সাইফ আহমেদ : মন দেয়া নেয়ার শুরুটা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং চলাকালে। সুমি আর আমি একই কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। পড়াশোনায় প্রতিযোগিতা থাকলেও পরীক্ষার সময় সহযোগিতমূলক আচরণ ছিল আমাদের মাঝে। শিট ফটোকপি করে দেয়া, বই কেনার সময় একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, ফোনে পড়াশোনার খবর নেয়া এভাবেই কাছে আশা শুরু।
বই কেনার প্রয়োজনে প্রায়ই নীলক্ষেতে যেতে হত। আমরা শাহবাগ থেকে রিকশায় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে নীলক্ষেতে যেতাম। ফেরার পথে টিএসসিতে সময় কাটাতাম মাঝে মাঝে। ফুচকা খেতে খেতে পড়াশোনার বাইরে ভালো লাগার বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে কথা হতো দুজনার। রিকশায় পথ চলতে চলতে সেসময়ের খুনসুঁটি এখনও আমাকে নষ্টালজিয়ায় ফেলে দেয়। এভাবেই চলছিল বেশ।
একসময় অনুভব করলাম সুমির প্রতি আমার বন্ধুত্বের বাইরেও আরেকটি বিষয় কাজ করছে। সেটি হল মিসিং। ওকে বিদায় জানানোর পর বাসায় ফেরার আগ পর্যন্ত তাকে নিয়েই চিন্তা হত। অনেকসময় বাসায় ফিরেও তার ঘোর কাটতো না। সেসময় জানা ছিল না এরই নাম ভালোবাসা...
ভর্তি পরীক্ষায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। কিন্তু সুমির চান্স হয়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়েছে তার। আমিও সেখানে চান্স পেয়েছিলাম। প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সুমির বাধার কারণে সেখানে ভর্তি হতে পারিনি। রাবিতে ভর্তি হতে না পেরে সেদিন কেন জানি প্রচণ্ড মন খারাপ হয়েছিল। বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল সুমি। রাতে মোবাইলে শান্তনার বাণী শোনানোর পর একটি এসএমএস আমার সবকিছু পাল্টে দেয়।
‘আনেক মিস করছি তোমায়, তবে এই মিসিংটা সারাজীবন আমি বয়ে বেড়াতে পারবোনা।’
পরক্ষণেই মনে হল আমি ভুল করে ফেলেছি। বাধা না মেনে আমাকে রাবিতেই ভর্তি হওয়া উচিত ছিল। কাছাকাছি থাকলে তার ওই কষ্ট বয়ে বেড়াতে হত না। বুঝতে পারলাম সুমি আমাকে ভালোবাসে। এরই মাঝে ঢাবিতে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তবে রাবিতে ক্লাস শুরু না হওয়ায় সুমির সময় কাটছে বাড়িতে। ভালোবাসার কথাটা বলা হচ্ছে না তাকে। বাড়িতে থাকায় ফোনেও তেমন একটা কথা বলতে পারছি না। শুধুমাত্র এসএমএস চ্যাটিং হতো দুজানার মাঝে। চ্যাটিংয়েই প্রকাশ পায় সুমি আমাকে কতটা ভালোবাসে।
এভাবে চলল দুই মাস। আমার কাছে যেন মনে হল আমি দুই বছর পার করে ফেলেছি। রাবিতে নবীনবরণের দিনে আমি আর সুযোগটা মিস করতে চাইনি। তাকে চমকে দিয়ে রাবি ক্যাম্পাসে হাজির আমি। ওরিয়েন্টেশন নিয়ে বের হওয়ার পথে ওর সঙ্গে দেখা। ওর হাতে রজনীগন্ধা আর আমার হাতে লাল গোলাপ। সুমির সঙ্গে তার এক বান্ধবী আর আমার সঙ্গে রুয়েটের এক বন্ধু।
আমাকে দেখে সুমি যেন তাজ্জব বনে গেল। কিছুক্ষণ কোন কথা হল না। দুষ্টু ছেলে এভাবে কেউ সরপ্রাইজ দেয়! এমন প্রশ্নের কোন উত্তর নেই আমার কাছে। দু'চোখের কোণে দুই ফোটা জল গড়িয়ে পড়ার আগেই জানালাম তোমাকে মিসিংয়ের কষ্ট বয়ে বেড়াতে দিতে চাই না। কেয়ারিং-শেয়ারিংয়ে জড়াতে চাই। ভালোবাসা শব্দটা উচ্চারিত হয়নি কারো মুখে তবে ওর চোখের ভাষাই বলে দিল কতটা ভালোবাসা রয়েছে ওর মাঝে।
রাজশাহীতে আমি দুইদিন ছিলাম। বন্ধুর মেসে থেকে দুইদিন দুপুরের পর পুরোটা সময় কেটেছে সুমির সঙ্গে। ওই সময়টা কেটে গেছে খুব দ্রুত। বিদায়ের সময় হয়েছে। রেলস্টেশনে সুমি আমাকে বিদায় জানাতে এসেছে। এবার কিন্তু ওর হাতে রজনীগন্ধা নেই। হাতে লাল গোলাপ, মুখে হাসি। বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার সেই হাসি মলিন হতে লাগলো। ট্রেন ছেড়ে দেয়ার সময় যেন মনে হল ওর চোখের কোণে ভালোবাসার জল খেলা করছে। একটু অভয় দিলেই গড়িয়ে পড়বে। ট্রেনের কামড়ায় সময় কেটেছে এসএমএস চ্যাটিংয়ে।
ও আচ্ছা সুমির একটু বর্ণনা দিয়ে নেই। ওর বাড়ি খুলনায়। বাবা সরকারি চাকরি করেন। মা-বাবার আদরের সন্তান। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ওই মেয়েটি জেদী হলেও ভীষণ সুন্দরী। কোচিংয়ে থাকাকালেও তাকে দুইজন প্রেমের অফার করে। তবে সুমির প্রেম-টেমের প্রতি কোন আকর্ষণ নেই। পড়াশোনা নিয়েই তার সময় কাটে। স্বপ্ন একজন ভালো মানের প্রকৌশলী হয়ে উঠার। তবে রাবিতে ভর্তি হতে হয়েছে পদার্থ বিজ্ঞানে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দুই বছর আমাদের প্রেম চলেছে পুরোদমে। ওর সঙ্গে এসএমএস আর ফেইসবুক চ্যাটিংই বেশি হত। ফোনে কথা বলা হত কেবল রাত ১২ টার পর। এভাবেই চলছিল। হঠাৎ আমাদের ভালোবাসায় ছন্দপতন হল। কেন জানি সুমিকে অপরিচিত মনে হতে লাগলো। আগের মত চ্যাটিং আর জমে ওঠে না। রাত ১২ টার পর বেশিরভাগ সময়ই সে ঘুমের রজ্যে চলে যায়। যদিও সেটা ছিল তার বাহানা জানতে পারলাম পরে। এরই মাঝে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম পড়াশোনা নিয়ে। ক্লাস, ল্যাব, টিউশনি নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত আমি। সময় করে রাজশাহী গেলাম। প্রথমদিন ওর ব্যস্ততার কারণে দেখা হয়নি। দ্বিতীয় দিনে বিকেলে দেখা হয়েছে ক্যাম্পাসে। সুমিকে দেখে কেন জানি অচেনা মনে হতে লাগলো।
সেদিন কথা কম হয়েছে। বেশিরভাগ সময় কেটেছে চুপ করে থেকে। কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না, আমি কী কোন ভুল করেছি। বহু চিন্তা করেও নিজের কোন ভুল পেলাম না। বিদায় বেলায় ব্যস্ততা দেখিয়ে সুমি আর রেলস্টেশনে এলো না। মেনে নিলাম। ট্রেনে ওঠার পর থেকেই তার ফোন বন্ধ পেলাম। টেনশনে দুই ষ্টেশন পরেই আমি নেমে গেলাম। আবার রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
রাবি ক্যাম্পাসে গিয়ে তার বিভাগে খবর নিয়ে জানলাম ও হলে চলে গেছে। হলে গিয়েও তার কোন বান্ধবীর দেখা পেলাম না। সন্ধ্যা পর্যন্ত আশেপাশেই ছিলাম। সন্ধ্যার পর দেখা হল সুমির এক বান্ধবীর সঙ্গে। জানতে পারলাম ও আজ হলে ফিরবে না। তার আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছে সুমি। ফোন বন্ধ থাকায় কোন যোগাযোগ হল না।
পরদিন ক্যাম্পাসে সকাল থেকে অপেক্ষা করছি সুমির জন্য। ওর ক্লাস কখন তাও জানি না। বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানলাম ওদের ক্লাস দুপুরে। অপেক্ষায় রইলাম, সুমির দেখা পেলাম না। কেন এমন হচ্ছে। সুমির ফোন বন্ধ। টেনশন হচ্ছে প্রচণ্ড।
দুইদিন অপেক্ষার পর দেখা পেলাম সুমির। একাডেমিক ভবনের সামনে আমাকে দেখে আঁতকে উঠলো সুমি। সারপ্রাইজ নয় এবার যেন তার চোখেমুখে খেলা করছে ভয় আর নিজেকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা।
কি হয়েছে তোমার? পরে কথা বলবো, ক্লাস আছে বলেই চলে গেল সুমি। কিছুই বলতে পারলাম না। ক্লাস শেষে দেখা হল। মোবাইল নম্বর চেইঞ্জ করেছে সুমি। আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে হয়নি তার। জানালো একটি ছেলে খুব ডিস্টার্ব করছে তাই মোবাইল চেইঞ্জ করেছে সে। তার ফোন নম্বর নিয়ে আবার ঢাকায় চলে এলাম।
প্রথম প্রথম দুই তিনবার ফোন দিলে ওপাশ থেকে মোবাইল ধরেই ব্যস্ততার কথা বলে রেখে দিত সুমি। সংখ্যাটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলো। ৫ বার ফোন দিলে হয়তো একবার ধরতো। মাঝে মাঝেই দীর্ঘ সময়ের জন্য ওয়েটিং পাওয়া যেত কল। ফোন করলেই উত্তর মিলতো না অনেক প্রশ্নের। এভাবেই চলে গেল আরও ৬ মাস।
হঠাৎ একদিন ওর বান্ধবীর ফোন থেকে একটি কল আমার জীবনটাকে উলটপালট করে দিল। জানাল সুমি বিয়ে করেছে। ওর স্বামী বিসিএস ক্যাডার। পরিবারের কথায় নাকি নিজের ইচ্ছায় এমন বিয়ে হয়েছে সেটা জানা হল না। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ওই খবরটা শোনার পর থেকে আমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল। তবে এখন আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি। নিজেকে সামলে ক্যারিয়ারের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছি। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না।
সুমিকে বলছি, তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। অক্ষেপ আছে। বিসিএস ক্যাডার এত প্রয়োজন ছিল আর কটা বছর অপেক্ষা করতে পারলে না। তোমার জন্য তো আমি সবই পারি। বিসিএস ক্যাডার হতে পারব না...!!!
ভালো থেকো তুমি...
সাইফ আহমেদ
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছবিঃ মডেল, প্রিয় ডক কম থেকে নেয়া
বিডিবিএস