ছাত্রত্বের রেশ কাটাতে না কাটাতেই শিক্ষক এই মেধাবী ছাত্রী


টাইমস অনলাইনঃ | Published: 2018-07-23 06:27:53 BdST | Updated: 2024-05-20 18:49:52 BdST

এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন সাজিয়া আফরিন। মেধাবী এই ছাত্রী ভালো শিক্ষকও। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রভাষক। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন ওমর শাহেদ।

বাবা মাসুদুর রহমান অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ আর মা আয়েশা ফ্লোরা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। ফলে তাঁদের মেয়ে যে আইনের দিকেই যাবেন সেটিই স্বাভাবিক। তবে সেদিকে গেলেন না সাজিয়া আফরিন। সাজনু নামে যাঁকে বাড়ির সবাই ডাকে। তিনি ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্রী। কবিতা লিখতে ভালো লাগে। আবার গানের দিকেও আগ্রহ আছে। ছোটবেলায় গান শিখতেন। মা-ই আগ্রহ ভরে গানের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। গান শেখানোর স্কুলেও তিনিই নিয়ে যেতেন। জীবনে অনুপ্রেরণা বলতে মার কথাই বললেন মেয়ে। এইচএসসি পাস করার পর ছায়ানটে রবীন্দ্রসংগীতের ক্লাসেও ভর্তি হয়েছিলেন। তবে পড়ালেখার দিকে প্রচণ্ড মনোযোগ দিতে হয়েছে বলে আর সেই সৃজনশীল চর্চাটি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধাবী ছাত্রী। মায়ের শাসনে আর বাবার আদরে লেখাপড়ার দিকেও ভালো করেছেন সাজিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র বাবা তাঁকে এসএসসি পর্যন্ত গণিত পড়াতেন। অন্যান্য বিষয়ও কমবেশি দেখিয়ে দিয়েছেন।

আর সাজিয়ার নিজের মনোযোগ তো ছিলই। ফলে ঢাকার অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে জিপিএ ফাইভ নিয়ে তিনি পাস করেছেন। আর ঢাকা সিটি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৫ নিয়ে পাস করেছেন তিনি। এর পর ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন সাজিয়া আফরীন। পড়ার বিষয় তাঁর ‘দর্শন’। বরাবরের ভালো ছাত্রীটি কেন দর্শনে পড়তে গেলেন? এ প্রশ্নের জবাবে সাজিয়া হেসে দিলেন। এর পর বললেন, ‘আমার আসলে বিজ্ঞানে পড়তে কখনো ভালো লাগেনি। সব সময়ই এই বিভাগকে কাঠখোট্টা মনে হয়েছে। আর দর্শন, শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি সব সময়ই আগ্রহ ছিল। যেকোনো বিষয়কে যৌক্তিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা, যেকোনো বিষয়কে নির্দিষ্ট যুক্তির আলোকে ভাবার মতো শিক্ষা কিন্তু দর্শনই প্রদান করে। আর আমাদের সমাজে অন্ধভাবে যেকোনো কিছু বিচার করার ফলে যে কুসংস্কারের, মৌলবাদের ব্যাপকমাত্রায় প্রসার ঘটছে, সেগুলো রোধ করার জন্য যৌক্তিক বিচার অবশ্যই প্রয়োজনীয়। সে জন্য দর্শনের কোনো বিকল্প নেই। কারণ দর্শন কোনো কিছু অন্ধভাবে বিচার বা বিশ্বাস করে না। সে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে যুক্তি দিয়ে গ্রহণ করে।’ এ তো গেল বিভাগের গল্প? এখানে সাজিয়ার ফলাফল?

তিনি কোনো কিছু মুখস্থ করে যাননি, সেটি নিয়ে নিজের বিচার-বিবেচনাও প্রয়োগ করে খাতায় লিখেছেন। তিনি নিয়মিত ক্লাস করেছেন, ক্লাস লেকচারগুলো ভালোভাবে খাতায় তুলেছেন, পরীক্ষার আগে আগে সব পড়া গুছিয়ে রেখেছেন। আর পরীক্ষার আগের ছুটিতে টানা লেখাপড়া করেছেন। যেকোনো বিষয়ের সারবস্তু বোঝার চেষ্টা করেছেন। বিভাগের সেমিনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে গিয়েও প্রয়োজনে নোট নিয়েছেন। পরীক্ষার খাতায় নিজের মতো করে সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তবে অন্যদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য ছিল—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে নিয়মিত যে সেমিনারের আয়োজন করা হয়, প্রথম বর্ষ থেকে এই সেমিনারগুলোর তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণকারী ছিলেন। সেখান থেকে লেখাপড়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো টুকে নিয়ে আসতেন। ফলে তাঁর খাতায় দার্শনিকদের বিশ্লেষণের পাশাপাশি প্রেক্ষাপটগুলোও উঠে এসেছে। ফলে অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছেন সাজিয়া আফরিন। এভাবেই অনার্সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন। তাঁর সিজিপিএ ছিল ৩.৭১।

এ কারণেই ২০১৭ সালে তিনি বিভাগের সেরা ছাত্রী হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে স্বর্ণপদক ও পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আকতারুজ্জামান তাঁকে ডিনস অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। আর মাস্টার্সেও তিনি ছিলেন বিভাগের অন্যতম সেরা ছাত্রী।

এখন তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের প্রভাষক। ছাত্রজীবনে তিনটি বছর শ্রেণি প্রতিনিধি ছিলেন বলে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব ভালো। তাঁদের মনস্তত্ব ভালোভাবে বুঝতে পারেন। কিভাবে লেখাপড়া করতে হবে সেটি প্রায়ই তাঁরা তাঁর কাছে জানতে আসে। তিনিও সব সময় সহযোগিতা করেন। ক্লাসের পরেও সময় দেন। তাঁর এই বন্ধুসুলভ আচরণের কারণে তারা পারিবারিক সমস্যাগুলো নিয়েও তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে ও সমাধান নেয়।

তিনি এই বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন ২০১৭ সালের জুন মাসে। ছাত্রত্বের রেশ কাটাতে না কাটাতে তিনি শিক্ষক হয়ে গেলেন—নিজেও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন! বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গর্বের কোনো শেষ নেই এই শিক্ষকের। তিনি বললেনও, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের ছেলে-মেয়েদের কোনো আবাসিক সুবিধা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় অনেক কিছু না থাকলেও তাঁরা মেধাবী। বিসিএসসহ সব সরকারি পরীক্ষায় সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই তাঁরা ভালো করেছেন।’

তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের ক্রিকেট দলের ম্যানেজার ছিলেন, মেয়েদের একটি ক্রিকেট দল গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ বিভিন্ন দিবসে ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পত্রিকায় লেখালেখি করেন এই কৃতি ছাত্রী, ভালো শিক্ষক।