আসলেই কি নারী পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি?


টাইমস অনলাইনঃ | Published: 2017-12-14 18:00:33 BdST | Updated: 2024-05-20 22:49:57 BdST

“পাঁজরের হাড় থেকে নারীর সৃষ্টি”—দলিলভিত্তিক উপস্থাপনা
কথাটি আমরা প্রায়ই শুনি। ইসলামকে বিতর্কিত করার জন্যে অনেকেই এ কথাটি বলে থাকেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইসলাম ধর্মের কোথাও এ কথাটি নেই, যা আমরা ছোটবেলা থেকেই জেনে বড় হয়েছি। এটি হলো খ্রিস্টান ধর্মের একটি কথা। বাইবেলে বলা হয়েছেঃ

“Then the LORD God made a woman from the rib he had taken out of the man, and he brought her to the man.”
(Bible, New International Version, Genesis, Chapter 2, Verse 22)

“স্রষ্টা পুরুষের পাঁজর থেকে একটি হাড় নিয়ে তা দিয়ে একজন নারীকে সৃষ্টি করেছেন। এবং তিনি নারীটিকে পুরুষের সামনে উপস্থিত করলেন।”
বাইবেলের এই লাইনটির ব্যাখ্যায় খ্রিস্টানগণ বলেন, আল্লাহ তায়ালা প্রথম আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করেছেন। এরপর আদমের পাঁজর থেকে একটি হাড় সংগ্রহ করেন। তারপর তা থেকে হাওয়া (আঃ)কে সৃষ্টি করেন। খ্রিস্টানদের এ কথাটিই এখন মুসলিম সমাজে খুবই পরিচিত। কিন্তু এর কারণ কি?

মূলত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর একটি হাদীসকে কোরআনের সাহায্যে ব্যাখ্যা না করে, বাইবেলের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলেই এ সমস্যাটির সৃষ্টি হয়েছে। হাদীসটিতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

“তোমাদের আদেশ করা হচ্ছে, তোমরা নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। কেননা, তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে বুকের হাড় থেকে। সবচেয়ে প্যাঁচানো বা বাঁকানো হচ্ছে বুকের ওপরের হাড়টি। যদি তা সোজা করতে যাও, তাহলে ভেঙ্গে যাবে। আর যদি ছেড়ে দাও তাহলে সে আর বেশি বাঁকা হবে না। অতএব, তোমাদের আদেশ করা হচ্ছে, তোমরা নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে।”
(বুখারি/৫১৮৬)

কিছু কিছু অজ্ঞ-ধার্মিক এ হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, “নারীরা খুবই খারাপ। কারণ তারা হলো বাঁকা হাড়।” আবার, কিছু কিছু নারীবাদী এই হাদীসটিকে উল্লেখ করে বলেন, “ইসলাম নারীদেরকে অপমান করেছে।” আর কিছু জ্ঞানগর্ভহীন, বাঁচাল, নাস্তিক বলে আরেকটু বাড়িয়ে। তাদের খুবই প্রিয় প্রশ্ন, “নারী যদি পুরুষের পাঁজর থেকে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তো কোন পুরুষের হাড়, যে নারীর একের অধিক বিয়ে হয় এবং জীবনে একের অধিক স্বামীর সংসার করে থাকে?” বা “ইসলামে ৪ বিয়ে অনুমোদিত, তো যে পুরুষের ৪টি বউ আছে, তারা কিভাবে স্বামীর ঐ এক হাড় থেকে সৃষ্টি হয়েছে?”

আসলে, এই সব পক্ষের কেউই হাদীসটিকে কোরআনের সাহায্যে বুঝতে পারেননি।

প্রথমত দেখুন, হাদীসটির প্রথম ও শেষ বাক্যে বলা হয়েছে, “নারীদের সাথে ভালো ব্যবহার করার জন্যে তোমাদেরকে আদেশ দেয়া হচ্ছে।” এখানে এ বাক্যটি একবার বললেই হত। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নারীদের সাথে ভালো ব্যবহার করার গুরুত্ব বুঝানোর জন্যে একই হাদীসের শুরুতে এবং শেষে একই কথা দুইবার বলেছেন। সুতরাং, এ হাদীসের উদ্দেশ্য হলো নারীদেরকে সম্মান করা, তাঁদেরকে অপমান করা নয়।

এবার আসি, যা নিয়ে বিতর্ক, সে আলাপে।

নারীদের স্বভাবকে মেনে নিয়েই তাঁদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। এটা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আদেশ। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “নারীদেরকে বুকের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং বুকের ওপরের হাড়টি হচ্ছে সবচেয়ে পাতলা, জটিল ও বাঁকানো। তা যদি কেউ সোজা করতে চায়, তাহলে তা ভেঙ্গে যাবে। তাই, হাড়টিকে সোজা করতে চাওয়া উচিত না।”


রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কোনো হাদীসেই বলেননি যে, নারীদেরকে পুরুষের বুকের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি কখনো “পুরুষ” শব্দটি উল্লেখ করেননি, তিনি কেবল বলেছেন “বুকের হাড়” থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে নারীর বুকের হাড় থেকে, নাকি, পুরুষের বুকের হাড় থেকে, তা কোনো হাদীসেই উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু, বাইবেলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “নারীদেরকে পুরুষের বুকের হাড় থেকে সৃষ্টি করার পর তাকে পুরুষের সামনে হাজির করা হয়েছে।”

এখন, যদি আমরা কোরআন দিয়ে এই হাদীসটি বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে সম্পূর্ণ বিপরীত একটি চিত্র দেখতে পাব। কোরআনে বলা হয়েছেঃ

“পবিত্র তিনি যিনি পৃথিবী থেকে উৎপন্ন সকল উদ্ভিদকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। মানুষদের নিজেদেরকেও তিনি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। এবং তারা যা জানে না, তাদেরকেও জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন।”
(৩৬/সূরা ইয়াসীন/৩৬)

এ আয়াতে স্পষ্ট যে, আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষ উভয়কে একসাথে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। আগে পুরুষকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর পুরুষ থেকে নারীকে সৃষ্টি করেছেন, এটা কোরআনে কোথাও বলা হয়নি। যেমন, আরেকটি আয়াত দেখুন। আল্লাহ তায়ালা বলছেনঃ
“হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হতে পার”।
(৪৯/সূরা হুজরাত/১৩)

দেখুন, এই আয়াতেও বলা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা সমস্ত মানব জাতীকে নারী ও পুরুষ উভয় থেকে সৃষ্টি করেছেন। যদি আমরা বিশ্বাস করি, “নারীদেরকে পুরুষদের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে”; তাহলে এই আয়াতের সাথে বৈপরীত্য তৈরি হয়। এখন অনেকে হয়তো বলবেন, সকল নারীকে পুরুষদের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা না হলেও, হাওয়া (আঃ)কে আদম (আঃ)এর পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কথাটিও ভুল প্রমাণিত হয়, যখন আমারা কোরআনের নীচের আয়াতটি দেখব। আল্লাহ তায়ালা বলছেনঃ

“হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। তিনি তোমাদেরকে একটি ‘নফস’ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীকে সৃষ্টি করেছেন। আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট সাহায্য চেয়ে থাক। এবং আত্মীয়দের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন।”

এ আয়াতে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করার আগে একটি নফস বা সত্তা সৃষ্টি করেন। ঐ সত্তাটি নারীও নয়, পুরুষও নয়। তারপর, ঐ সত্তা থেকে তার সঙ্গীকে সৃষ্টি করেন। এরপর এ দুটি সত্তা থেকে আল্লাহ তায়ালা পুরুষ ও নারী উভয়কে একসাথে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি শুরু করেন। এ আয়াতে ‘নফস’ শব্দটি একটি নারী-বাচক শব্দ। প্রথম নফস থেকে দ্বিতীয় যে নফসটি সৃষ্টি করা হয়েছে তা একটি পুরুষ-বাচক শব্দ। কেননা, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “ ﻭَﺧَﻠَﻖَ ﻣِﻨْﻬَﺎ ﺯَﻭْﺟَﻬَﺎ ” অর্থাৎ, “তার থেকে তার সঙ্গীকে সৃষ্টি করেছেন”, মানে, HE created her husband from her.

সুতরাং, প্রথম নফসকে যদি নারী বা পুরুষ কিছু বলতেই হয়, তাহলে বলতে হবে প্রথম নফস ছিল নারী এবং দ্বিতীয় নফস ছিল পুরুষ। কিন্তু, আসলে প্রথম ‘নফস’ নারী বা পুরুষ কিছুই ছিল না। সুতরাং, কোরআন থেকে স্পষ্ট যে, নারীকে পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়নি। বরং নারী ও পুরুষ উভয়কে জোড়ায় জোড়ায় একসাথে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কারণে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কোনো হাদীসেই পুরুষ শব্দটি উল্লেখ না করে কেবল বলেছেন, নারীদেরকে বুকের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

এখন আসি মূল প্রশ্নে। কেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, নারীদেরকে বুকের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে? এর উত্তর মিলে অন্য একটি হাদীসে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

“নারীরা হলো বুকের হাড়ের মত। যদি তুমি তাঁকে সোজা করতে চাও, তাহলে ভেঙ্গে যাবে। তুমি যদি তাঁর থেকে লাভবান হতে চাও, তাহলে তাকে তাঁর মত বাঁকা বা জটিল অবস্থাতে রেখেই তোমাকে লাভবান হতে হবে।”
(বুখারি/৫১৮৪)

নারীরা বুকের হাড় থেকে সৃষ্টি হয়েছে, এর মানে এই নয় যে, নারীরা আসলেই বুকের হাড় থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এর মানে হলো, নারীদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে যেমন শরীরের বুকের হাড় তৈরী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এ হাদীসটি থেকে তাই প্রমাণিত হয়।
এবার, দ্বিতীয় প্রশ্নে আসি। কেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নারীদেরকে বুকের হাড়ের সাথে তুলনা করেছেন???

১। বুকের হাড়গুলো আমদের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি থাকে। এগুলো বাঁকা হয়ে আমাদের হৃদয়কে জড়িয়ে ধরে এবং আমাদের হৃদয়কে রক্ষা করে। আমরা যদি বুকের হাড়গুলোকে সোজা করতে চাই, তাহলে আমাদের হৃদয় রক্তক্ষরণ হবে। নারীরা পুরুষদেরকে ভালোবেসে জড়িয়ে রাখে। হৃদয়ের জন্যে বুকের বাঁকা হাড়গুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, পুরুষদের জন্যেও নারীরা তেমন গুরুত্বপূর্ণ।

২। অনেক পুরুষ বলেন, নারীকে আমার মত হতে হবে। আবার অনেক নারী বলেন, পুরুষকে আমার মত হতে হবে। এখানে কে কাকে ছাড় দিবে? এটি একটি গুরুতর ও জটিল প্রশ্ন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ প্রশ্নের সমাধান দিয়ে দিয়েছেন এ হাদীসটি দ্বারা। তিনি পুরুষদেরকে আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা নারীদেরকে তোমাদের মত করতে চাইবে না। তাদেরকে তাদের মত থাকতে দিবে এবং তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। অর্থাৎ, পুরুষদের উচিত নারীদের স্বভাবের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নেয়া।

নারীদের আচরণ পুরুষদের আচরণ থেকে ভিন্ন হবার কারণে কোনো পুরুষ যাতে নারীদের সাথে খারাপ আচরণ না করে। সে জন্যেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

“তোমাদের আদেশ করা হচ্ছে, তোমরা নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। কেননা, তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে বুকের হাড় থেকে। সবচেয়ে প্যাঁচানো বা বাঁকানো হচ্ছে বুকের ওপরের হাড়টি। যদি তা সোজা করতে যাও, তাহলে ভেঙ্গে যাবে। আর যদি ছেড়ে দাও তাহলে সে আর বেশি বাঁকা হবে না। অতএব, তোমাদের আদেশ করা হচ্ছে, তোমরা নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।”

৩। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এই হাদীসটি দ্বারা নারীদেরকে অপমান করা হয়নি, বরং নারীদেরকে অনেক বেশি সম্মানিত করা হয়েছে। একটি প্রিয় সম্পর্ক ও একটি সুখী সংসার গড়ার মূলমন্ত্র হলো এই হাদীসটি। কিন্তু অনেকেই হাদীসটির অপব্যবহার করেন।

এমএসএল