করোনার এই সময়ে চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে ৫ লাখ প্রার্থীর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একটি কলেজের স্নাতক পর্বের শিক্ষার্থী তন্বী (আসল নাম নয়)। পরিবারে আয়ের উৎস বলতে তিনিই। চার থেকে পাঁচটি টিউশনে প্রতি মাসে আয় ছিল ২০ হাজার টাকারও বেশি। এই টাকা দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি পরিবারের ব্যয় মেটাতেন তিনি, কিন্তু করোনার কারণে তাঁর সব টিউশন এখন বন্ধ। নিজে কিভাবে চলবেন বা সংসার খরচ কিভাবে চালাবেন, তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুম আহমেদ। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে তিন বছর আগে নেমেছেন চাকরি পাওয়ার যুদ্ধে। ৪০তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন, যা শেষ হয়েছে কিছুদিন আগে। আরো কয়েকটি মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিলেও চূড়ান্ত ফল আসেনি। করোনার কারণে চাকরি পাওয়ার স্বপ্নটাও তাঁর থামকে গেছে।
এমন উদাহরণ দু-একটি নয়, উচ্চশিক্ষা (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) শেষ করা পাঁচ লাখের বেশি চাকরিপ্রত্যাশী বেকার পড়েছেন মহাসংকটে। একদিকে কোনো চাকরি নেই আবার খণ্ডকালীন আয়ের পথও বন্ধ থাকায় উভয়সংকটে পড়েছেন চাকরিপ্রত্যাশী বেকাররা।
জানা যায়, করোনার কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ। কোনো নিয়োগ পরীক্ষার নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও মৌখিক পরীক্ষা হয়নি। আবার কোনো নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হচ্ছে না।
চাকরিপ্রত্যাশীরা বলছেন, করোনার কারণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষার্থীরা সেশনজটের শঙ্কার মধ্যে পড়েছেন। যদিও সেশনজট এড়াতে অনলাইনে ক্লাসে ঝুঁকছে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, করোনার কারণে অন্তত এক বছর পিছিয়ে যাবে শিক্ষা কার্যক্রম। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের নির্ধারিত সীমা অনুযায়ী ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে কেউ আর সরকারি চাকরির নিয়োগে আবেদন করতে পারে না। করোনায় সব নিয়োগ স্থগিত এবং নতুন করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত না হওয়ায় বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি উঠেছে। কেবল সরকারি চাকরিই নয়, বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে এখনই নিয়োগ নেই।
চাকরিপ্রত্যাশী বেকাররা বলছেন, করোনার কারণে নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হচ্ছে না। আবার যেসব পরীক্ষা আধাসম্পন্ন হয়েছে সেগুলোর চূড়ান্ত ফলও প্রকাশিত হয়নি। এতে করে চাকরির অপেক্ষায় দীর্ঘায়িত হচ্ছে প্রত্যাশা। আবার কারো কারো চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমাও শেষ হতে চলছে। একদিকে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই, আবার যেসব বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোও থমকে গেছে। চাকরিপ্রত্যাশী বেকাররা কী করবেন তার কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না।
করোনা পরিস্থিতিতে সরকার ছুটি ঘোষণা করায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান চাকরিতে নিয়োগের কার্যক্রমও স্থগিত করেছে। গত মার্চ থেকে ৫০টির বেশি চাকরির নিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে। এই সময়ে নতুন করে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। যদিও কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান কর্মসংস্থান ও চাহিদা থাকায় নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য মুখিয়ে রয়েছে, কিন্তু করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সেগুলো প্রকাশ করতে পারছে না।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকার ২৩ লাখ ৭৭ হাজার এবং অশিক্ষিত বেকার তিন লাখ। বেকারদের মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষিত, যাঁরা উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। উচ্চশিক্ষা পর্বের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করা বেকারের সংখ্যা চার লাখ পাঁচ হাজার। গত বছরের জুলাই মাসে জাতীয় সংসদে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এ তথ্য জানান।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৪০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৪টি অধিভুক্ত/অঙ্গীভূত কলেজের শিক্ষার্থী ব্যতীত) স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়সহ বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সংখ্যা সাত লাখ ১৪৮ জন।
মূলত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নেন শিক্ষার্থীরা। স্নাতকোত্তর শেষে একটি অংশ পিএইচডি বা এমফিল কোর্সে পড়েন। বড় অংশই চাকরিতে নিয়োগের প্রস্তুতি নিতে থাকে। সেই হিসাবে চাকরিতে প্রবেশে যোগ্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাত লাখের বেশি। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বিপিএসসি) প্রকাশিত ৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনকারীর সংখ্যা প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ। সেই হিসাবে ধরলেও চাকরিপ্রত্যাশী বেকারের সংখ্যা পাঁচ লাখের বেশি।
বিসিএস ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগের সুপারিশ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। ২০১৯ সালে ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আবেদনপত্র গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। চলতি বছরের মার্চে প্রথম ধাপ নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল, কিন্তু সেটি হচ্ছে না।
এদিকে সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগ দেখভাল করে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি সচিবালয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই কমিটি প্রতিষ্ঠানের চাহিদার প্রেক্ষিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তিন ধাপ সম্পন্ন করে চূড়ান্ত নিয়োগ সুপারিশ করে।
সূত্র জানায়, করোনার কারণে দেশজুড়ে অস্থিরতায় চাকরিতে নিয়োগে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কার্যক্রমও এখন স্থগিত। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও নিয়োগ আটকে গেছে। নতুন করে আরো চার হাজারের বেশি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রস্তুতি থাকলেও এখনই সম্ভব হচ্ছে না। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কথা ভাবছে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি সচিবালয়
ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘করোনার কারণে ফল চূড়ান্ত থাকলেও প্রকাশ সম্ভব হচ্ছে না। আবার নতুন করে কয়েকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সিদ্ধান্ত হলেও প্রকাশ করা যাচ্ছে না। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ধাপে ধাপে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।’
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র কল্যাণ পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক মোজাম্মেল মিয়াজী কালের , ‘করোনার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম অন্তত এক বছর পিছিয়ে যাবে। এই ক্ষেত্রে সেশনজট থাকবে। ফলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় কম পাবে। সেই ক্ষেত্রে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়াতে হবে। সব কিছুই এখন স্থবির। চাকরিতে প্রবেশে নতুন কোনো বিজ্ঞপ্তি নেই। আবার যেসব বিজ্ঞপ্তি চলমান, সেগুলোর কার্যক্রম নেই। কাজেই এই অবস্থায় চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়াতে হবে।’
ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা ছিল। ইচ্ছা ছিল রাজনীতি করবেন, কিন্তু রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে নতুন কমিটিতে কোনো স্থান পাননি তিনি। তাই অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও এখন চাকরির যুদ্ধে নেমেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চিন্ময় রায়। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরি পাওয়া সোনার হরিণ পাওয়ার চেয়েও দুর্লভ বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে সব ধরনের চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। এখন এই অবস্থায় যাদের বয়সসীমা শেষের দিকে তারা এক ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হতে যাচ্ছে, আর যারা রাজনীতির সাথে যুক্ত আছে তাদের তো চাকরিতে প্রবেশ করার জন্য সময়ই থাকে না। তাই সব কিছু বিবেচনা করে সারা বাংলার বেকার যুবসমাজের জন্য হলেও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করতে হবে।’