"মা, তুমি কি আমার দুঃখ বুঝিতে পারো?"
"এই দুঃখের দিন কতদিন যাবে?"
পরাধীনতায় আবদ্ধ বাঙ্গালির জাতির শতবছরের ইতিহাস ছিলো সংগ্রাম, ত্যাগ, রক্তক্ষয়, এবং আশার এক জটিল ও বেদনাদায়ক ইতিহাস৷ প্রাচীনকালে মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন রাজাদের শাসনামলে বাঙালিরা কিছু সমৃদ্ধির স্বাদ গ্রহণ করলেও, বারবার বৈদেশিক আক্রমণ তাদের জীবনে দুর্ভোগ বয়ে আনে।হুণ, তুর্কি, মঙ্গোল, আফগানদের আক্রমণ ও লুণ্ঠনের বার বার শিকার হয় বাংলা। বর্ণপ্রথা ও জাতিভেদের কারণে সমাজের নিচের তলার মানুষ অত্যাচার ও শোষণের শিকার হয়। দুঃস্থ মানুষদের উপর জমিদারদের অত্যাচার ছিল অসহ্য। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের কারণে সমাজে অন্ধবিশ্বাস ও কুপ্রথা বিরাজমান ছিল। নারীরা সমাজে পিছিয়ে ছিল এবং তাদের অধিকার ছিল সীমিত। মধ্যযুগে
তুর্কি শাসনামলে বাংলায় হিন্দুদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। মুঘল আমলে জমিদারদের অত্যাচার, দুর্ভিক্ষ, মহামারী বাংলার মানুষকে করে তোলে মুমূর্ষু।মুসলিম শাসকদের ধর্মান্তরকরণ নীতির ফলে অনেক হিন্দু ধর্মান্তরিত হয়।বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়ে।
আধুনিক যুগে ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার সম্পদ লুণ্ঠিত হয় এবং বাঙালি জাতি ঔপনিবেশিক শোষণের শিকার হয়।
দুর্ভিক্ষ, কৃষিঋণ, শোষণ বাঙালির জীবন করে তোলে অসহ্য। বাংলার আকাশে তখন দুর্যোগের ঘনঘটা। কে তাকে আশা দেবে, কে তাকে ভরসা দেবে। বাঙ্গালী জাতির হাজার বছর শৃঙ্খলমুক্তির সংগ্রামের মহানায়ক রূপে, শত বছরের বাঙ্গালীর আর্তনাদ ও হাহাকারের আশার আলো রূপে শত বছরের নিরীহ, নিপীড়িত ও মুমূর্ষু বাঙালি নরনারীর বেদনার বিপ্লব হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই মার্চ (৩রা চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দ) রাত ৮টায় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের বাইগার নদী তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭ মার্চ, বাংলার নবজাগরণের সূচনালগ্ন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। যাঁর অদম্য সাহস, দূরদর্শিতা ও অদম্য মনোবলের বলে আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। এই দিনটি কেবল একটি জন্মদিনের উৎসব নয়, বরং এটি বাঙালি জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিনটি আমাদের স্বাধীনতার সূর্যোদয়, বাঙালি জাতির গর্ব ও আত্মমর্যাদার প্রতীকরূপে বিবেচিত। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সংহতির দিন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন আমাদের সংগ্রামের দিন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন আমাদের বিজয়ের দিন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন বাংলার নবজাগরণের দিন। বঙ্গবন্ধু শুধু একজন নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আলোকিত ব্যক্তিত্ব, একজন মানবতাবাদী, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২৭ সালে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তাঁর সাত বছর বয়সে। নয় বছর বয়সে তিনি ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে এবং পরে ম্যাট্রিক পাশ করেন গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে।
ছাত্র আন্দোলন এবং রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে ওঠার আগে অন্য আরো দশজন কিশোরের মত শেখ মুজিবুর রহমান খেলার মাঠকেই বেশি ভালোবাসতেন। ফুটবল খেলার প্রতি ছিল তাঁর দুরন্ত টান। একজন মেধাবী ফুটবলার হিসেবে কৈশোরে কুড়িয়েছিলেন অসামান্য খ্যাতি। প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলাগুলোতে কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ মুজিবুর রহমান নিয়মিত পুরস্কৃত হতেন।
তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে। ১৯৪২ সালে এন্ট্রান্স পাশ করার পর শেখ মুজিব ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে, যেটির বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ। ১৯৪৭ সালে সেখান থেকেই তিনি বি.এ. পাশ করেন। ওই কলেজে পড়ার সময় কলকাতায় সরকারি বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর ঘরে থাকতেন শেখ মুজিবুর রহমান, যে ঘরটিকে এখন জাদুঘর করা হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের (অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের শাখা) কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন পর্যন্ত তিনি তাঁর দায়িত্ব প্রশংসার সাথে পালন করেন। ১৯৪৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কুখ্যাত ক্যালকাটা কিলিং (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা) শুরু হলে শেখ মুজিবুর রহমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং শান্তি বজায় রাখার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন, নিজের জীবন বাজি রেখে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষদের জীবন রক্ষা করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বতন্ত্র, স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে আন্দোলনে যোগ দেন। যদিও এই উদ্যোগ বাতিল হয় কিন্তু পরবর্তীতে এটিই একজন জাতির পিতার স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি হয়ে ওঠে। অন্যান্যদের মত ভারত ভাগের পরপরই শেখ মুজিবুর রহমান তড়িঘড়ি করে পূর্ববঙ্গে (পাকিস্তানে) আসেননি, বরং কয়েক সপ্তাহ তিনি কলকাতায় অবস্থান করেন, রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে মহাত্মা গান্ধীর শান্তি মিশনে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে
শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গণপরিষদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে অবশ্যই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে মেনে নিতে হবে।” শেখ মুজিবুর রহমান এই ঘোষণার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ জানান। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মুসলিম লীগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কর্মতৎপরতা শুরু করেন। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকজন সহকর্মীসহ গ্রেফতার হন। শেখ মুজিবের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ মুসলিম লীগ সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য ছাত্রনেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৪৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের চাকরির নিরাপত্তা বিধান এবং অধিকার আদায় আন্দোলনে সমর্থন জানান। ১৯ এপ্রিল চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পক্ষে মিছিল বের করার প্রস্তুতিকালে কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ শেখ মুজিবুর রহমানকে উপাচার্যের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমান আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কারাগারের বন্দী থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন, “একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’’ জেলে বন্দী অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন এবং আন্দোলনকে সফল করার জন্য জেল থেকেই পাঠাতেন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শেখ মুজিবুর রহমান জেলের ভেতরেই টানা ১১ দিন ধরে আমরণ অনশন চালিয়ে যান এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট আহ্বান করে। আন্দোলনরত ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক,সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউর সহ আরো অনেকেই। জেল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান শহীদদের প্রতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানান। একই বছর শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন সফর করেন। শান্তি সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় বক্তৃতা দেন, ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে যান বৈশ্বিক অঙ্গনে।
৫২'র ভাষা আন্দোলন , ৫৪'র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যায়ে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬'র ৬ দফা, ৬৯'র গণঅভ্যুত্থান , ৭০'র সাধারণ নির্বাচন, ৭১'র মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশ বিনিমার্ণের সকল লড়াই সংগ্রাম আন্দোলন, এবং দ্রোহের একত্রিত সাহসী উচ্চারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৫২ এর টগবগে তরুণ মুজিব ৬৬ বা ৬৯ ছাড়িয়ে এ হয়ে যান বঙ্গবন্ধু, ৭১ এর ৭ মার্চে হ্যামিলনের বংশীবাদক, ২৫ মার্চের ঘোর অন্ধকারে এক যাদুকর।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙ্গালী জাতি হিসাবে একটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র পেয়েছে, বাঙ্গালীর শত বছরের পরাধীনতা শিকল ভেঙ্গে বাঙ্গালী জাতিকে নতুনরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজ্বলিত এক নক্ষত্র,অগনিত মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক প্রস্ফুটিত গোলাপ। বাঙ্গালি বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন-তার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা, অহঙ্কারের সাতকাহন, আত্ম মর্যাদার প্রতীক-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালির চেতনার রাজ্যে মুকুটহীন রাজা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি।
এদেশের স্বাধীনতা,মুক্তিযুদ্ধ,স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে জ্বলজ্বলমান যে নামটি, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ২৩ বছরের গোলামীর জিঞ্জির ভেঙে তার ডাকেই ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছিল দূর্গ। হাজার হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থেকেও তিনি ছিলেন মুক্তিসেনাদের ট্রেনিং ক্যাম্প আর শরণার্থীদের রিফিউজি ক্যাম্পের মানুষগুলোর হৃদয় মাঝে ভাস্বর হয়ে। তাঁর নামেই উজ্জীবিত হয়ে জীবন বাজি রেখে এক মুহুর্তের জন্যও কুন্ঠিত হয়নি বাঙালী। সেই উজ্জীবনাকে জাগিয়ে রাখতেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার শব্দসৈনিকদের কন্ঠে ঘোষণা ভেসে আসতো, “বঙ্গবন্ধু আমাদের সাথেই আছেন”। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরাধীন বাংলার রাজনৈতিক আকাশের ঊজ্জ্বলতম নক্ষত্র, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশ্বনন্দিত নেতা। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ ডামাডোল আর ধ্বংস স্তুপের মাঝে দাড়িয়েও বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যথার্থই বলেছিলেন,
‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।/দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান/তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।’
স্বাধীনতার পর পাক-হানাদার বাহিনীর বন্দীশালা থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রথম যে দিন স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন, তিনি সেদিন তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলা, মাটি ও মানুষ, রক্ত ও লাশের স্তুপ দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি।তিনি কেঁদেছিলেন। দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। তার বুকে ছিল এক সাগর ভালোবাসা। অশ্রু ঝরছিল সেদিন এই স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যা তার বুকের গভীরে আঁকা ছিল।প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু আমাদের অনুভূতি ও অন্তর আত্মায় মিশে আছেন। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। শেখ মুজিব মানেই স্বাধীন বাংলাদেশ। জাতির পিতার প্রতি আমাদের ঋণ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অশেষ। শেখ মুজিব মানেই বাংলার মুক্ত আকাশ। শেখ মুজিব মানেই বাঙালির অবিরাম মুক্তির সংগ্রাম। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৭ মার্চ ৫২ বছরে পা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এদিন বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, "আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী?" উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'জনগণের সার্বিক মুক্তি'। এর পর তিনি যা বলেছিলেন, তা রীতিমত শিউরে ওঠার মতোই। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, "যে জাতি অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটায়, কথায় কথায় তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়, সে জাতির নেতা হিসেবে আমি জন্মদিন পালন করতে পারি না।এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।"
১৯৯১ সালের ১৩ অগাস্ট পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে 'শেখ মুজিব আমার পিতা' শিরোনামে প্রবন্ধ লিখেছিলেন কন্যা শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি বলেন, "…নানা শেখ আবদুল মজিদ আব্বার আকিকার সময় নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান।…নাম রাখার সময় বলে যান- 'মা সায়রা, তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম, যে নাম জগৎজোড়া খাত হবে'।"
হয়েছেও তাই। বিশ্ব ইতিহাসের মহানায়ক হয়েছেন আমাদের জাতির পিতা। অসীম ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাহস, প্রজ্ঞা, বলিষ্ঠ এবং আপসহীন নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতীয় ভীত গড়ে দিয়েছেন তিনি। অতি সাধারণ এক জাতি সংগ্রামীতে রূপান্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশ। এ কারণেই তিনি অবিসংবাদিত নেতা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতোই আমাদের প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে চির জাগরুক হয়ে থাকুক শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের বঙ্গবন্ধু। বাংলার আকাশে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সূর্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিজেকে গড়ুক, জাতির পিতা জন্মদিনে এটিই প্রত্যাশা। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে জনপ্রিয় সংগীত ব্যান্ড ভাইকিংসের সুরে বলতে চাই -
"সে কাঁধে রাখা হাত, স্নিগ্ধ প্রভাত
চেতনার ঝড়, আগুনে মলাট
মহাকালের গর্ভে জন্ম নেয়া স্বাধীনতার ইতিহাস!
হৃদয় জুড়ে গ্রাফিতি তোমার,
সোনার বাংলা প্রাণ
প্রিয় পতাকার লহরী তুমি,
প্রিয় মানচিত্রের মান।"
লেখক : পল্লব রানা পারভেজ, কর্মসংস্থান সম্পাদক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।