এসকে সিনহার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেন রাষ্ট্রপতি


টাইমস প্রতিবেদক | Published: 2017-11-14 18:51:31 BdST | Updated: 2024-05-20 05:24:52 BdST

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সেই সাথে সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে আইনমন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বঙ্গভবন।

মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) সকালে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদিন সময় সংবাদকে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে আইন মন্ত্রণালয়।

এর আগে গত শুক্রবার সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনে রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা।

ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে বিতর্কের মুখে ছুটি নিয়ে দেশত্যাগের ২৮ দিনের মাথায় তিনি পদত্যাগ করেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২১ বিচারক প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাই প্রথম, যিনি এভাবে পদত্যাগ করলেন।

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এসকে সিনহার ৩১ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে তাকে অবসরে যাওয়ার ৮১ দিন আগেই পদত্যাগ করতে হল।

এসকে সিনহার পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, তিনি দেশে ফিরে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নানা কারণে পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে সিঙ্গাপুরে বসেই পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন।

এদিকে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগের পর শনিবার বিকালে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না দেবেন, ততক্ষণ মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাই প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করবেন।

আনিসুল হক বলেন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির একক এখতিয়ার হচ্ছে, সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না দিচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি তার দায়িত্ব পালন করবেন। সে হিসেবেই এখন বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা দায়িত্বে থাকবেন।

এছাড়া অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুগান্তরকে বলেন, পদত্যাগের পর প্রধান বিচারপতির পদটি শূন্য থাকতে পারে না। এক্ষেত্রে সংবিধানের ৯৬(৪) অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি।

উল্লেখ্য, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত।

নয়জন আইনজীবীর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ৫ মে সংবিধানের ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে রায় দেন। ৩ জুলাই আপিল বিভাগও ওই রায় বহাল রাখেন। যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায় ১ আগস্ট।

রায়ের পর্যবেক্ষণে এক স্থানে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মানবাধিকার ঝুঁকিতে, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত, সংসদ অকার্যকর, কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।’

৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে সরকার, সংসদ, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, সামরিক শাসন এবং রাষ্ট্র ও সমাজের বিষয়ে এমন অনেক পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আমি ও আমিত্ব’র সংস্কৃতির বিষয়ে কড়া সমালোচনা করেন ওই রায়ে। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরাও ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে তাদের অভিমত তুলে ধরেন রায়ে।

এরপরই রায়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার দেয়া পর্যবেক্ষণের তীব্র সমালোচনা করেন সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা। এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে সরব হন।

এদিকে রায় প্রকাশের পর নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা।

তার পদত্যাগের দাবি ওঠার একপর্যায়ে ৮ সেপ্টেম্বর ছুটি নিয়ে কানাডা ও জাপান সফরে যান। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে তিনি দেশে ফেরেন।

সুপ্রিমকোর্টের ২৫ দিনের অবকাশ শেষে প্রথম কার্যদিবস ছিল ৩ অক্টোবর। কিন্তু অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ২ অক্টোবর এক মাসের (৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত) ছুটি চেয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে চিঠি পাঠান প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। রাষ্ট্রপতি ওই ছুটি মঞ্জুরও করেন।

পরে বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে সরকারি আদেশের (জিও) প্রসঙ্গ এলে এসকে সিনহা রাষ্ট্রপতির কাছে আবারও আবেদন করে জানান, তিনি ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে চান। বিষয়টি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে।

ছুটি বাড়ানোর পর ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান বিচারপতি। দেশ ছাড়ার আগে প্রধান বিচারপতি তার বাসভবনের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি অসুস্থ নই। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। বিচার বিভাগের স্বার্থে ফিরে আসব। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে একটি মহল প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়েছেন। বিচার বিভাগ যাতে কলুষিত না হয়, এ জন্য আমি সাময়িকভাবে যাচ্ছি।’

তিনি তার এ বক্তব্য সংবলিত একটি লিখিত বিবৃতিও সাংবাদিকদের দিয়ে যান।

লিখিত বিবৃতি দিয়ে তার দেশত্যাগের পরের দিন ১৪ অক্টোবর সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে তাতে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ তুলে ধরা হয়।

এতে বলা হয়, ওই অভিযোগ ওঠার পর তার (এসকে সিনহা) কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে চাননি আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা।

এ অবস্থায় প্রধান বিচারপতির দেশে ফেরা নিয়ে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনসহ ১১ অভিযোগ ওঠায় তার সঙ্গে অন্য বিচারপতিরা এক বেঞ্চে বসতে চাননি উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, তিনি (এসকে সিনহা) একা তো বিচার কাজ করতে পারবেন না।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর প্রধান বিচারপতি হিসেবে এই পদে তার ফেরা সুদূরপরাহত। এ কথা তিনি একাধিকবার মিডিয়ায় বলেন।

এ বাস্তবতায় গত সপ্তাহের প্রথমদিকে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা একাই অস্ট্রেলিয়া থেকে সিঙ্গাপুরে আসেন।

সিঙ্গাপুরে ৫ দিন অবস্থান করার পর শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় কানাডার উদ্দেশে সিঙ্গাপুর ছাড়েন। আর সিঙ্গাপুর ছাড়ার আগে তিনি বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।

সূত্র জানায়, এসকে সিনহার স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা চান, আর কোনো ঝামেলায় না গিয়ে শান্তিতে তিনি বিদেশেই অবস্থান করবেন। আপাতত তিনি দেশেও ফিরবেন না।

এনএইচ/ ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭