আমার শ্যামল। আমার মিনার। আমার এমন কিছু সন্তান অাছে যাদের সাফল্যের অার লড়াইয়ের গল্পগুলো অামার মানুষকে জানাতে ভীষণ অানন্দ লাগে। ওদের সাফল্যে যখুনি কোন নতুন পালক যুক্ত হয় অামার এতো অানন্দ হয়। অাজ অামি অাবার শ্যামলের গল্পটা বলবো। অামি জানি এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী মানুষটাও এ গল্প শুনে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাবেন। যে ছেলেটি লেখাপড়ার অর্থ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন, বেকার যে ছেলেটি একটা চাকুরির জন্য হা হুতাশ করছেন তাদের সবার জন্য এ গল্প হতে পারে নতুন শক্তি। এ গল্প হতে পারে নতুন শক্তি।
এর অাগেও অামি তিনবার শ্যামলকে নিয়ে লিখেছি। দুবারই নাম পরিচয় গোপন করে। ২০১৪ সালের ১০ মে শ্যামল প্রথম আলোয় যোগ দেওয়ার পর তাকে নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। অবশ্য সেদিন তার নাম পরিচয় প্রকাশ করিনি। অসংখ্য মানুষের অনুরোধেও করিনি। এরপর ও যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দিলো সেদিন ওর নাম প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। আজও দেব। কারণ, অামার শ্যামল পদোন্নতি পেয়ে অাজ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক। কিন্তু এই সাফল্যের অাগের পথচলাটা কেমন ছিল?
চলুন ফিরি দশ বছর অাগে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের শেষ বা তার কয়েকদিন অাগে পরের কথা। কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো অফিসে আমি। রাত অাটটা হবে। কাজ করতে করতে গ্রাফিক্স রুমে গেছি। বিশাল বাংলা পাতার মেকআপ করছে সহকর্মী বাকি বিল্লাহ। সেখানে একটা সাহায্যের আবেদনে চোখ আটকে গেলো। নিউজে বলা হয়েছে, ২০০৮–০৯ শিক্ষাবর্ষে একটি ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। কিন্তু ভর্তির টাকা নেই। তাকে সাহায্য করতে হবে। প্রথম আলোর যশোরের অভয়নগর প্রতিনিধি মাসুদ আলম ভাই নিউজটা পাঠিয়েছে। আমি বাকি ভাইকে বললাম নিউজটা পত্রিকায় ছাপার দরকার নেই। ফেলে দেন।
বাকি ভাই হতাশকণ্ঠে অামার দিকে তাকিয়ে বললো কেন? আমি বললাম একটা ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ১০-১৫ হাজার টাকা লাগে। এজন্য নিউজ করার দরকার নাই। আপনি ফেলেন। অামি চাই না ছেলেটার নাম পরিচয় কেউ জানুক। এমনিতেই ওর ভর্তি সমস্যার সমাধান হবে। আমি দেখছি। অার অামি যে রিপোর্ট পাঠিয়েছে সেই মাসুদ আলম ভাইকে ফোন দিচ্ছি। মাসুদ ভাই অামাকে নিয়ে গেলেন অারও বিশ বছর অাগের ইতিহাসে।
অামি অাজও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পত্রিকায় সাহায্য চাওয়ার বিপক্ষে। অামি মনে করি, মানসিকভাব একটা ছেলে বা মেয়ে এতে পিছিয়ে পড়ে। মাসুদ ভাইকে ফোনে বললাম এই নিউজ করার মানে কি? নিজেরা টাকা দিয়ে একটা ছেলেকে ভর্তি করতে পারেন না? মাসুদ ভাই অামাকে নিয়ে গেল অারেক করুণ ইতিহাসে।
ছেলেটির বাড়ি যশোরে। শিশুকালেই বাবাকে হারিয়েছে। মাও অসুস্থ হয়ে পরে মারা গেছে। যশোরের একটি খিষ্ট্রান মিশনারিতে বড় হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ভয়ঙ্কর আগ্রহ ছেলেটার। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেলো। এরপর এইটে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোই বাস্তবে কোথাও এতোটুকু আলো দেখলেই সেখানে বই নিয়ে বসে পড়ে। নিজের বই নেই বলে এর ওর কাছ থেকে ধার করে পুরানো বই পড়ে। ছেলেটির মেধা দেখে স্থানীয় এক হিন্দু শিক্ষক শ্যামল কান্তি বিশ্বাস নাম রেখে ছেলেটির স্কুলে নিবন্ধন করায়। একটি বাড়িতে পালক থাকার ব্যাবস্থা করে দেয়।
নতুন গল্পের শুরু। এসএসসিতে ছেলেটি অসাধারন রেজাল্ট করলো। এরপর উচ্চমাধ্যমিকেও। ছেলেটির তখন ইচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়বে। তার সব বন্ধুরা এখানে ওখানে কোচিং করে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু ছেলেটি পারছে না। একে তো টাকা নেই। অার ওই পালক বাবা মা চান শ্যামল যশোরেই থাকবে এবং তার ছেলেমেয়েকে পড়াবে। কিন্তু শ্যামল যে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
এক বন্ধুর সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ফরম কিনে পরীক্ষা দেয় ছেলেটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার অসাধারণ ফল করলো। কিন্তু ভর্তি হবে কীভাবে? ভর্তির টাকা যে নেই। তাকে দেখারও কেউ নেই। কী হবে এখন? অতঃপর অন্যদের পরামর্শে প্রথম অালো বন্ধুসভা হয়ে, মাসুদ ভাই।
মাসুদ ভাইয়ের গল্প শুনে আমি অনেকক্ষন কাঁদলাম। আমরা যারা কিছুটা সুবিধাভোগী মানুষ কতো ভাবে কতো জায়গায় টাকা খরচ করি। কতো কারণে হতাশায় ভেঙ্গে পড়ি। আর একটি ছেলে যে জানে না কোথায় তার পরিবার, কোথায় তার ভবিষ্যত নেই সে কী না এতো লড়াই করছে? মাসুদ ভাইকে বললাম, আপনি ছেলেটার ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েন।
অামার আজও মনে আছে সেদিনের ঘটনা। ছেলেটি এলো কলাভবনের সামনে। ছেলেটাকে দেখলাম ভালো করে। কালো কুচকুচে। একটা চোখ ফোলা। দেখলেই মনে হয় শত সহস্র বছরের কষ্ট ওর মুখে। কিন্তু তার মধ্যেও একটা ঔজ্জ্বল্য অাছে। জানালো তার মেধাক্রম একদম শুরুর দিকে। আইন, অর্থনীতিসিহ আরো অনেক বিষয়ই পাবে? কীসে ভর্তি হবে?
অামি মনে মনে ভাবছি। এরপর বললাম শোনো ছেলে। তুমি আইন বা অর্থনীতি পড়ে জীবনে কী করতে পারবে আমি জানি না। এর চেয়ে ভালো তুমি সাংবাদিকতায় পড়ো। আমি তখন সাংবাদিকতায় মাষ্টার্স করছি। শিক্ষকরা প্রায় সবাই আমার পরিচিত। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন আরেফিন স্যার। তার কাছে যখন তখন যে কোন বিপদে যেতে পারি। ওকে হলে তুলতে হবে। আর আমার মাথায় ছিলো সাংবাদিকতায় ভর্তি হলে কয়েকমাস ক্লাস করলেই একটা পার্ট টাইম চাকুরি হয়তো দিতে পারবো। কারণ অামি চাই ও ঘুরে দাঁড়াক। নিজেই নিজের সমাধান করুক।
আজও মনে আছে, শ্যামল সেদিন আমাকে স্যার স্যার করছিলো। আমি তাকে সম্ভবত ধমক দিয়েছিলাম। বলেছিলাম আজ থেকে আমি তোমার বড় ভাই। কোন স্যার নয়। আর তুমি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সবসময় মাথা উঁচু করে চলবে। কারও কাছে মাথা নত করবে না। শ্যামল মাথা নত করেনি। মনে আছে, কলাভবন থেকে কাটাবনে গিয়ে শ্যামলকে খুব সস্তায় সম্ভবত ১৫০০ টাকায় একটা মোবাইল কিনে দিয়ে বলেছিলাম যখন দরকার ফোন দেবে।
পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছেলেটিকে ভর্তি করালাম গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। ভর্তি তো হলো। ছেলেটা থাকবে কোথায়? তার হল জগন্নাথ। নরমালি হলে সিট পাওয়া কঠিন। কয়েক মাস দেরি হবে। আর আমি তাকে রাজনৈতিকভাবে হলে উঠাতে চাইনি। সেদিনই তাকে নিয়ে গেলাম উপাচার্য আরেফিন স্যারের কাছে। আপনারা যারা আরেফিন স্যারকে চেনেন না তাদের বলি, যে কেউ যে কোন বিষয়ে স্যারের কাছে যেতে পারেন। আমি আমার ১৬ বছরের জীবনে তাই দেখেছি। আমি আমার কোন বিষয় নিয়ে স্যারের কাছে কখনো যাইনি। আর অন্য যে কারও বিষয় নিয়ে যখুনি গেছি স্যার ঘটনা শুনে সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
উপাচার্য কার্যালয়ে শ্যামলকে দূরে বসিয়ে স্যারকে সব ঘটনা খুলে বললাম। বললাম স্যার আজ থেকেই ওকে হলে রাখতে চাই। আপনি প্রভোষ্টকে বলে দেন। স্যার কথা শেষ হওয়ার পরপরই প্রভোষ্টকে ফোন করে বললেন একটা ছেলেকে সিট দিতে হবে। কিন্তু প্রভোষ্ট স্যার জানালেন প্রথম বর্ষের দিতে একটু সময় লাগবে। কয়েকদিন যেন অপেক্ষা করে। কয়েকদিন অন্য কোথাও রাখতে হবে।
আমি তখন জগন্নাথ হলে থাকা আমার বন্ধু সুদীপ কুমারকে ফোন দিলাম। আমার বন্ধুদের আমি এ জীবনে যখন যা বলেছি ওরা শুনেছে। সুদীপকে বললাম, ছেলেটা আজ থেকে তোর রুমে থাকবে। খেয়াল রাখবি কোন সমস্যা যেন না হয়। সুদীপ সিঙ্গেল রুমে থাকতো। কোন কথা না বলেই শ্যামলকে তার রুমে রাখে। সুদীপ নিজের আপন ছোট ভাইয়ের মতোই খেয়াল রেখেছিলো শ্যামলের।
শ্যামলকে ভর্তি করানোর পর আমি আমার অফিসের এক সহকর্মীকে বললাম আমার এক ছোট ভাইকে ছোট্ট একটা চাকুরি দিতে হবে। তিনি শ্যামলের ঢাকা থেকে যশোরে যাওয়া আসার বাস ভাড়া ফ্রি করে দিলেন এবং এক জায়গায় একটা অস্থায়ী চাকুরির ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি এরপর আস্তে আস্তে যোগআযোগ কমিয়ে দিলাম শ্যামলের সাথে। আমি চেয়েছিলাম ও যেন স্বাবলম্বী হিসেবে বড় হয়ে উঠতে পারে। ওকে যেন আমার কাছে আর আসতে না হয়।
শ্যামলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কম রাখলেও নানাভাবে আমি তার খোঁজ রাখতাম। সাংবাদিকতা বিভাগের কয়েকজন ছোট ভাইকে বলতাম আমাকে ওর খবর দিবি। হলে ছিল সুদীপ। সবাই আমাকে নিয়মিত তথ্য জানাতো। এমনকি ওর কিছু ভুল করলেও। তবে বেশিরভাগ সময়েই শুনতাম শ্যামল পরীক্ষায় খুব ভালো করছে। এরমধ্যেই প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ পেরুলো। শ্যামল কাজ শুরু করলো বিডিনিউজে।
অনার্স শেষ করে শ্যামল শুরু করলো চাকুরির পরীক্ষা দেয়া। ঘন্টার পর ঘণ্টা পড়তে পারে। এর মধ্যেই জানাল, যেখানে কাজ করতো কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। আমি বলি প্রথম আলোয় চলে আসো। আমি জানি ইংরেজিতে শ্যামল খুব ভালো। ওকে প্রথম আলোর অনলাইনের দায়িত্বে থাকা ফখরুদ্দীন জুয়েল ভাইয়ের কাছে ওর সিভি পাঠালাম। বললাম ওকে ডাকেন। অনলাইনের ইংরেজি বিভাগে সহ-সম্পাদক পদে পরীক্ষার জন্য ডাকা হলো। জুয়েল ভাই আমাকে কয়েকদিন পর জানালো, তোর শ্যামলের পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। আমরা ওকে নেবো। আমি আনন্দের হাসি হাসি।
শ্যামল যোগ দিলো প্রথম আলোয়। সম্পাদক মতি ভাইয়ের কাছ থেকে যোগদানপত্র নিয়ে আমার সঙ্গে যখন দেখা করলো কী যে ভালো লাগলো। আমি শ্যামলকে সাংবাদিক হিসেবে দেখতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম, ও সরকারি চাকুরি করুক। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক। শ্যামলও তাই চেয়েছিল। শুনবেন শ্যামলের ফল? চা বোর্ডের একটা চাকুরির পরীক্ষায় প্রথম হলো। আমার প্রথম আলো অফিসে মিষ্টি নিয়ে এলো। এরপর ওর চাকুরি হলো প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে। বেতন বেশি। শরীয়তপুরে যোগ দিলো ম্যানেজার হিসেবে। আমি বসে আছি আরও ভালো খবরের। এরপর এলো সেই কাঙ্খিত খবর।
২০১৫ সাল। একদিন শ্যামলের ফোন। ব্যাপক উত্তেজিত। বললো ভাই আমার চাকুরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক। আমার সেদিন আনন্দে কান্না পেলো। মনে হলো আমি আজ সফল। ২০১৫ সালের ২৪ মে। আমার শ্যামল যোগ দিলো বাংলাদেশ ব্যাংকে। ওর পোস্টিং হলো বরিশালে।
আমি বরিশালে কাজে গিয়ে শ্যামলকে ডাক দিলাম। শ্যামলের সাথে গল্প হলো। আমি যতোই ওকে দেখি মুগ্ধ হই। শ্যামল জানালো, দেশে বিদেশে নানা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। খুব ভালো করছে চাকুরিতে। এরপর একদিন কালের কণ্ঠে শ্যামলকে নিয়ে খবর ছাপা হলো। আমাদের শ্যামল রোদ্দুর হয়েছে।
আনন্দের খবর হলো, ওর বিয়ের ব্যবস্থাও হয়েছে। আমাদের বউমাও খুব অসাধারণ মেয়ে। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ওদের দুজনের দুজন ছাড়া কেউ নেই। আর হ্যা আমাদের শ্যামলের পদোন্নতির আদেশ হয়েছে। আজ থেকে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-পরিচালক। এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী আছে।
আমি শ্যামলের গল্প আজীবন করবো ওকে বড় করতে। শ্যামল এই দেশের সম্পদ। আমি বিশ্বাস করি, আমি-আমরা বা কারো সাহায্যে বা বদান্যতায় নয়, শ্যামল এত দূর এসেছে পুরোপুরি ওর মনের জোরে। ওর দৃঢ়তায়। ওর লড়াইয়ে। আমি মনে করি শ্যামলের মতো হাজারও শ্যামল আছে। ওর এই দীর্ঘ গল্প করার কারণ সব শ্যামলরা যেন শক্তি পায়।
আমি বিশ্বাস করি রাখাল বালক থেকে আতিউর রহমান যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়েছিল, আমার শ্যামল কান্তি বিশ্বাস একদিন তাই হবে। আর যে দেশে শ্যামলের মতো ছেলে আছে সেই দেশকে ঠেকিয়ে রাখে কে?
লেখকঃ শরিফুল হাসানের ফেসবুক থেকে নেয়া