নাস্তিকতা নয়, ধর্মীয় বিদ্বেষ উগ্রবাদের উৎস


সিরাজুজ্জামান | Published: 2022-12-31 21:08:19 BdST | Updated: 2024-04-29 13:52:08 BdST

প্রাচীন গ্রিসে সাধারণভাবে মুক্তচিন্তার প্রাধান্য থাকলেও মাঝে মাঝে রাষ্ট্র কর্তৃক মুক্তচিন্তকদের ধ্বংস করবার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। নাস্তিক অ্যানাকসাগোরাস (৫০০-৪৮২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) বলেছিলেন যে, সূর্য একটা বিরাট আগুনের গোলা, দেবতা নয়। তিনি আরও বলতেন যে, বস্তুকণার সমাহার থেকেই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই অপরাধে তাকে এথেনস থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তার সমস্ত লেখা পুড়িয়ে ফেলা হয়। যে রাষ্ট্রীয় ধর্ম সূর্যপূজার প্রাধান্য স্বীকৃত ছিল, তার মূলে আঘাত করা এই আক্রমণের কারণ।

দেবতার অস্তিত্ব নেই এবং মানবতাই শ্ৰেষ্ঠ আদর্শ, এই মতবাদ প্রচার করবার ফলে প্রোটোগোরাসকে (৪৮০-৪১০ খ্রিষ্টাপূর্বাব্দ) এথেনস থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে যেতে হয়। সক্রেটিসকে (৪৬৯-৩৯৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তার পেছনে ধৰ্ম-সংক্রান্ত অভিযোগ থাকলেও রাজনৈতিক কারণই ছিল প্রধান। কারণ সক্রেটিস শাসকশ্রেণির সদস্যদের অজ্ঞানতা, মূর্খতা, অকর্মণ্যতা এবং ভ্রষ্টাচার যুব সমাজের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছিলেন এবং তার কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকেরা অনেকে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়ে অভিজাত শ্রেণির অন্যান্য সদস্যদের অসুবিধা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করার সময় বিচারকেরা তার বিরুদ্ধে যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করা ছাড়াও এই ধর্মীয় অভিযোগ এনেছিল যে, তিনি নাকি পুরাতন দেবদেবীদের পরিবর্তে নতুন দেবদেবীর প্রবর্তন করেছিলেন, এমনকি তিনি নাস্তিক ছিলেন। সক্রেটিস অবশ্য সব অভিযোগই অস্বীকার করেছিলেন এবং ধর্ম-সংক্রান্ত দুটি অভিযোগের পরস্পরবিরোধিতার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু বিচারকেরা তথাপি সব অভিযোগেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। বাং লাদেশেও এ ঘটনা এখনও দেখা যায়। কাউকে ঘায়েল করতে কিন্তু হত্যা করার জন্য ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। অথচ এই ধর্ অস্তিত্ব এখনও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত নয়। যেমন অন্য কোনো ধর্ম এখনও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত নয়।

অন্যদিকে নাস্তিকতা নয়, ধর্মীয় বিদ্বেষ বা অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণাই জংগীবাদ উগ্রবাদের উৎস। নাস্তিকতা বা নিরীশ্বরবাদে জঙ্গীবাদ বা উগ্রতার কোনো স্থান নেই। এটি যুক্তি, মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানচর্চা ও মানবিকতার পথ। একজন নাস্তিকের কাছে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি কোনো কারণেই একজন নাস্তিক কাউকে ছোট বা বড় করে দেখে না। একজন নাস্তিক নিজে ঈশ্বর বা স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন না, তবে অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সে অসম্মান করেন না। একমাত্র আমারই মত, পথ ও বিশ্বাসই সঠিক ও শ্রেষ্ঠ; অন্যদের বিশ্বাস, মত ও পথ ভুল বা মিথ্যা- এমন কথা একজন নাস্তিক কখনোই বলে না বা মনে করে না। সে নিজের বিশ্বাসকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে না।

কিন্তু ইসলাম ধর্ পরতে পরতে হিংসা বিদ্বেষ ছড়ানো। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় তথা ইসলাম নামধারী দলগুলো ক্রমেই ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর বিপরীতে ধীরে ধীরে যে দলটি দেশের ইসলামী তথা ধর্মীয় রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অনেক ধর্মভিত্তিক দল। আর সরকার ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করার জন্য তাদের কিছু বলছে না।

চার দশক ধরে চলমান ধর্মের নামে উগ্রবাদিতার প্রচারে আমাদের সমাজ অনেকখানি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দিকে হেলে পড়েছে। চলতি হাওয়ায় তাল মেলাতে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থশালী হওয়া লোকেরা পারলৌকিক অপরাধ লাঘবের আশায় জনগণের কাছ থেকে চুরি করা পয়সা হালাল করতে মাদ্রাসা বানিয়েছে। বিগত ১০-১২ বছরে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে। কমেছে মুক্ত চিন্তা।

দেশে যে সংখ্যক মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে, তাতে অন্যান্য ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীরও উদ্ভব হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কওমি মাদ্রাসাগুলোর নিয়ন্ত্রণ হেফাজতের কাছে; আলিয়া মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ জামায়াতের হাতে। বিগত চার দশকে যত মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে তার মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসার চেয়ে কওমি মাদ্রাসাই বেশি। এসব মাদ্রাসা চলে বিত্তবানদের দান এবং মুসলিমবিশ্বের অর্থায়নে। আর এখান থেকে পড়ালেখা করে ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ কায়েম করা হচ্ছে। এর জন্য হেফাজতে ইসলামসহ জামাতে ইসলামীর মত ধর্মীয় দলগুলো দায়ী। সরকারও ক্ষমতায় থাকার জন্য তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। এ কারণে নারী শিক্ষা ও নারীদের স্বাধীনতা, স্বাধীন চিক্তার প্রসার, বিজ্ঞান মনস্ককতা দিন দিন কমছে।

কিন্তু আমরা এখনো জানিনা ইসলাম ধর্ম নামে ধর্মটি আসল কিনা। ইসলাম ধর্ম ভয় দেখিয়ে বহু বিবাহসহ অন্য ধর্ম এর মানুষদের হত্যা করা হলেও আসলেই কি সৃষ্টিকর্া বা পরকার বলতে কিছু আছে? আমার মুক্তি চিন্তায় আমি নিশ্চিত আল্লা বা সৃষ্টিকর্া বলতে কিছু নেই। সবই মানুষের বানানো।

গত ৯ মে দৈনিক ইত্তেফাকে একটি নিউজ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিলো “আদরের নামে পায়ুপথে যন্ত্রনা দিতো মাদ্রাসা হুজুর। কিছুদিন আগে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক পরিসংখ্যান মোতাবেক দেখলাম গত ১৫ মাসে মাদ্রাসায় ধর্ষনের শিকার হয়েছে ৬২ শিশু যাদের মধ্যে তিনজন মারা গেছে। এদের অধিকাংশই হেফাজতে ইসলামের হুজুর।

একজন তথাকথিত ধার্মিক অন্যায় বা পাপ করে তার স্রষ্টার কাছে প্রায়শ্চিত্ত/তওবা, তীর্থগমন ইত্যাদির মাধ্যমে পাপ খণ্ডন বা মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারে। এবং এই সুযোগের কারণে অনেক তথাকথিত ধার্মিক বারবার অন্যায় করতে থাকে। কিন্তু একজন নাস্তিক কোনো কল্পিত সর্বশক্তিমানের কাছে নয়, তার নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। প্রায়শ্চিত্ত/তওবা করে তার পাপমুক্তি বা মানসিক প্রশান্তি লাভের সুযোগ নেই। তার অন্যায় কাজ তাকে আমৃত্যু অনুশোচনার আগুনে পোড়ায়। ফলে একজন নাস্তিকের জন্য অন্যায় কাজ করা খুব কঠিন।

নাস্তিকতা হচ্ছে মুক্তচিন্তা, জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চার পথ। মানবিক হওয়ার সাধনার পথ। খুব কঠিন একটা পথ। ফলে এ পথে খুব কম মানুষের চলাচল।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক