হবে না। আমরা যেন সম্মানের সাথে এগিয়ে যেতে পারি। যে যেটার স্বপ্ন দেখছি, যেটা করতে চাচ্ছি মন খুলে যেন এটা করতে পারি।”

সেই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ছোটবেলা থেকেই নারী-পুরুষের সমতার শিক্ষা দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

তিন মেয়ে ও এক ছেলের জননী সায়মা ওয়াজেদ বলেন, “আমার চার বাচ্চাকে আমি যা শেখাব, আমি চাই আমার দেশে ওরকমভাবে সবাইকে শেখানো হোক যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো তফাৎ নাই। আমরা ইক্যুয়াল। আমরা সব জায়গায় ঘরে হোক, বাইরে হোক যেখানেই হোক, রাস্তাঘাটে হোক, স্কুলে হোক এবং কাজকর্মের জায়গায় যেন আমরা নারীর সম্মান তৈরি করি।”

নারী নির্যাতন রুখতে স্কুল-কলেজ, কর্মক্ষেত্র বা পথে-ঘাটে যেখানেই নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটতে দেখা যাবে, সেখানেই নারী-পুরুষ সবাইকে এক হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলারও আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকন্যা সায়মা ওয়াজেদ।

তিনি বলেন, “একটা মেয়ে যদি এক জায়গায় দাঁড়ায়… আমরা যদি দেখি যে তাকে হ্যারাস করা হচ্ছে, তার সাথে প্রতিবাদ করার যদি কেউ না থাকে পাশে তাহলে সে একা কী করবে? কোনো মানুষই একা কী করবে? তার তো সাথে থাকতে হবে, পাশে থাকতে হবে।

“আমাদের ছেলেদের এ শিক্ষাটা দিতে হবে ছোটবেলা থেকে, ঘরের থেকে। এ শিক্ষাটা তো দিতে হবে। বড় হয়ে নিজেদের সংসার করবে, ওই জায়গাটা তো তাকে তৈরি করে দিতে হবে। সম্মানটা কিন্তু ঘরের থেকে সবার আগে হয়।”

বাঙালির ইতিহাসও নারীর প্রতিবাদী চেহারাকে তুলে ধরে জানিয়ে সায়মা ওয়াজেদ বলেন, “আমি যদি জোর গলায় কথা না বলতে পারি নিজের বাড়িতে, আমাদের যদি সব সময় বলা হয় ‘না না না, চুপ থাক’, ‘তুমি বেয়াদবি করো না’, ‘শান্ত থাকো, মাথা ঠাণ্ডা রাখো, ‘প্রতিবাদ করো না’- কিন্তু ওটা তো আমাদের বাঙালি জাতির ইতিহাসে নাই। প্রতিবাদের সময় বাঙালির সবার আগে কিন্তু মহিলারাই ছিল। আমাদের ইতিহাসই যখন বলে, আমরা প্রতিবাদ আগে করব। তা এখন কেন আমরা চুপচাপ থাকব? প্রতিবাদ ভাই-বোন একসাথে মিলে করতে হবে। একা একা করলে হবে না।

“আমাদের দেশে যে কোনো মেয়ে যে বয়সী মেয়ে হোক, সে যেন নিজের সম্মান নিয়ে মাথা তুলে সব জায়গায় হাঁটতে পারে, সব জায়গায় যেতে পারে- এটার কাজ কিন্তু আমাদের একজনের না। এটা আমাদের আশপাশের সবাই আছে। তাদের করতে হবে।”

বাংলাদেশে পথে-ঘাটে চলতে নারীদের যৌন নিপীড়নের চিত্র একটি ভিডিও ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয় এ ওয়েবিনারে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে তরুণরা যুক্ত হয়ে নিজেদের দেখা নিপীড়নের ঘটনা জানান এখানে।

এ বিষয়ে সায়মা ওয়াজেদ বলেন, “কোথাও কোথাও কোনো একটা মেয়েকে যেন ওই প্রশ্ন দেওয়া হয়, তোমরা এ রকম না করলে কিন্তু তোমার কিন্তু উন্নতি হবে না, চাকরি চলে যাবে। এটা কিন্তু প্রত্যেকটা প্রফেশনে হচ্ছে। কিছু কিছু প্রফেশনে আরও বেশি করে হচ্ছে। এগুলো অনেক প্রবলেম আছে।

“এটা আল্টিমেটলি আমরা দেখি ভায়োলেন্স হিসেবে, সেক্সুয়াল আগ্রাসন, রেইপ এগুলো কিন্তু পরে আসছে। কিন্তু তার আগে আসে অ্যাটিচুড, মানসিকতা। এসব যখন আমরা ইগনোর করে যাই তখন কিন্তু প্রবলেম থেকে যায়। আর সোশাল চেঞ্জটা আসবে না।”

নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ প্রতিষ্ঠায় কাজ করার অনুরোধ জানিয়ে সায়মা ওয়াজেদ বলেন, “আমরা যারা অর্গানাইজেশন চালাই, আমরা যারা একেকটা প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার আমাদের একটা বড় দায়িত্ব আছে। আমরা ওইখানে যেন ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাই। আমরা ওইখানে এমন একটা অ্যাটিচুড… এমন একটা পরিবেশ তৈরি করি যে, ওইখানে কোনো একটা মেয়েকে যেন হ্যারাস করা না হয়।”

তিনি বলেন, “এখন এমন একটা সময়েই এ ওয়েবিনার হচ্ছে, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কথা আমরা দেখছি, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের কথা আমরা বুঝতে পারছি, সেক্সুয়াল আগ্রাসন যেটা বাড়ির মধ্যে হচ্ছে, যেটা রাস্তাঘাটে হচ্ছে সেটা আমরা প্রকাশ্যে দেখতে পাচ্ছি। আসলে এই জিনিসগুলো তো একটা অনগোয়িং সমস্যা রয়ে গেছে।

“আমি মনে করি, আসল জিনিসটা হচ্ছে সম্মান, রেসপেক্ট। আমরা মেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকে অন্যভাবে দেখি। আমরা তাদেরকে মনে করি না তাদের সম্মান দেওয়ার যোগ্য, যেহেতু একটা মেয়েকে একটা ছেলের সাথে সমানভাবে দেখি না, দেখতে চাই না বা রেসপেক্ট করি না।”

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক ও ধর্মীয় নানা বিষয়কে কাজে লাগিয়ে নারীদের সম্মানের জায়গাটি নষ্ট করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন।

তিনি বলেন, “গত ৩০ বছরে আমাদের কালচার, ধর্ম, বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করে নারীদের এই যে সম্মান দেওয়ার কথা, এটা চলে গেছে। আর অনেক সময় বেশিরভাগ মেয়েদের তারা কী পরল, তারা কীভাবে চলল, কোথায় গেল… কোন সময় গেল, কোন জায়গায় গেল, কী করছে…খেলাধুলা করবে কি না, এখানে ওইটা ব্যবহার করা হয়- এটাকে একটা নেগেটিভ জিনিস বানিয়ে ঘুরেফিরে আমাদের দোষ দেওয়া হয়।”

এর থেকে বেরিয়ে এসে নারী-পুরুষ সবাইকে মানুষ ভাবার পরামর্শ দেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন।

‘পাবলিক প্লেসে নারীর নিরাপত্তা’ বিষয়ক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সচেতনতা, নারী শিক্ষা ও সমঅধিকার নিশ্চিতকরণসহ নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলে সিআরআই জানিয়েছে।

ওয়েবিনারে তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজ ও আইজিপি বেনজির আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।