শিক্ষা সফর মানে পিকনিক নয়


টাইমস ডেস্ক | Published: 2018-01-27 22:43:34 BdST | Updated: 2024-05-20 21:01:16 BdST

দেশের অনেক বিদ্যালয়েই হয় না শিক্ষা সফর। আবার যেসব স্কুলে শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়, তার অনেকটাই রূপ নেয় পিকনিকে। সফরের শিক্ষাটা পাওয়া হয়ে ওঠে না বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীরই। লিখেছেন আরাফাত শাহরিয়ার

ছেলে-মেয়েরা খেলতে খেলতে পরিচিত হয় গাছপালা, ফুল-ফল, পাখি আর চারদিকের প্রকৃতির সঙ্গে। জেনে নেয় ইতিহাস ও বিজ্ঞানের তথ্যগুলো। আর তাই বয়স অনুযায়ী ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন সময় আহসান মঞ্জিল, সোনারগাঁ, মহাস্থানগড় বলধা গার্ডেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ভাসানী নভোথিয়েটার, বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রভৃতি স্থানে শিক্ষা সফরে নিয়ে যায় ‘নালন্দা’। ভ্রমণ শিক্ষার অনুষঙ্গ নয়, আবশ্যকীয় বিষয়—এমনটিই মনে করে ব্যতিক্রমধর্মী বিদ্যালয়টি।

আরেক ব্যতিক্রমী বিদ্যাপীঠ অরণি বিদ্যালয়েও শিক্ষা সফর শিক্ষারই একটি অংশ। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নিনা ভুঁইয়া জানান—পাঠ্য বইয়ের নানা বিষয়—যেমন গাছপালা, পাখি, ফুলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় বাচ্চাদের; তেমনি পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় দর্শনীয় স্থানগুলোর সঙ্গেও। স্টাডি ট্যুরের স্থান নির্ধারণ করা হয় বয়সের সঙ্গে মিল রেখে। একেক শ্রেণিকে নিয়ে যাওয়া হয় একেক জায়গায়। এ রকম কিছু বিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষা সফর হলেও অনেক বিদ্যালয়েই তা হয় না। হলেও অনেক স্কুল-কলেজে সেটা পিকনিকে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

কোনো কিছু চোখে দেখে শেখা আর সে বিষয় মুখস্থ করে শেখার মধ্যে পার্থক্য আছে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনস, দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেট, প্রাচীন বৌদ্ধসভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাহাড়পুর প্রভৃতি সম্পর্কে ছাত্র-ছাত্রীরা বইয়ে পড়ে ও শিক্ষকদের কাছ থেকে শোনে। কিন্তু তারা যদি জায়গাগুলোতে যেতে পারে, তাহলে সে ছবি সারা জীবন মনে থাকবে। শিক্ষা সফরের বিষয়গুলো সহজে আত্মস্থ হয়ে যায় এবং তা কখনোই স্মৃতি থেকে মুছে যায় না। শিক্ষা সফরের অন্যতম আকর্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকে নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি, কৌতুক ইত্যাদি। ফলে একদিকে যেমন বিনোদন হয়, অন্যদিকে তেমনি শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে। একটি শিক্ষা সফর সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে স্থান নির্বাচন, যাতায়াতের ব্যবস্থা, খাবার সরবরাহ করাসহ ছাত্র-ছাত্রীদের আনুষঙ্গিক অনেক কাজ করতে হয় মিলেমিশে। এতে তাদের মধ্যে সহযোগিতা ও সম্প্রীতির মনোভাব গড়ে ওঠে। তা ছাড়া এসব কাজ করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দায়িত্ব সচেতনতাও বাড়ে। শিক্ষা সফরে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজ দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।

মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ হাফিজুল ইসলাম বলেন, “ঢাকা শহরের যে পরিবেশ, তাতে শিক্ষার্থীরা যন্ত্রের মতো বেড়ে উঠছে। তাদের মানসিক বিকাশে অবশ্যই বছরে অন্তত একবার ঢাকার বাইরে প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া উচিত। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা ‘দেখা থেকে শেখা’য় বেশি উপকৃত হয়।”

শিক্ষা সফর মানে পিকনিক নয়

শিক্ষা সফরের প্রধান উদ্দেশ্য পাঠ্যসূচিসংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন, অজানা পৃথিবীর বিচিত্র রূপ প্রত্যক্ষ করা। তাই পিকনিক ও শিক্ষা সফর এক নয়। শিক্ষা সফরের জন্য এমন স্থান নির্বাচন করা উচিত, যা শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে সহায়ক। অথচ বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে স্টাডি ট্যুরের নামে আয়োজন করা হয় পিকনিক বা বনভোজনের। স্টাডি ট্যুরটা অনেকটাই পিকনিক হয়ে যায়, সেটা শিক্ষা সফর থাকে না—স্বীকার করলেন রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. আবু সায়েম। শিক্ষকরা মনে করেন, ছোট ছেলে-মেয়েদের দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত করাতে নিয়ে যাওয়া যায় বিভিন্ন জাদুঘর ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোতে। বাণিজ্যের ছাত্রদের বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম দেখিয়ে আনা যেতে পারে। বিজ্ঞানের ছাত্রদের কোনো বিজ্ঞান গবেষণাগার বা সায়েন্স মিউজিয়াম দেখানো যেতে পারে।

‘শিক্ষা সফরে গিয়ে হাতে-কলমে অনেক কিছু শিখেছি, অনেক কিছু জানতে পেরেছি।’ এমনই অভিজ্ঞতা সিলেট সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী তাবাসসুমের। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী জেরিনের মা আফরোজা বেগম মনে করেন, ‘পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও শিক্ষা প্রয়োজন। এ জন্য শিক্ষা সফর বাধ্যতামূলক করা উচিত। কারণ আনন্দের সঙ্গে হাতে-কলমে না শিখলে লেখাপড়াটা পরিপূর্ণ হয় না।’

হচ্ছে কি হচ্ছে না

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিরপুর চিড়িয়াখানা, জাতীয় জাদুঘর, লালবাগ কেল্লা ছাড়া অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয় না তাদের। দূরের কোনো স্পটেই যেতে রাজি নয় বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে কয়েক বছর বন্ধ থাকলেও এখন ফের চালু করা হয়েছে স্টাডি ট্যুর। হলিক্রস স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্রীদের প্রতিবছর স্টাডি ট্যুরে যাওয়ার সুযোগ মেলে না। এক বছর স্টাডি ট্যুর হলে পরেরবার এর পরিবর্তে আয়োজন করা হয় বিজ্ঞান মেলার। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজের অনেক ছাত্র-ছাত্রীর স্কুলজীবনে একবারও শিক্ষা সফরে যাওয়ার সুযোগ মেলেনি। একবার স্টাডি ট্যুরে গিয়ে এক ছাত্র পুকুরে ডুবে মারা গেলে বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষা সফর। ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ স্কুল-কলেজে শিক্ষা সফর হয় না।

স্টাডি ট্যুর না হওয়ার পেছনে অভিভাবকদের অনীহাকে দায়ী করলেন অনেক শিক্ষক। আবার অনেক স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের অভিযোগ, স্টাডি ট্যুরে বেশির ভাগ শিক্ষকের সম্মতি নেই। পরীক্ষা, পড়ার ক্ষতি ইত্যাদি অজুহাত দেখান তাঁরা। বেশি খরচ, খাওয়ার সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতার জন্য ছেলে-মেয়েদের ট্যুরে পাঠাতে চান না—জানালেন কয়েকজন অভিভাবক। উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র রাফির বাবা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘ওদের নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব কে নেবে? তা ছাড়া দুর্ঘটনা তো আর বলেকয়ে আসে না!’

যাচ্ছে কোথায়

হলিক্রস স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক রোকেয়া বেগম জানান, বিদ্যালয়টিতে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে নবম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিবছর স্টাডি ট্যুর হয়। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে।

ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদও জানান, স্টাডি ট্যুরে ছোটদের নিয়ে যাওয়া হয় আহসান মঞ্জিল, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সামরিক জাদুঘরসহ ঢাকার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গাজীপুরের একটি রিসোর্টে। স্টাডি ট্যুর পিকনিক হয়ে যায়, বিনোদনের জন্যই শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয় বলে স্বীকার করলেন তিনি। একসঙ্গে যাওয়া, র্যাফল ড্রসহ মজার অনেক কিছু থাকে। তবে সেখানে শেখারও অনেক কিছু থাকে বলে জানালেন ইংরেজির এই শিক্ষক।

ছাত্রীরা কম যাচ্ছে

স্কুল-কলেজগুলোতে ছাত্রদের তুলনায় শিক্ষা সফরে অনেক কম যাচ্ছে ছাত্রীরা। বনানী বিদ্যা নিকেতনের ছাত্রী রাইসার অভিযোগ, ‘মা-বাবা শিক্ষা সফরে যেতে দেন না।’ উত্তরা হাই স্কুলের এক ছাত্রীর মা সুমাইয়া রহমান মেয়েকে ট্যুরে পাঠানো নিরাপদ মনে করেন না। হলিক্রস স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক রোকেয়া বেগম জানান, ‘নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে আমরা মেয়েদের দূরে কোথাও নিতে চাই না।’ ভিকারুননিসা নূন স্কুলের একজন শিক্ষকও স্বীকার করলেন, মেয়েদের টয়লেট সমস্যা, দূরের স্পট ইত্যাদি অজুহাতে অভিভাবকরা যেতে দেন না। ফলে অর্ধেক ছাত্রী যাচ্ছে না।

খরচ দেবে কে?

বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই খরচের পুরোটা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়—এ অভিযোগ প্রায় প্রতিটি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের। অথচ এ খরচ বহন করা উচিত প্রতিষ্ঠানের ফান্ড ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার মাধ্যমে। অনেক শিক্ষকই স্বীকার করলেন, শিক্ষা সফরের জন্য স্কুল-কলেজের নিজস্ব ফান্ড থাকা উচিত।

শিক্ষা সফর কি বন্ধ হয়ে যাবে?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা সফর ও দলগত ভ্রমণের বিষয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পূর্বানুমতি ছাড়া শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সফর বা পিকনিকে যেতে পারবে না। শিক্ষা সফর, পিকনিক বা দলগত ভ্রমণে যাওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় থেকে সাত দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, ভ্রমণের জন্য নির্ধারিত স্থানে যাওয়ার আগে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে হবে। নতুন পরিপত্রের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের হয়রানি এবং শিক্ষা সফর বন্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন স্কুলশিক্ষক মন্তব্য করেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুমতি চাওয়া বা অনুমতি পাওয়া অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে কঠিন হবে। ফলে ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষার্থীদের নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো স্থানে সফরে যেতে পারবে না।

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি সুবোধ চন্দ্র ঢালী বলেন, ‘ভ্রমণটা যেমন আনন্দদায়ক হওয়া দরকার, তার আগে দরকার নিরাপত্তা। কোনো কারণে যদি সেখানে কোনো দুর্ঘটনা বা অঘটন ঘটে, তখন কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনকেই ডাকতে হবে। শিক্ষা সফরে অনেক ছাত্রছাত্রী নিয়ে যাওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা এখানে, ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এখানে প্রতিবন্ধকতার কোনো কিছু নেই।’ সূত্র: কালের কন্ঠ।

এসজে/ ২৭ জানুয়ারি ২০১৮