আযাব || মেহেদী হাসান


Dhaka | Published: 2021-08-01 04:56:58 BdST | Updated: 2024-11-04 16:48:08 BdST

রহমান আলীকে একটি তালাবদ্ধ অন্ধকার ঘরে রাখা হয়েছে। চারদিকে অন্ধকার হওয়ার জন্য কোন কিছুই যেমন চোখে দেখা যাচ্ছে না তেমনি সাথে কেউ আছে কিনা সেটাও বুঝতে পারছেন না। সন্ধ্যার পর থেকেই রহমান আলীর জীবনে এক ভয়ংকর আযাব নেমে আসে। হঠাৎ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে আক্রমন শুরু করে। গ্রামের মানুষ সারা দিনের ক্লান্তি শেষে যার যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল।তখন ঘটে তাদের মনের মধ্যে লুকানো সেই ভয়ংকর হামলা। কারণ সময়টা খারাপ। সংগ্রাম চলছে।

চারদিকে চিৎকার, কান্না আর গুলির শব্দ। মিলিটারির বুটের শব্দে কেমন জানি একটা দানবীয় পরিবেশ বিরাজ করছে।সন্ধ্যার দিকে যখন মাগরিবের নামাজ শেষ করে রহমান আলী বাসায় ফিরে আসছিলেন তখন তিনি একদল মিলিটারিকে তাদের বাড়ির দিকে প্রবেশ করতে দেখেছেন। তিনি বিলম্ব না করেই দ্রুত বাড়িতে প্রবেশ করেন।

বাড়িতে প্রবেশ করেই রহমান আলীর মাথায় বাঁজ পরার মতো অবস্থা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দল তাঁর বাড়ি মুহূর্তেই মধ্যেই ভেঙে ফেলেছে এবং বাড়ির নারী ও শিশুদের আলাদা আলাদা কক্ষে রেখেছে। মহিলাদের আর্তনাদ ও শিশুদের চিৎকারে চারপাশে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে।

মেজরের কাছে গিয়ে রহমান আলী সালাম দেয়। তখন পাকিস্তানি মেজর বলে উঠে তুম হো ভারতীয় দালাল কা বাপ।

রহমত আলি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাঁর মাথায় শুধু অবিবাহিত কন্যাদের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে শুনেছে পাকিস্তানি সৈনরা মেয়েদেরকে লাঞ্ছিত করে।নানা ভাবে অত্যাচার করে। যখন এই সব বিষয় তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তখনই মেজরের বাঁজখাই কন্ঠ...

মেজরঃ রহমান আলী , আই এম টকিং ইউথ ইউ। অন্সার মাই কুশ্চান। where is the bloody karim?
রহমান আলীঃ হি ইজ গোয়িং হিজ আংকেল’স হোম।
মেজরঃ হা হা , আংকেল’স হোম? Attaking in Pakistani camp is uncle’s home? you Bloody Motherfukker Bangali .... we tecah you proper way.... just wait....
রহমান আলীঃ you can do any thing but don’t harm my village people,they are innocent.
মেজরঃ Innocent? they support Moktibahini, attack pakistany Army?
মেজরঃ set fire all village houses.

ইতোমধ্যে রহমান আলীর হাত- পা বেঁধে ফেলা হয়েছে।বন্ধুক দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে যাচ্ছে।করিম সম্পর্কে তথ্য জানতে চাচ্ছে। কিন্তু রহমান আলী কথা বলছে না। কারণ তাঁর ছেলেকে কথা দিয়েছে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি করিমের অবস্থান সম্পর্কে কাউকে বলবেন না। অপারেশন আলফা মহাগুরূত্বপূর্ণ। যেকোনো মূল্যে এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর জন্য তিনি তাঁর ছেলেকে কুরবাণী দিয়েছেন এখন হয়তো তাঁর পরিবারসহ গ্রামবাসীকে মূল্য দিতে হবে।

কিছুক্ষণ বাদেই তোরাব মেম্বার এসে উপস্থিত, তার সাথে ৪০ -৫০ জনের নানা বয়সী নারী,পুরুষ এবং মেয়ে। তাদেরকে মেজরের পরামর্শে বাড়ির দক্ষিণের বাংলা ঘরে রাখা হয়েছে। তোরাব মেম্বারকে দেখে রহমান আলীর গাঁ ঘিন ঘিন করছে কারণ তোরাপ মেম্বার করিমের যুদ্ধে যাবার সকল খবর পাকিস্তানি মেজরকে সরবরাহ করেছে। রহমান আলী তোরাব মেম্বারের দিকে এগিয়ে আসতেই একজন সৈনিক এসে রহমান আলীকে মাথায় আঘাত করে যার ফলে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

মেজরঃ তোরাব আলী তুমি সাচ্ছা পাকিস্তানী। এখন আমরা তোমাদেরকে সাচ্ছা পাকিস্তানি বংশ উপহার দিব। যারা পাকিস্তানিদের ঝান্ডা বহন করবে।

এই কথা বলা শেষ করে পাকিস্তানি মেজরের সামনে একটি ১৭-১৮বছর বয়সী মেয়েকে জোর করে নিয়ে আসা হয়। মেয়েটি বাঁচার জন্য শত আকুতি –মিনতি করে। আল্লাহর দোহায় দিয়েও শেষ রক্ষা হয় না। পাকিস্তানি মেজর ভিতরের বাড়িতে নিয়ে মেয়েটির উপর পাশবিক নির্যাতন করে। এই ভাবে একের পর এক মেয়েকে ধরে এনে নির্যাতন করা হয়। শারীরিক নির্যাতন শেষে তাদেরকে অন্ধকার ঘরে রাখা হয়। জ্ঞানহীন তোরাব আলীকে সেই অন্ধকার ঘরে রাখা হয়েছে। ফজরের আযান হচ্ছে। মোয়াজ্জিন বলে যাচ্ছে আসসালাতু খাইরুমমিনাল নাউম...তখন রহমান আলীর জ্ঞান ফিরেছে। একের পর এক গতকালের ঘটনা গুলো মনে পড়ছে। তার নিকট মনে হচ্ছে এশার আযান ,কিন্তু এশার আযানে তো আসসালাতু খাইরুমমিনাল নাউম বলার কথা না। তারমানে সারারাত্র এইভাবে অন্ধকার ঘরে কেটেছে। তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যদের কি পরিণতি হয়েছে?এমন নানা প্রশ্ন তাঁর মনে উদয় হচ্ছে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দল রাত্রভর মেয়েদেরকে নির্যাতন,ধর্ষণ করে অন্ধকার ঘরে নিক্ষেপ করেছিল।
ভোরের আলো ফুটবে ,চারদিকের ঘুট ঘুট অন্ধকার দূরীভূত হচ্ছে এমন সময় তোরাপ মেম্বার একটি মেয়েকে বিবস্ত্র অবস্থায় ঘরে নিয়ে আসে। রহমান আলী তাঁর পরনের পাঞ্জাবী দিয়ে মেয়েটিকে ঢেকে দেয়। এরপর একেরপর এক নির্মম শারীরিক নির্যাতনের কাহিনী শুনতে থাকেন। অপমানিত, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত মেয়েদের আর্তনাদে আকাশ- বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। রহমান আলী সবাইকে শক্ত থাকতে বলে এবং এর প্রতিশোধ নিতে করিমের জন্য দোয়া চায়। এমন সময় তোরাব মেম্বার রহমান আলীকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় ,টেনেহিঁছড়ে বাহিরে নিয়ে আসে।

তোরাব আলী মেজরের কানে কানে কি যেন বলতে থাকে তখন দক্ষিণের ঘর হতে রহমান আলীর বড় মেয়ে আসমাকে নিয়ে আসে।বাড়ির উঠানে সকলের উপস্থিতিতে তোরাপ আলী আসমার বুকে, শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অংশে হাত দিতে থাকে। তখন পাকিস্তানি মেজরের নির্দেশে তোরাব আলী আসমাকে ধর্ষণ করে। বাবার সামনে মেয়ের এমন পরিণতি রহমান আলীর হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দেয় ,আল্লাহর কাছে এই জালিমদের ধবংস কামনা করে। তখন মেজরের নির্দেশে তোরাব মেম্বার রহমান আলীকে গুলি করে । আসমাকে ঘরে ফেলে আসে । পিতার করুন মৃত্যু এবং নিজের অপমান সহ্য করতে না পেরে দা দিয়ে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করে।
আসমার নিথর দেহ ঘরের মেঝেতে পরে থাকে। বাড়ির অন্য মেয়েরা ভয়ে চিৎকার চেচামেচি শুরু করে। তখন পাকিস্তানি সৈন্যের দল এসে এলোপাথারি গুলি করতে থাকে ,এইভাবে ঘরের মধ্যে কারবালার হত্যাকান্ড ঘটে যায়।

রহমান আলীর স্ত্রী, ছোট মেয়ে বানু এবং বাড়ির কাজের ছেলে হাসানের মৃত্যু হয়। পাকিস্তানীদের এই বর্বরতা থেকে রহমান আলীর চার বছরের ছোট শিশু রহিমেরও রক্ষা হয় নি। মা মা বলে চিৎকার করে যখন তাঁর মায়ের মৃত্যুদেহের নিকট আসছিল তখন তোরাপ আলী এসে পুনঃরায় গুলি করে তাদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করে। চারদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত। কোনটা নারী বা পুরুষের রক্ত তা আলাদা করা মুশকিল। কারণ রক্তের কোনো আলাদা জেন্ডার নেই, নারী-পুরুষ ও শিশু সবার রক্ত একই। একই রক্ত ধারণ করার পরও মানুষের মধ্যে অনেক বিভাজন। কেউ শাষক, কেঊ শোষিত, কেউ স্বাধীনতা কামী আবার কেউ স্বাধীনতা হরণকারী। বড় বৈচিত্র্যময় এই জগৎ। কেউ রক্ত ঝরিয়ে জীবন দেয় আবার কেউ রক্ত ঝরিয়ে পাশবিক আনন্দ করে। মনে হয় রক্ত পান তাদের নেশা।

অন্যদিকে বাড়ির উঠানে পরে আছে রহমান আলীর লাশ। পাকিস্তানি মেজরের নির্দেশে একটি কবর খুঁড়ে তাদেরকে গণকবর দেওয়া হয়।

সকাল ১১টার দিকে মাইকিং করে করিমের তথ্য দিতে গ্রামবাসীকে নির্দেশ দেওয়া হয় ,অন্যথায় রহমান আলীর পরিণতির কথা শ্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। নির্যাতিত অন্য মেয়েদেরকে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। আটককৃত পুরুষদেরকে বেঁধে নদীর তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ফায়ারিং করে সকলকে হত্যা করা হয়। মনে হচ্ছে মণিপুর গ্রামে দোজগের আজাব নেমে এসেছে। মৃত দেহগুলো খোয়াই নদীর স্রোতের দিকে নিক্ষেপ করা হয়। ক্ষণিকের জন্য খোয়াই নদীর পানির রং লাল হয়ে যায়।কিন্তু হঠাৎ তীব্র স্রোতের টানে মৃত দেহগুলো তলিয়ে যায়। আবার কিছু দূরে ভেসে উঠে।
হাবিয়া দোজগের আযাবের বিবরণ শুনেছি।কিন্তু দোজগের আযাব তো এমন নয়?

লেখকঃ মোঃ মেহেদী হাসান, প্রভাষক, রসায়ন বিভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ। ৩৬তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার