বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে গল্প সাহস যোগায়


Dhaka | Published: 2020-02-11 19:04:24 BdST | Updated: 2024-05-19 08:45:48 BdST


ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরুর সাতদিনের মাথায় সবাই বেশ বন্ধু হয়ে গেলো শুধু সাকিব কারো সাথে মিশতে পারলো না। সাতদিন পর দেখা গেলো ৭-৮ জন মিলে একেকটা ফ্রেন্ড গ্রুপ তৈরী হয়েছে, গ্রুপের সবাই একসাথে ক্লাস করছে, ঘুরছে, খাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে। শুধু সাকিব সকালে ক্লাসে আসে, দুপুরে ক্লাস শেষে বাসায় চলে যায়।

সাকিবের এই আলাদা হয়ে যাওয়ার দুইটা কারণ আছে। বাসা থেকে কড়া করে বলে দেওয়া হয়েছে, "কারো সাথে মিশবি না। ক্লাস করবি, সোজা বাসায় চলে আসবি। ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা পলিটিক্স করে, এদের বিশ্বাস নাই। এক বন্ধু আরেক বন্ধুর গলা কাটে। দরকার নাই এসবের। কোনমতে অনার্স পাশ করে বের হয়ে আয়।" দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে ছোটবেলা থেকেই সাকিব পড়াশোনা করেছে দেশের বাইরে, লন্ডনে। বাংলাদেশে এসে কিছুদিন একটা কলেজে পড়েছে। ক্লাস করা লাগে নি। শুধু পরীক্ষা দিয়েছে। তারপর এখন এই পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। এদেশের মানুষের সাথে মিশে সাকিব এখনো অভ্যস্ত হতে পারে নি। লন্ডনের সাথে এদেশের লাইফস্টাইলে অনেক তফাৎ। তাছাড়া হুট করে কারো সাথে পরিচিত হয়ে মিশে যাওয়া সাকিবের ধাতে নেই। একা একা বড় হওয়ার কারণে কারো সাথে মিশতে সময় লাগে।

ক্লাসের দুই একজন যে মিশতে চেষ্টা করেনি সেটা ঠিক না। কয়েকজন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে চেয়েছে। সাকিব ভ্যাবাচেকা খেয়ে কি বলবে বুঝে উঠতে পারে নি। যার ফলে ক্লাসে রটে গেলো সাকিবের ভাব বেশী। বড়লোকের পোলা, গাড়িতে আসা যাওয়া করে, পা মাটিতে লাগায় না, ভাব ধরে থাকে। এরপর থেকে আর কেউ তেমন মেশার চেষ্টা করে নি। সবাই একসাথে বসে যখন আড্ডা দেয় তখন সাকিবের খুব আফসোস লাগে। আগ বাড়িয়ে কথা বলার জড়তাটা কাটিয়ে উঠতে পারে নি এখনো।

তবে পরিস্থিতি বদলাতে সময় লাগলো না। সপ্তাহ দুয়েক পর একদিন দুই ক্লাসের মাঝে গ্যাপে সবাই হই-হল্লা করছে। সাকিব ক্লাস লেকচার গুছাচ্ছে। এমন সময় একটা ছেলে এসে বললো,
-- এই তোর কাছে একশো টাকা হবে? একশো টাকা দে।
সাকিব পকেটে হাত দিয়ে বললো,
-- টাকা তো নাই।
ছেলেটা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
-- তোর কাছে টাকা নেই? চাপা মারিস কেন? তোর গাড়ির চাক্কার বালুর দামও একশো টাকার বেশী। কিপটামি করোস কেন?
-- কিপটামি না। আমার কার্ডে টাকা আছে, নগদ টাকা নেই। ক্যাশ আউট করতে হবে।
-- এখন কে যাবে ক্যাশ আউট করতে? ধুর!
-- কেন? টাকা কেনো দরকার?
-- শুভর জন্মদিন। সবার থেকে চাঁদা তুলতেছি। সারপ্রাইজ দিবো। আচ্ছা তোর টাকাটা আমি দিয়ে দিলাম। কালকে মনে করে আমাকে দিয়ে দিবি। আমাকে চিনবি তো?
-- হুম। তোমার নাম ইমরান।
-- বাহ! কিভাবে জানিস?
-- আমি এই ক্লাসের সবার নাম জানি।
-- কিভাবে? অরিয়েন্টেশন ক্লাসে মুখস্ত করেছিস?
-- হ্যাঁ।
-- তুই তো দেখি পুরা মোগল। ছুটির পর থাকিস।
মোগল মানে কি সাকিব জানে না। হবে হয়তো কোন গালি বা অবজ্ঞাসূচক শব্দ। কিন্তু সাকিবের খারাপ লাগলো না। ইমরানের কথার মধ্যে একটা আন্তরিকতা আছে, গালি দিলেও খারাপ লাগে না।

ছুটির পর সাকিব আসলাম ভাইকে মেসেজ পাঠালো গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতে। আজকে একটু দেরী হতে পারে। ইমরান এসে সাকিবকে নিয়ে গেলো মাঠে। ক্লাসের প্রায় সবাই আছে। শুভর চোখ বাঁধা।
প্রচুর মজা হলো। শুভর চোখ খোলার পর শুরু হলো স্প্রে আর বেলুন ফুটানো। কেক কাটার সময় কেক মাখামাখি হলো। সাকিব একটু দূরে সটকে পড়তে চেয়েছিলো কিন্তু ইমরান সেই সুযোগ দিলো না। ক্রিমে মুখ মাখামাখি অবস্থায় সাকিব বলে উঠলো,
-- এখন আমি বাসায় যাবো কিভাবে?
সবাই হেসে উঠলো। শুভ হাসতে হাসতে বললো,
-- তোর তো গাড়ি আছে, চিন্তা নাই। আমার কি হবে দেখ।
-- এক কাজ করি। মুখ ধোয়ার দরকার নেই। আজকে এভাবেই বাসায় যাবো। রিকশায় করে সবাইকে দেখাতে দেখাতে যাবো। সাকিব তুই তোর গাড়ি পাঠিয়ে দে।
-- আমি রিকশায় চড়তে পারি না। ভয় লাগে। সাকিব বিব্রত হয়ে বললো।
সবাই এমনভাবে তাকালো যেনো ভূত দেখছে। সাকিব দ্রুত বললো,
-- আসলে আমি কোনদিন রিকশায় চড়ি নাই। আমি বাংলাদেশে এসেছি কয়েক বছর আগে। নরমালি যেখানে যাই, গাড়িতে যাই।
-- বাংলাদেশে এসেছিস কয়েক বছর আগে? এর আগে কই ছিলি?
-- লন্ডনে।
-- ও, তাহলে তো তোর রিকশায় চড়া ফরজ। রিকশার মতো একটা চমৎকার জিনিস ভয় লাগবে এটা কেমন কথা? আজকে আমাদের সাথে রিকশায় যাবি, কোন আপত্তি করবি না।

রিকশায় সাকিব উঠলো ভয়ে ভয়ে। শুভ আর ইমরান উঠেছে ওর সাথে। ভাঙা রিকশা রাস্তায় যখন দুলে, মনে হয় এই যেনো পড়ে গেলাম। সাকিবের শক্ত করে রিকশাকে আঁকড়ে ধরা দেখে ইমরান আর শুভ হাসতে হাসতে বিষম খেলো।

সেদিন থেকে মোটামুটি সবার সাথে সাকিবের বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। ফার্স্ট বেঞ্চে বসা সাকিব নিয়মিত লাস্ট বেঞ্চে শুভ, ইমরান, সায়মনের সাথে বসতে শুরু করলো। আরো অনেক কিছুই বদলালো। রিকশায় চড়াটা এখন আর ভয় লাগে না বরং ভালো লাগে। সবার সাথে সাকিব বেশ দ্রতই মানিয়ে নিলো। তুই করে বলতে প্রথমে প্রচুর অস্বস্তি লাগলেও এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ক্লাস শেষে সোজা বাসায় না গিয়ে সাকিব এখন বিকাল পর্যন্ত আড্ডা দেয়। মাঝে মাঝে সাকিবকে দেখা যায় ট্যাপে মুখ লাগিয়ে পানি খেতে অথচ এতোদিন এটা কল্পনাও করা যেতো না।


সকাল ৮টায় ক্লাস। ইমরান বেশ দ্রুত হাঁটছে। আর ১৫ মিনিটের মতো আছে। ভার্সিটির গেটের কাছাকাছি পৌঁছে দেখলো সাকিব গাড়ি থেকে নামছে। ইমরান পিছন থেকে বললো,
-- কিরে? এখানে নেমে গেলি কেন?
সাকিব থতমত খেয়ে গেলো। আমতাআমতা করে বললো,
-- না এমনি। অল্প একটু তো। হেঁটেই যাই।
-- অল্প একটু কই? মিনিমাম দশ মিনিটের রাস্তা। ঘটনা কি? কারো সাথে দেখা করবি নাকি?
বলে ইমরান চোখ টিপলো। সাকিব বিব্রতভাবে বললো,
-- গাড়িতে যাওয়া-আসা আমার ভালো লাগে না। আমার বাবার জন্য গাড়ি ছাড়তে পারছি না।
-- আজব তো! গাড়ি ছাড়বি কেন?
-- এই যে তোরা রিকশায় বা হেঁটে আসিস, আমি এভাবে অভ্যস্ত হতে চাই। দামি গাড়ি থেকে নামলে সবাই অদ্ভুত ভাবে তাকায়, আমার ভালো লাগে না।
-- তাতে তোর কি? তোর গাড়ি, তুই চড়বি।
-- তুই বুঝবি না। আমি তোদের মতো হতে চাই।
-- তোর মাথায় গণ্ডগোল আছে। আমাদের মতো হওয়ার কি আছে? সুখে থাকতে ভুতে কিলায়?
সাকিব জবাব না দিয়ে হাঁটতে থাকলো। ইমরান মনে মনে হাসলো। সাকিবের মাথায় আসলেই সামান্য সমস্যা আছে।


বিশিষ্ট গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন তার গাড়িতে চিন্তিত মুখে বসে আছেন। এই মাত্র তার স্ত্রী শাহানা ফোন করেছে, সাকিব এখনো বাসায় ফেরেনি। মোবাইলেও কল যাচ্ছে না। আনোয়ার হোসেনও কয়েকবার ট্রাই করেছেন, ফোন বন্ধ। সাকিব আজকাল গাড়ি নিয়েও বের হয় না, রিকশায় যাওয়াআসা করে। গাড়ি থাকলে ড্রাইভার থেকে খবর নেওয়া যেতো।

আনোয়ার হোসেনের বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এদেশে কোন কিছুর নিশ্চয়তা আছে? কখন কোথায় কার কি হয় তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। সেজন্য সাকিবকে ছোটবেলা থেকে লন্ডনে বড় করেছেন। ইচ্ছা ছিল ইউসিএল কিংবা চেমসফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াবেন। কিন্তু হাইস্কুল পাশ করার পর সাকিব বাংলাদেশে আসার জন্য জোরাজুরি শুরু করে দিলো। আনোয়ার হোসেনেরও দেশের বাইরে মন টিকছিলো না। তাছাড়া দেশের বাইরে থেকে যাওয়াআসা করে ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো। তাই বাধ্য হয়ে তল্পিতল্পা নিয়ে দেশে চলে আসলেন।

সাকিব জোর করে পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। আনোয়ার হোসেনের কোন ইচ্ছা ছিল না। এখানে পলিটিক্স, র‍্যাগ, মারামারি চলতেই থাকে। ইদানীং সাকিব প্রায়ই দেরী করে বাসায় ফিরে। কাদের সাথে মিশছে কে জানে! আবার পলিটিক্সে জড়িয়ে যায় কিনা সেটা কে বলবে? নাকি কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছে?

আনোয়ার হোসেন ঘরে এসে দেখলেন সাকিব বাসায় হাতমুখ ধুচ্ছে। তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন,
-- তোর মোবাইল বন্ধ কেনো?
-- চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিলো।
-- কই গিয়েছিলি?
সাকিব ইতস্তত করে বলে,
-- টিউশনিতে।
-- টিউশনি? আনোয়ার হোসেন আকাশ থেকে পড়লেন। তুই কেনো টিউশনি করবি? আমাদের কি টাকাপয়সার অভাব?
-- তোমার টাকা পয়সার অভাব না থাকতে পারে কিন্তু আমার অভাব আছে।
-- কেন? আমি তোকে হাত খরচ দেই না?
-- আমি তোমার থেকে হাতখরচ নিবো না বলেই টিউশনি করছি।
আনোয়ার হোসেন থমকে গিয়ে বললেন,
-- আমি তোকে আগেই ক্লিয়ার করেছি আমার একশো ভাগ হালাল ইনকাম।
-- সেজন্য না। আমি স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছি।
-- তাই বলে টিউশনি করবি কেন? অফিসে এসে বস? আমার ব্যবসায় সময় দে?
-- টিউশনি খারাপ ভাবছো কেনো? তুমি নিজেই তো গর্ব করে বলো টিউশনি করে বড় হয়েছো।
-- আমার ছেলে অন্যের বাসায় টিউশনি করবে? কেউ শুনলে কি বলবে?
-- তুমি তোমার প্রেস্টিজ নিয়েই থাকো। আমি খারাপ কিছু করছি না।
আনোয়ার হোসেন বেশ অনেকক্ষণ চিন্তা করে বললেন
-- ঠিক আছে। তোর ইচ্ছামতো চল। কিন্তু কখনোই যেনো মোবাইল অফ না পাই। প্রয়োজনে ব্যাগে একটা এক্সট্রা মোবাইল রাখবি।
-- ওকে।

আনোয়ার হোসেন মেনে নিলেও মনে মনে বেশ চিন্তিত হলেন। ইদানীং সাকিবের পরিবর্তনটা তাকে খুব ভাবাচ্ছে। কাদের সাথে মিশছে কে জানে? খোঁজখবর নেওয়া দরকার। পরদিনই আনোয়ার সাহেব তার অফিসের ম্যানেজার আব্দুল রশিদকে পাঠালেন ইউনিভার্সিটিতে। সাকিবের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে হবে, কাদের সাথে মিশে, কি করে জানতে হবে। আব্দুল রশিদ কোন খোঁজখবর নেওয়ার আগেই আনোয়ার হোসেন তার বন্ধু মোজাম্মেল আহমেদের ফোন পেলেন।
-- তোর ছেলেকে দেখলাম ক্যাম্পাসের ফুটপাথে বসে আছে বন্ধুদের নিয়ে?
-- কি? আরে নাহ। ভুল দেখেছিস। সাকিব সারাজীবন ফিটফাট হয়ে চলতে পছন্দ করে। ও ফুটপাথে বসবে এটা সম্ভব না।
-- ভুল দেখার সুযোগ নেই। আমি গাড়ি থামিয়ে ডাক দিয়েছি, আমার সাথে এসে কথাও বলেছে।
আনোয়ার হোসেন কানে মোবাইল চেপে অবাক হয়ে সামনের দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

তিনদিন পর আব্দুল রশিদের দেওয়া রিপোর্ট পড়ে আনোয়ার হোসেন আরো কনফিউজড হয়ে গেলেন। সাকিব যথারীতি ক্লাস করে, দুপুরে ক্লাস থেকে বের হয়ে ক্যাফেটেরিয়াতে ভাত খায়। বিকাল পর্যন্ত আড্ডা দেয় (একদিন আড্ডা বাদ দিয়ে মেডিকেলে গিয়েছিলো, কি জন্য সেটা জানা যায় নি)। বিকালের শেষে রিক্সায় টিউশনিতে যায়, টিউশনি থেকে বাসায় আসে গাড়িতে। যাদের সাথে আড্ডা দেয় তাদের দুইজন পলিটিক্স করে না তবে ভার্সিটির বিভিন্ন ক্লাবের সাথে যুক্ত। আর একজন পলিটিক্স করে, হলের পোস্টেড নেতা।

আনোয়ার সাহেব সেদিন রাতে আলাপের ভঙ্গিতে বললেন,
-- মোজাম্মেলের সাথে নাকি তোর দেখা হয়েছে?
-- হ্যাঁ, আঙ্কেল গাড়িতে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে ডাক দিয়েছে।
-- তুই নাকি ফুটপাথে বসে ছিলি?
-- হ্যাঁ। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম।
-- ফুটপাথ নোংরা না? প্রতিদিন কত মানুষ হেঁটে যায়। জুতার ময়লা থাকে।
-- ঝেড়ে বসি তো। বলে সাকিব হাসতে হাসতে বললো, প্রতিদিন কত মানুষ বসে। এগুলি ক্যাম্পাসে ব্যাপার না। সবাই তো দুইটা ফুঁ দিয়ে বসে পড়ে। আমি পারি না, আমি পত্রিকা বিছিয়ে বসি।
-- পত্রিকা পাস কই?
-- পত্রিকা নিয়ে যাই ব্যাগে করে।
-- পত্রিকা নিয়ে যাস? ফুটপাথে বসার জন্য?
-- হ্যাঁ। সবাই হাসাহাসি করে। স্পেশালি ইমরান সুযোগ পেলেই পঁচায়। আমি আস্তে আস্তে অভ্যাস করছি।
-- এখন নাকি বাসা থেকে খাবার নিয়ে যাস না? দুপুরে খাস কই?
-- ক্যাফেটেরিয়াতে।
-- বাইরের খাবার খাস? এই অভ্যাস কবে করলি? আগে তো খেতে পারতি না।
-- তুমি বুঝবা না। ব্যাগে করে খাবার নিয়ে আসা এখানে খুবই অড।
-- হুম। যাদের সাথে মিশিস এরা কেমন? পলিটিক্স করে?
-- উফ! তুমি এতো টেনশন কেনো করো? আমি তো আগেই বলেছি পলিটিক্সে জড়াবো না। ওরা কেউ পলিটিক্স করে না। টেনশনের কিছু নেই।
-- বাইরের খাবার খাওয়া বন্ধ কর। এভাবে বাইরে খাওয়া ঠিক না। কোনদিন কোন রোগ বাঁধাবি তার ঠিক আছে? আর টিউশনি না করলে কি হয় না?
-- তুমি যখন তোমার লাইফের গল্প করো তখন তো খুব বড় করে বলো টিউশনি করে পড়ালেখা চালিয়েছো, মেসের খাবার খেয়ে এই পর্যায়ে আসছো। আমার বেলায় কি সমস্যা?
আনোয়ার হোসেন বলার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না।

কিছুদিন পর আনোয়ার হোসেন ট্রাফিক সিগনালে গাড়িতে বসে যখন দেখলেন সাকিবসহ আরো দুইজন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এক ছাত্রের চিকিৎসার জন্য টাকা তুলছে, খুব একটা অবাক হলেন না। তবে রাতে বাসায় এসে সাকিবকে বেশ কড়া ধমক দিলেন,
-- রাস্তায় দাঁড়িয়ে টাকা তুলছিস, আমাকে বললে কি সমস্যা? তুই একাই মহামানব? একাই মানুষের সেবা করবি? একা সওয়াব কামিয়ে বেহেশতে যাবি? আমাকে বললে আমি চিকিৎসার টাকা জোগাড় করে দিতে পারি না?
-- এরপর থেকে বলবো।
সাকিব আমতা আমতা করে বললো।


যদিও সাকিব কথা দিয়েছিলো পলিটিক্সে জড়াবে না, কিন্তু বছরখানেক পরেই সাকিবকে দেখা গেলো একটা মিছিলের সামনের সারিতে। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে স্লোগান দিচ্ছে,
"সন্ত্রাসীদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও"।
"আমার ভাই মরলো কেনো, জবাই চাই দিতে হবে।"

সেদিন সাকিব বাসায় ফিরলো মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ নিয়ে। আনোয়ার হোসেন দেখে কিছু বললেন না। শাহানা খুব কান্নাকাটি করতে লাগলো। বারবার বলতে লাগলো,
-- আমি আর এই দেশে থাকবো না। আমি লন্ডন চলে যাবো।
-- দেখো, এই পরিস্থিতিতে কিছু করার নেই। তোমার ছেলেকে কোনভাবেই তুমি এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবা না।
-- আমি এতো কিছু বুঝি না। আমার ছেলের যেনো কিছু না হয়।
-- হুম।

আনোয়ার হোসেন চিন্তায় পড়ে গেলেন। সাকিব খুব ঠান্ডা মাথার ছেলে। কোন একটা কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরানো যায় না। একমাত্র উপায় হচ্ছে লজিক দিয়ে আর্গুমেন্টে হারিয়ে দেওয়া। সেটাও সম্ভব না। তিনি জানেন এই আর্গুমেন্টে তিনি জিতবেন না।

সারারাত আনোয়ার হোসেন ঘুমাতে পারলেন না। কি করবেন সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না। সাকিবকে বাঁধা দেওয়া যায়, জোর করে লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হবে। সাকিব কোনদিন তাকে ক্ষমা করবে না। ইমরানের মৃত্যুর পর ছেলেটা অন্যরকম হয়ে গেছে। চোখের দিকে তাকাতেও ভয় লাগে। আনোয়ার হোসেন চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলেন। জেনেশুনে কিভাবে ছেলেকে বিপদের দিকে ঠেলে দিবেন? শাহানার কান্না থামাবেন কি করে?

সকালে উঠে আনোয়ার হোসেন পত্রিকা হাতে নিলেন। একটা লাল রঙের হেডিং, "ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র খুন"। সাথে আরো কিছু নিউজ, "সহপাঠীর মৃত্যুতে উত্তাল ক্যাম্পাস"।
"প্রতিবাদকারীদের উপর রাতের অন্ধকারে হামলা"।
আনোয়ার হোসেন দেখলেন সাকিব বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি আরেকবার চেষ্টা করেও সাকিবকে না করার সাহস পেলেন না। শাহানা কান্নাকাটি করলেও কিছু করার নেই। সাকিবকে তিনি থামাতে পারবেন না।

আনোয়ার হোসেন থানায় ফোন দিলেন। পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা তার বন্ধু। কেউ ভালো কোন আশ্বাস দিতে পারলো না। পরিস্থিতি পুলিশের হাতে নেই। যা অর্ডার আসে তাই পালন করতে হবে।


সেদিন সাকিবকে আবার দেখা গেলো মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীদের মাঝে। গতকালের চেয়ে বহুগুন বেশী ছাত্রছাত্রী আজকে। সবার হাত মুষ্টিবদ্ধ, স্লোগানে প্রকম্পিত ক্যাম্পাস। "আমার ক্যাম্পাস, আমার ঠিকানা। কোন সন্ত্রাসী গুনি না।"

দিনভর স্লোগান চললো। সবার মনে শংকা, কি হয়! সাকিব অতো চিন্তা করে না, যা হবার হবে। কোন এক অদ্ভুত কারণে সাকিবের মনে কোন ভয় লাগছে না। ইমরান বেঁচে থাকলে কি করতো? একেবারে সবার সামনে চলে যেতো। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। সাকিবও সবার সামনে চলে এলো।

বিকালের দিকে পরিস্থিতি আরো টান টান হয়ে গেলো। সবার মাঝে উৎকণ্ঠা। যেকোনো সময় যেকোনো কিছুই হতে পারে। হঠাৎ সাকিব কাঁধে হাতের স্পর্শ পেলো। বাবা।
সাকিব ভয়ে ভয়ে বললো,
-- আমি পলিটিক্সে যোগ দেই নি বাবা। দেখো এখানে যারা আছে এদের কেউই পলিটিক্স করে না। এটা পলিটিক্সের ব্যাপার না, এটা অস্তিত্বের ব্যাপার।
-- জানি। আমার সাথে থাক। পরিস্থিতি ভালো না। দৌড় দিলে কে কোনদিকে যায় খুঁজে পাওয়া যায় না। হাত ধরে থাক আমার। তুই আমার পিছনে যা, আমি তোর সামনে থাকি।
সাকিব অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। আনোয়ার হোসেনের মনে তখন কি চলছে বোঝা যাচ্ছে না।


হামলার শুরুতেই সবাই দৌঁড়ানো শুরু করলো। শুধু সামনের সারিতে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেলো। বাবা আর ছেলে একজন আরেকজনকে পিছনে ঠেলে নিজে সামনে এগিয়ে থাকার চেষ্টা করছে। অদ্ভুত সেই দৃশ্য দেখে লাঠি উঁচিয়ে আসা দুইজন হামলাকারীও কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গিয়েছিলো।

আনোয়ার হোসেনের জ্ঞান হারানোর আগে দেখলেন তার পাশেই সাকিব পড়ে গেছে। তিনি সাকিবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন শেষ লাঠির আঘাতটা নিজের শরীরে নেওয়ার জন্য। চারপাশে অসংখ্য পদশব্দ, প্রাথমিক ভয় কাটিয়ে অসংখ্য ছেলেমেয়ে ছুটে আসছে। হামলাকারীরা পিছু হঠছে। আনোয়ার সাহেব নিজের শরীর দিয়ে সাকিবকে আগলে রেখে জ্ঞান হারালেন।

রাফ খাতা