মুদি দোকানী থেকে ‘চ্যান্সেলর গোল্ড মেডেল’ পাওয়ার গল্প


টাইমস ডেস্ক | Published: 2017-12-22 22:34:38 BdST | Updated: 2024-05-20 21:01:11 BdST

কেউ ব্যক্তিগত কারণে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাননি, দুর্ঘটনা কারো স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে, কেউ সাধারণ পরিবার থেকে এসেও অনেক বাধা সয়ে লড়ে গেছেন স্বপ্নের সঙ্গে। তাঁরা প্রত্যেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হিসেবে পেয়েছেন ‘চ্যান্সেলর গোল্ড মেডেল’। এসব অসাধারণ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর সাফল্যের গল্প নিয়ে লিখেছেন সাইফুল ইসলাম।

মুদি দোকানদার শম্ভুচন্দ্র সাহাও অন্যদের মতো চাইতেন, ছেলে মানুষের মতো মানুষ হয়ে তাঁর মুখ উজ্জ্বল করবে, গর্বভরে কনকের কথা বলবেন। কনকচন্দ্র সাহা লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন।

সেটি অবশ্য পিসির (ফুফু) কারণে। তিনি এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছেন। ভাইপো যাতে কোলাহলে, খেলায় মন দিতে না পারে সে জন্য দরজা বন্ধ করে পড়িয়েছেন। কনকের এসএসসির ফল জিপিএ ৪.৫০। এইচএসসিতে ৪.৭০ পেয়েছেন। এরপর টাকার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে নিজেদের দোকানে কাজ শুরু করলেন। দোকানে বসে নানা দ্রব্য কেনাবেচা করেন, বন্ধুরা সামনে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিংয়ে যান। দেখে আড়ালে মুখ লুকিয়ে কাঁদেন। খেয়াল করে একদিন বাবা বললেন, ‘আমি তো সারা জীবন মুদিখানাতেই জীবন শেষ করে দিলাম, তুই বড় হ। আবার পড়ালেখা শুরু কর।’ ততদিনে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শেষ। এরপর ঢাকায় এসে সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএতে ভর্তি হলেন। তবে হঠাৎ শহরে আসা ছেলেটির সঙ্গে অন্যরা মিশতে ভালোবাসতেন না, কথাও বলতে চাইতেন না। বন্ধুদের নিয়েই তাঁরা অ্যাসাইনমেন্টের দল গড়ে তুলতেন।

গ্রাম থেকে আসা পাঁচজনের দলে থাকলেন কনক। ইউটিউব দেখে প্রেজেন্টেশনের স্লাইড বানালেন। খুব খেটে প্রেজেন্টেশন তৈরি করলেন। ফলে ১৫ মিনিটের নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে মুগ্ধ শ্রোতারা ৪৫ মিনিট ইংরেজি কোর্সে তাঁদের বক্তব্য শুনলেন। এরপর থেকে ক্যাম্পাসে তাঁর পরিবেশ বদলে গেল। পরীক্ষার আগে তাঁর খাতা বন্ধুরা ফটোকপি করে নেওয়া শুরু করলেন। পড়ালেখায় আরো মনোযোগী কনক প্রথম সেমিস্টারে জিপিএ চারের মধ্যে চার পেলেন। তবে গ্রামে যে ছেলেটি কোনো দিন পানি ফুটিয়ে খাননি, ঢাকার দূষিত পানি খেয়ে তিনি টাইফয়েডে পড়ে গেলেন। বাড়ি গিয়ে সুস্থ হয়ে ফেরার পর বেশ কিছুদিন বুয়া আসেন না দেখে মায়ের ফোনে রান্না শিখে নিলেন। এত কিছুর পরও লেখাপড়ায় মনোযোগ কমাননি।

প্রথম সেমিস্টারে ৫০ শতাংশ ওয়েইভার পেয়ে মনে হলো, ভালো করে পড়লে তো বাবার উপকার হবে। পড়ার গতি বাড়িয়ে দিলেন। সাত দিন আগে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করে ফেলেন। দ্বিতীয় সেমিস্টারেও চারে চার! এবার ৬০ শতাংশ ওয়েইভার! ব্যক্তিগত কম্পিউটারের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পড়েন। কোনো দিন জায়গার অভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। কোনো দিন ভুলে সেভ করা হয় না বিদ্যুত্ চলে গেলে। ফলে নতুন করে কাজ করতে হয়। কনক খাটুনি কমাননি। ফলে ১০ম সেমিস্টার পর্যন্ত প্রায় সব কটিতে চার জিপিএ ধরে রেখেছেন। একমাত্র ‘বিজিনেস রিসার্চ অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট’ ভালোভাবে বুঝতে না পারায় এ গ্রেড পেয়েছেন। ফলে চূড়ান্ত সিজিপিএ ছিল ৩.৯৮।

তিনি সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির ষষ্ঠ সমাবর্তনে ‘চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন। এই অসাধারণ ফলের রহস্য জানালেন, ‘প্রথম সেমিস্টার থেকেই মোহাম্মদ রাকিব, ফাহিম শাকের, নাহিদ শাহ খুব সাহায্য করেছেন। বন্ধুদের পড়া বুঝিয়ে দিয়ে মেধাকে আরো শাণিত করতাম। এক বন্ধুকে পড়াতে হবে বলে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা পড়ে আসতাম। পরীক্ষায় এসব কাজে দিয়েছে। ’ তবে বেদনা তাঁরও আছে। যেদিন এই স্বর্ণপদকের জন্য মনোনয়নের কথা জানলেন, সেদিনই মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘তুই ছাড়া আমাদের আর কোনো সম্বল নেই। দোকানটি পুড়ে ছাই। ’ তিন দিন পর বাবাকে ‘আমি সেরা ছাত্র হিসেবে স্বর্ণপদক পেয়েছি’—বলার পর তিনি সম্বলটুকু হারিয়েও ছেলের গর্বে প্রাণ খুলে হাসতে লাগলেন। কনক শিক্ষক হবেন।

টিআই/ ২২ ডিসেম্বর ২০১৭