তিন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হলেন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি!


Faridpur | Published: 2021-08-10 23:44:19 BdST | Updated: 2024-05-06 13:56:05 BdST

ফরিদপুরের নগরকান্দায় তিন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি চয়ন কুমার মন্ডলকে সদ্যঘোষিত নগরকান্দা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চয়ন কুমার মন্ডলের নামে নগরকান্দা থানায় চুরি, অগ্নিসংযোগ, মারধর, নাশকতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন পাটোয়ারিকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে অন্তত ৩টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় সে চার্জশিটভুক্ত আসামি। মামলাগুলো অভিযোগপত্র ফরিদপুর ১ নং আমলি আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে একাধিক মামলা থাকা সত্ত্বেও চয়ন কুমার মন্ডলের নাম উপজেলা ছাত্রলীগের মত দায়িত্বশীল পদে আসায় এ নিয়েও উপজেলাব্যাপী চরম আলোচনা সমালোচনা চলছে। এ ঘটনায় নগরকান্দা উপজেলায় স্বচ্ছ ও সক্রিয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় বইছে।

ছাত্রলীগ সুত্রে জানা যায়, গত ৩১ জুলাই নগরকান্দা উপজেলা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি অনুমোদন দেন ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগ। ঘোষিত ওই কমিটি সভাপতি, সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক নিয়ে মোট ১২ সদস্যবিশিষ্ট। দলীয় প্যাডে স্বাক্ষর দিয়ে এ কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তামজিদুল রশিদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ফাহিম আহমেদ। ওই কমিটির সভাপতি হিসেবে রয়েছে চয়ন কুমার মন্ডলের নাম।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চয়ন কুমার মন্ডল ভাঙ্গা সরকারি কে এম কলেজের ভুগোল ও পরিবেশ বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। অভিযোগ রয়েছে, চয়ন স্থানীয় মাদক কারবারিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে এলাকায় মাদক কেনাবেচা ও সেবনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। এছাড়া ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী মনিরুজ্জামান সরদারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে এলাকায় ব্যাপক জনসংযোগ চালান তিনি। এমনকি প্রভাব খাটিয়ে উপজেলার তালমা এলাকায় স্থানীয় লোকদের মারধর, বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটের একাধিক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া তালমার মোড় এলাকায় আওয়ামীলীগের মিছিলে অগ্নিসংযোগ, লাঠিপেটা ও মটরসাইকেল ভাংচুর করে দীর্ঘদিন উপজেলাব্যাপী আলোচনায় ছিলেন চয়ন কুমার মন্ডল। চয়নের বিরুদ্ধে নৌকার বিভিন্ন মিটিং মিছিলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং নানাভাবে হয়রানি করার অভিযোগও রয়েছে।
তাই একাধিক মামলা থাকার পরেও রাতারাতি ছাত্রলীগ সভাপতি বনে যাওয়ায় এতে সংগঠনটির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, চয়ন দীর্ঘদিন ধরে মেহেদীর মদদে নাগরকান্দার তালমা এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও রমরমা মাদক ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছে।হত্যাচেষ্টা,বেআইনিভাবে সভা-সমাবেশ, জখম, চুরি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, গতিরোধ করে হুমকিসহ বিভিন্ন সময় বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচির নামে এলাকায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার দায়ে তার বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়। তাই অনতিবিলম্বে তাকে বিচারের আওতায় আনা ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জোরদাবী জানিয়েছে এলাকাবাসী। চয়ন কুমার মন্ডল নগরকান্দা উপজেলার মানিকদী গ্রামের নিরঞ্জন কুমার মন্ডলের ছেলে।

এদিকে চয়নের মামলার বাদী মজনু পাটোয়ারি বলেন, গরিবের বেলায় যত আইন। চয়ন আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন পাটোয়ারিকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছে। আমি কি এর বিচার পাব না? ফিরোজ খানের নেতৃত্বে চয়ন মেহেদীরা আমার বাবা ভাই ও আমাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। শুনেছি তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট তাখিল হয়েছে এখন বিচারের অপেক্ষায় আছি। আমি এর সঠিক বিচার চাই। তারা আমার বাড়িতে এসে আবারো আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন। মামলা তুলে নেয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। তাই দ্রুত এদের বিচারের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির দাবি করছি।

চয়ন কুমার মন্ডলের নামে নগরকান্দা থানায় হওয়া তিন মামলা-

বাদি ছামাদ মাতুব্বর নগরকান্দা থানা মামলা নং ৯, তারিখ ১০-০৮-২০২০। বাদি মজনু পাটোয়ারী নগরকান্দা থানা মামলা নং ১৭, তারিখ ২০-০৯-২০২০। বাদি তারেক মল্লিক নগরকান্দা থানা মামলা নং ১৭, তারিখ ১৮-১০-২০২০।

চয়নের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার এজহার পর্যালোচনা দেখা গেছে, ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর তালমা বাজারে ভ্যান ষ্টান্ডের কাছে এস এস ইলেকট্রনিক্সের দোকানের সামনে উপজেলার মানিকদির বাসিন্দা তারেক মল্লিক(৩০) পথরোধ করে পূর্বপরিকল্পিতভাবে মারধর ও কুপিয়ে জখম করে তার কাছ থেকে নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যান চয়ন কুমার মন্ডল। ওই ঘটনায় পরদিন তারেক মল্লিক বাদি হয়ে নগরকান্দা থানায় চয়ন কুমার মন্ডলসহ আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে চুরি ও হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১৭/২০। এছাড়াও অভিযুক্ত চয়ন ২০২০ সালে রাজনৈতিক মতবিরোধ নিয়ে উপজেলার তালমার মোড় রাজ্জাকের চায়ের দোকানের সামনে স্থানীয় আওয়ামীলীগের পার্টি অফিসে হামলা চালিয়ে নগরকান্দার ঝাউডাঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন পাটোয়ারি ও তার ছেলে মজনু পাটোয়ারীকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে উপর্যপুরি কুপিয়ে গুরতর আহত করে পালিয়ে যায়। ওই ঘটনায় মজনু পাটোয়ারী বাদি হয়ে চয়নকে আসামি করে নগরকান্দা থানায় একটা হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। মামলা নং ১৭/২০। এবং ২০২০ সালের ৮ আগষ্ট রাজনৈতিক মতবিরোধকে কেন্দ্র করে নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির উপদেষ্টা ফিরোজ খানের নেতৃত্বে চয়ন কুমার মন্ডলসহ আরো বেশ কয়েকজন যুবক দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে উপজেলার পিপরুল গ্রামের ছামাদ মাতুব্বর (৬০) এর বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে মারধর বাড়িঘর ভাংচুরসহ মালামাল লুটপাট করে পালিয়ে যায়। পরে এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ছামাদ মাতুব্বর বাদী হয়ে নগরকান্দা থানায় চয়ন কুমার মন্ডলসহ আর ৮-১০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ০৯/২০।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে অভিযুক্ত চয়ন কুমার মন্ডলের মুঠোফোন কল করা হলে তিনি বলেন, আমার নামে কোন মামলা নেই। মামলার বিষয়টি আমি এই প্রথম শুনলাম। তিনি আরো বলেন, আসলে ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পরে কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে মামলা আছে বলে নানা প্রকার গুজব ছড়াচ্ছে। এই মামলার বিষয়টি ভিত্তিহীন ও অসত্য।

এদিকে চয়ন মমন্ডলের বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে মামলার অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মজনু পাটোয়ারির মামলায় ৩,৪,৫,৭,৮,৯,১৩,১৪ ও ১৫ নং আসামি চয়ন কুমার মন্ডল গত ২৪-০৯-২০ তারিখে ফরিদপুর ১ নং আমলি আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছেন। একইভাবে তিনি তারেক মল্লিকের করা আরেক মামলায়ও জামিনে আছেন।

এ ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে নগরকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিম রেজা বিপ্লবকে ফোন দেয়া হলে তিনি মামলার কপি দেখে মন্তব্য করবেন বলে জানালে পরে কপিগুলো তার হোয়াট অ্যাপে পাঠানো হলে সিন করেও কোন জবাব দেননি। পরে তার মন্তব্য জানতে চেয়ে একাধিকবার তার মুঠোফোনে কল করা হলেও কোন সাড়া মেলেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সিনিয়র এএসপি (নগরকান্দা-সালথা) সার্কেল মো.সমিনুর রহমান বলেন, মামলা থাকলেইতো চার্জশিট হয়। মামলা না থাকলে কারো বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া সম্ভব নয়। আর বর্তমানে কারো বিরুদ্ধে চার্জশিট হলে তার নামে মামলা নাই এটা বলার সুযোগ নেই । কারন ডিজিটাল যুগে সবই অনলাইনে পাওয়া যায়। এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। তারপরেও যদি অভিযুক্ত তার নামে কোন মামলা নেই প্রচার বা অস্বীকার করে তবে সেটা চতুরতা ও বোকামি।

৩২৬ ধারায় মামলার শাস্তির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে অপর ব্যক্তিকে মারাত্মক অস্ত্র দিয়ে গুরতর আহত করে তবে হামলকারির বিরুদ্ধে ৩২৬ ধারায় অভিযোগ আনা যাবে। আর এ মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।এবং অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। ৩২৬ এর অভিযোগ দন্ডবিধিতে অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ হিসেবে বিবেচিত। এরূপ ধারায় মামলা চলমান অবস্থায় কোন অভিযুক্ত সরকারি, বেসরকারি চাকুরি কিংবা অন্যান্য সুযোগ লাভে যোগ্য বলে বিবেচিত হন না। মামলা চলমান অবস্থায় চাকুরি হতে সাময়িক বরখাস্তের বিধানও রয়েছে। তবে, মামলা নিষ্পত্তি হয়ে অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেলে চাকুরি কিংবা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পেতে বাধা থাকে না।

চয়ন কুমার মন্ডলের মামলার বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি কি এ বিষয়ে জানতে চাওয়অ হলে ফরিদপুর জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) দুলাল চন্দ্র সরকার বলেন, আসলে মামলা যখন চার্জশিট হবে তারপর সেটা ফড হয়ে সেশন কোর্টে আসে। কিন্ত আপনি যেনে থাকবেন করোনাভাইরাসের কারনে আদালতের স্বাভাবিক বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। এখন শুধুমাত্র জরুরী জামিনের মেটার ছাড়া কোন মামলারই বিচার কার্যক্রম চলে না। তাই আপাতত কোন মামলা রেফার হয়ে জজ কোর্টে আসতেছে না। সুতরাং উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কোন মামলার তথ্য দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। যদি আদালত খোলা থাকতো তাহলে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সরবরাহ করতে পারতাম। আশা করি স্বাভাবিক আদালত খুলতে এই মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি কি সে বিষয়ে তথ্য দিতে পারবো। তবে এ মামলা বিষয়ে উক্ত থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা তথ্য দিতে পারবেন। তিনি বলতে পারবেন মামলাটি চার্জশিট হওয়ার পর আদালতে পাঠানো হয়েছে কিনা বা কোন কোর্টে পাঠানো হয়েছে