লাল বাস: স্বপ্নের বাহন


ঢাবি টাইমস | Published: 2019-01-31 07:44:35 BdST | Updated: 2024-05-18 20:40:15 BdST

“মামা,আর দুইটা মিনিট দাঁড়ান”, “মামা, বাস ছাড়তে এত দেরী কেন?”, “ মামা আজকে কিন্তু পরীক্ষা আছে জোরে টানতে হবে”- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের চালকদের এমন কথোপকথন রোজকার চিত্র। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে প্রথম বর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে পা রাখে ছাত্রছাত্রীরা। ক্লাসরুম থেকে শুরু করে শ্যাডো, কার্জনের পুকুরপাড় থেকে টিএসসি-এসব কিছু হয়ে ওঠে তাদের জীবনের অংশ। আবাসিক শিক্ষার্থীদের সাথে ক্যাম্পাস জীবনের যোগসূত্র তৈরীর প্রথম মাধ্যম যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, তেমনি অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের সাথে ক্যাম্পাসের প্রথম স্মৃতি হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাস। চার বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই বাস ঘিরে তৈরী হয় শত স্মৃতি, গড়ে ওঠে সম্পর্ক, তৈরি হয় নতুন বন্ধুত্ব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জন হলে প্রবেশপথের উল্টোপাশে চোখ মেলে তাকাতেই স্বাগত জানায় লালরঙা সিংগেল ও ডাবল ডেকার বাসের সারি।মানুষের মতই বাসগুলোর রয়েছে আলাদা পরিচয়; উল্লাস, ক্ষণিকা, বৈশাখী, চৈতালি, তরঙ্গ, হেমন্ত, কিঞ্চিৎসহ নানা বাহারি নামের নেমপ্লেট ঝোলানো বাসগুলোর গায়ে। বর্তমানে ২৫টি রুট চালু আছে; প্রতিটি রুটের বাসের জন্যই রয়েছে আলাদা নাম।

পরিবহন ম্যানেজার-২ আতাউর রহমান জানান, ১৯৮১ সাল থেকে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ছাত্রছাত্রীদের ক্যাম্পাসে যাতায়াত সহজ করার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় বাস সার্ভিস চালু করে। কর্তৃপক্ষ নয়, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরাই এসব নামকরণের মাধ্যমে লাল বাসগুলোকে পরবর্তীতে আরেকপ্রস্থ রঙিন করে তোলে। চৌকো বাসগুলোর ভেতরে গড়ে ওঠে বৈচিত্র্যময় ‘বাস-কালচার’। প্রতিটি বাসেই গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন মেয়াদের কমিটি। ফেসবুক পেজে বাসের সময়সূচিতে পরিবর্তন জানানো থেকে শুরু করে বার্ষিক বনভোজন, নবীনবরণ, ইফতার পার্টি এমনকি বাসের কোন শিক্ষার্থীর জন্য রক্ত বা অর্থ সাহায্যের প্রয়োজনেও সর্বদা সক্রিয় এসব কমিটি।

বাসের সিটগুলোর মতই গেটও উপচে থাকে শিক্ষার্থীদের দ্বারা। বাসের গেটে দাঁড়ানো এসব ছেলেদের ‘অভিভাবক’ সম্বোধন করেচৈতালি বাসের যাত্রী আইন বিভাগে অধ্যয়নরত সুমাইয়া শারমিন বলেন, “তারা গেটে দাঁড়িয়ে কোনদিক থেকে দ্রুত যাওয়া যাবে সেদিকে লক্ষ্য রাখেন, কখনোবা ট্রাফিক পুলিশকে সিগন্যাল ছাড়ানোর অনুরোধ করেন।বাসের ভেতরে খুব নিরাপদ লাগে নিজেকে। তাছাড়া জ্যামের একঘেয়েমি কাটাতে সবাই মিলে যখন বাসের গেটে গান ধরেন.. ভার্সিটি ছেড়ে গেলে এই মুহুর্তটা খুবই মিস করব”। একই বাসের আরেক যাত্রী ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াসিন বাস নিয়ে মজার স্মৃতি হাতড়ে বলেন, “একবার এক বড়ভাইয়ের জন্মদিনে পুরো রাস্তা তার নামে স্লোগান দিতে দিতে বাড়ি ফিরেছিলাম।রাস্তার লোকেরা যেভাবে আমাদের দেখছিল সে স্মৃতি ভোলার নয়”। পাবলিক বাসে গেলে যে এমন অনেক অভিজ্ঞতা থেকেই বঞ্চিত হতেন শিক্ষার্থীরা সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

“একবার লোনের কাজে শ্যামলির অগ্রণী ব্যাংকে গিয়েছি। সেখানে এক মেয়ে আমাকে সালাম দিল। আমি চিনতে না পেরে বললাম, ‘তুমি কে’? সে বলল, মামা আমি তো আপনাকে প্রায়ই জ্বালাইতাম। ফোন দিয়ে বলতাম একটু দেরি করে আসতে। পরে সে ব্যাংকের মধ্যেই চা-নাস্তা দিয়ে অ্যাপায়ন করালো। এভাবে শুধু বর্তমান ছাত্ররাই নয়, নানা জায়গায় পুরনো ছাত্রদের থেকেও আমি ভালবাসা পেয়েছি”, কথাগুলো হাওলাদার মোহাম্মদ নিজামুদ্দিনের। বাসের ‘মামা’ অর্থাৎ চালকদের সাথেও যে শিক্ষার্থীদের কতটা সম্মানপূর্ণ এবং শ্রদ্ধার সম্পর্ক তাই জানা যায় ২০০৮ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রুটের এই বাসচালকের কথা থেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে বাসেযাওয়া-আসাকরেন।কিন্তু যেভাবে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট বাড়ানো হচ্ছে ,তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাসের পরিমাণ বাড়ানোটা কর্তৃপক্ষের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আবাসন সংকটই নয়, পরিবহনের ক্ষেত্রেও নানামুখী সংকটে চিড়েচ্যাপ্টা তারা। নিজস্ব বাসের পাশাপাশি তাই বিআরটিসির ভাড়া বাসের ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন যার জন্যে প্রতি মাসে খরচ করতে হয় ৭৫-৮০ লক্ষের এক বিরাট অংকের টাকা। তারপরেও স্থান সংকুলান হয় না হাজার পাঁচেক শিক্ষার্থীর ।ফলে প্রতিদিন গাদাগাদি করে বসে বা কখনো রীতিমত বাদুড়ঝোলা হয়ে তাদের যাতায়াত করতে হয়।

সারাদিনের ক্লাস শেষে ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফেরার পথে বছরের পর বছর তবু এই বাসই হয়ে থেকেছে নতুন স্বপ্নের অনুপ্রেরণা কিংবা সাক্ষী হয়ে থেকেছে কোন স্বপ্নভঙ্গের। সাধারণের কাছে এই বাসগুলো হয়তো কেবলই শিক্ষার্থী বহনকারী লালরঙা বাহন, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানে এই বাস তাদের কতটা আপন, ঘরে ফেরার কত বড় নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।----DUMCJ